‘‘কবি মেহেরুন্ নেসা বলত ‘দেশ স্বাধীন হবেই’’
নাদিরা বেগম || রাইজিংবিডি.কম
১৯৬৪ সালে ‘ফিলিপস’ রেডিও কোম্পানিতে চাকরি হয় আমার। মেহেরুন্ নেসার সঙ্গে চাকরি সূত্রে পরিচয়। রেডিওর পার্টস সেট করতাম আমরা। মোট সাত জন মেয়ে একসঙ্গে কাজ করতাম। সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু, বন্ধুত্ব ছিল শুধু কবি মেহেরুন্ নেসার সঙ্গে। আমাদের অফিস শুরু হতো সকাল ৮টায়। সকাল ১০টায় ১০ মিনিটের জন্য বিরতি পাওয়া যেত। এরপর দুপুরে টিফিন টাইম ছিল ৩০ মিনিট। আর তিনটায় ১০ মিনিটের বিরতিতে আমরা হাসি, ঠাট্টা ও কথা বলার সুযোগ পেতাম। আমাদের কথা বলার মূল বিষয় ছিল সাহিত্য।
ছোট থেকেই আমি বই পোকা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আমার পছন্দ। ওতো মনেই করত রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট গানে, কবিতায় বাঙালি নারীর অভিমান ও প্রেম অসাধারণভাবে প্রকাশ পায়। এই বিশ্বাস থেকে ওর একটি লেখা ‘কবিগুরুকে!’ আমার কাছে আজও সংরক্ষিত আছে। হাতের কাজেও পারদর্শী ছিল মেহেরুন্ নেসা। এক দিন একটি ছোট্ট নৌকা বানিয়ে আমাকে উপহার দিল। আজও প্লাস্টিকে মুড়িয়ে শো-কেসে রেখে দিয়েছি। মাঝেমধ্যে খুলে দেখি। কেউ এলে আগ্রহ নিয়ে দেখাই। তখন বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। আমি আর কতদিনই-বা বাঁচব। আমার মরে যাওয়ার পর একটু যত্নের অভাবে হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে বন্ধুত্বের এই স্মৃতিচিহ্ন।
মেহেরুন্ নেসার নিজ হাতে বানানো নৌকা হাতে নাদিরা বেগম। ছবি: রাইজিংবিডি
১৯৭১ সালে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। ওই অশান্ত সময়েও ‘ফিলিপস’ রেডিও কোম্পানি খোলা ছিল। কারণ এই কোম্পানির মালিক বাঙালি ছিলেন না। পাকিস্তানি আর্মি ফিলিপস অফিসে কখনো কোনো সমস্যা করেনি। কিন্তু, শুরুতেই কবি মেহেরুন্ নেসাকে হারানোর বেদনা এক শূন্যতা তৈরি করে দিয়েছিল আমার হৃদয়ে। যুদ্ধ চলাকালে অফিসে ওকে নিয়ে কেউ কোনো আলোচনা, ফিসফাস কিছুই করত না। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ মেহেরুন্ নেসা মিরপুরে ওর বাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিল। ২৭ মার্চে স্থানীয় বিহারীরা ওকে, ওর মাকে আর দুই ভাইকে হত্যা করে। মেহেরুন্ নেসা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখত। ও বিশ্বাস করতো দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। মৃত্যু মেহেরুন্ নেসার স্বপ্ন কেড়ে নেয়।
আমার পরিবার মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী ছিল। মালিবাগে আমার পৈত্রিক বাড়ি। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র রাখত। আমার ছোট ভাই ইকবাল হোসেন সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। এদিকে, আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল আবুযর গীফারি কলেজ। সেটা এখন আর নেই। সেই সময় ওই কলেজেই পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্প তৈরি করেছিল। আমাদের বাড়িতে মাঝেমধ্যেই এসে তল্লাশি চালাত। ইকবালকে একদিন ধরে নিয়ে যায়। পুরো পরিবার তখন দিশাহারা হবার মতো অবস্থা। ওকে মেরে ফেলেনি। ঢাকা জেলে রেখেছিল। জেলে অনেক শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে ইকবালকে। আমার আব্বা জেলে গিয়ে ইকবাল আর মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত থাকবে না; এই মর্মে লিখিত দিয়ে ইকবালকে ছাড়িয়ে আনেন।
রবিবার বাদে আমাকে প্রতিদিনই অফিসে চলে যেতে হতো। আগের মতোই কাজের ফাঁকে বিরতি পেতাম, শুধু মেহেরুন্ নেসাকে পেতাম না। বাড়ি ফিরেও ওর কথাই মনে হতো। মনেপ্রাণে চাইতাম দেশ স্বাধীন হোক। আমাদের একতলা ‘গ্রিন কটেজ’ বাড়ির আশপাশে আর কোনো পাকা বাড়ি ছিল না। দূর-দূর পর্যন্ত দেখা যেত। মালিবাগে তখন বাজার ছিল না, শান্তিনগরে বাজার করতে যেতে হতো।
এক দিন বাড়ি থেকেই দেখলাম শান্তিনগর বাজার দাউ দাউ করে জ্বলছে। অফিস চলতেই লাগলো। অফিসের গাড়ি আসত। গাড়িতে নিয়ে যেত, গাড়িতে দিয়ে যেত। একদম শেষের দিকে অর্থাৎ নভেম্বরে ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেল। পুরো রাস্তায় পাকিস্তানি আর্মি দেখা যেত। তখন অফিস বন্ধ হলো। অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তা চারদিকে। তারপর বিজয়ের দিন এলো।
১৬ ডিসেম্বর তারিখে দেখলাম পাকিস্তানি আর্মি রাজারবাগ থেকে মৌচাকের দিকে গুলি করতে করতে যাচ্ছে। মালিবাগে ১৪-১৫ বছরের বয়সের একটি ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়। ভাগ্য ভালো গুলি ওর পায়ে লাগে এবং পা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ওর সঙ্গে আরো দুই-তিন জন কিশোর। ওরা মনে করেছিল, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আনন্দে রাস্তায় বেরিয়েছিল। কিন্তু, পাকিস্তানি আর্মিরা আত্মসমর্পণের আগেও এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মৌচাকের দিকে যায়। গুলিবিদ্ধ কিশোরকে রাস্তা থেকে বাসায় নিয়ে আসে আমার দুই ভাই ইকবাল হোসেন এবং আজাদ হোসেন। ওই কিশোরের পায়ের রক্ত মুছে একটি কাপড় দিয়ে পা ভালো করে বেঁধে দেওয়া হয়। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরে ওর সঙ্গের কিশোররা ওকে ধরে বাড়ি নিয়ে যায়।
দেশ স্বাধীন হয়েছে জেনে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে অনেক মানুষ। তখন পতাকায় মানচিত্র থাকত। আমার ছোট ভাই মানচিত্র এঁকে একটি কাপড় কেটে দেয়। আমি হাতে সেলাই করে একটি পতাকা বানাই। তারপর ভাই বোনেরা মিলে সেই পতাকা ওড়াই। অনেক রক্ত আর জীবনের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো। নির্ভয়ে মানুষ পতাকা ওড়ালো। কিন্তু মেহেরুন্ নেসা এই স্বাধীনতা দেখে যেতে পারল না। স্মৃতিতে ও বেঁচে আছে। ওর আত্মত্যাগ আমরা যেন ভুলে না যাই। শনিবার অর্ধেক বেলা আমাদের অফিস চলত। মহাখালী থেকে আমরা চলে যেতাম বাংলা একাডেমিতে। কত কথা হতো আমাদের। ও ছিল ভীষণ শান্ত আর মায়াময়। ওর মুখ এখনো মনে আছে। কতবার দৃঢ়ভাবে বলত, ‘দেখিস দেশ স্বাধীন হবেই।’ দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু ওকে হারানোর বেদনা আছে। এমন অনেকেই হারিয়ে গেছে বলেই স্বাধীনতা এসেছে।
অনুলিখন: স্বরলিপি
ঢাকা/তারা