৯/১১ বদলে দিয়েছিল বিশ্বের চিত্রপট
সালেক সুফী || রাইজিংবিডি.কম
ফাইল ফটো
বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী টুইন টাওয়ার গুঁড়িয়ে দেয়ার ঘটনা নিয়ে নানান গসিপ আছে। অনেক কথা নানাজন নানাভাবে বলে থাকেন। তবে কোন সন্দেহ নেই সেদিন টুইন টাওয়ারসহ আমেরিকার আরো কয়েকটি স্থাপনায় হামলার সেই পরিকল্পনা ছিল সুদুর প্রসারী। আমেরিকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার হৃদপিন্ড পেন্টাগনেও সেদিন হামলা হয়েছিল। টুইন টাওয়ার ধসে পড়ার সেই ভয়াবহ দৃশ্য সরাসরি দেখেছে কোটি কোটি মানুষ। বিভিন্ন সময়ে আমেরিকার জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন সংহার সঙ্গে আমেরিকা ,অস্ট্রেলিয়া এবং আফগানিস্তানে কাজ করার সময়ে এই হামলার প্রসঙ্গে অনেকের কাছে অনেক ধরনের মতামত শুনেছি। বিবিসি ,সিএনএন , আলজাজিরা সাংবাদিকদের সঙ্গে সেসব দেশে এবং বিমান যাত্রার সময় বিমানে বা বিমান বন্দরে অনেক ভাবে অনেক কিছু শুনেছি, জেনেছি। ৯/১১ হামলার ঠিক একবছর পর ইউএস এইডের বিশেষ আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা সফরকালে সেই ঘটনার রেশ শুনেছি।
টুইন টাওয়ার হামলার এপিসোড গোটা পৃথিবীর নিরাপত্তা ব্যবস্থার নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করে। ৯/১১ ঘটনার ঠিক প্রথম বার্ষিকীতে ২০০২ সালে ঢাকা থেকে দুবাই, আমস্টারডাম হয়ে ওয়াশিংটন ডিসি যাত্রা এবং ওয়াশিংটন থেকে মিনিয়াপোলিস হয়ে ক্যালগারি সফরÑবিমান পথের এই পুরোটা জুড়েই প্রায় সব আলোচনা জুড়ে ছিল টুইন টাওয়ার হামলার সেই ভয়াবহতা এবং বদলে যাওয়ার বিশ্বের চিত্রপট।
সেই সফরে আমাদের চার জনের বাংলাদেশ দলে আইন মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুইজন অতিরিক্ত সচিব, এবং পেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন। আমি তখন জিটিসিএলের ডিরেক্টর অপারেশন হিসাবে কর্মরত ছিলাম। সফরের উদ্দেশ ছিল আমেরিকা এবং কানাডার জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা , রেগুলেশন ,প্রাইসিং ,এনার্জি সিকিউরিটি বিষয়ে কর্মরত সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহের সঙ্গে মত বিনিময়। বিশেষ করে আমেরিকার ফেডারেল এনার্জি রেগুলারেগুলেটর এফইআরসি এবং কানাডার রেগুলেটর সিইআর এনার্জি রেগুলেশন বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনই ছিল আমাদের সফরের মুল উদ্দেশ্য।
আমরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারি সংস্থার আমন্ত্রিত অতিথি, তাই বিমানে প্রথম শ্রেণীতে ছিলাম। দুবাই পর্যন্ত যাত্রা স্বাভাবিক হলেও দুবাই বিরতির পর আমাদের বাংলাদেশী চারজনকে পৃথক সিট বরাদ্দ করা হয়। তবে সৌভাগ্য ক্রমে ইউএসএইডের তৎকালীন জ্বালানি বিষয়ক প্রধান ব্রুস ম্যাকমুলেন আমার পাশের সিটেই ছিলেন। দুবাই থেকে আমস্টার্ডাম কেএলএম বিমানে যাত্রার সময় অনুভব করলাম আমাদের উপর বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। কারণে অকারণে ক্রু’রা অতিরিক্ত আপ্যায়নের অজুহাতে আমেরিকা আমাদের যাত্রার বিষয়ে জানতে চাচ্ছে। বিষয়টা রীতিমতো বিরক্তিকর পর্যায়ে পৌঁছালেও সঙ্গে থাকা ইউএসএইডের কর্মকতার ইঙ্গিতে স্বাভাবিক থেকেছি। আমস্টারডাম শিফল বিমানবন্দরে চার ঘন্টা যাত্রা বিরতিকালে সৌভাগ্যক্রমে ক্রিকেট আইকন স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসের দেখা মেলে। রিচার্ডস আমেরিকা হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাবেন। লাউঞ্জে ব্রেকফাস্ট করার একফাঁকে রিচার্ডসের সঙ্গে খানিকক্ষণ ক্রিকেট নিয়ে আড্ডাও দিলাম।
ভাবছিলাম যাত্রাবিরতিতে বিশেষ ব্যবস্থায় দুইঘন্টার জন্য আমস্টারডাম পরিদর্শনে বের হবো। ১৯৮৮ সালে বেশকিছুদিন হল্যান্ডে থাকার সময় শহরটি চেনা হয়েছিল। কিন্তু বিমানেই জানিয়ে দেয়া হলো, যুক্তরাষ্ট্রগামী যাত্রীদের বিশেষ নিরাপত্তা তল্লাশির কারণে যাত্রা শুরুর দুঘন্টা আগে প্রস্তুতি নিতে হবে ,বিমান বন্দর ছেড়ে বাইরে যাওয়া চলবে না।
আমস্টারডাম থেকে ওয়াশিংটন যাত্রা কালে তিনস্তরে তল্লাশি চলল। বিমানের কর্মকর্তা , বিমান বন্দর সিকিউরিটি এবং মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থার প্রতিনিধি দল পৃথকভাবে ব্যাপক সিকিউরিটি তল্লাশি করল। প্রতিটি লাগেজ তল্লাশি করা হয়। এমনকি লাগেজ ট্যাগ স্ক্যান করে মুহূর্তের মধ্যে সেগুলো আমাদের দেখিয়ে নিশ্চিত করানো হয়। বডি চেক যেভাবে করা হয় তার বিস্তারিত বিবরণ নাই বা বললাম। বিমান যাত্রা কালে বুঝতে অসুবিধা হয়নি, আমাদের সঙ্গে থাকা দুই সঙ্গীর নামের সাথে আহমেদ এবং মোহাম্মদ থাকায় তাদের বিশেষ নজরে রাখা হয়।
দীর্ঘ যাত্রার পর ওয়াশিংটন বিমান বন্দরে অবতরণের প্রাক্কালে বিমান থেকে জানানো হয় দিনটি ৯/১১ প্রথম বার্ষিকী বিধায় সকল যাত্রীকে আবার তিন স্তরের নিরাপত্তা স্তর পার করতে হবে। ইতিমধ্যেই আমাদের প্রথম দফা এমন তল্লাশির অভিজ্ঞতা থাকায় এবং সম্ভবত মার্কিন সরকার আমাদের বিষয়ে বিমান বন্দর নিরাপত্তা সংস্থাকে অনুরোধ করে আমাদের চার জনকে অগ্রাধিকার দিয়ে যেন নিরাপত্তা তল্লাশি করা হয়। আমার গলায় ছিল তেল কোম্পানি শেভ্রন এর টাই। তল্লাশি কালে জ্বালানি বিষয়ে অনেক প্রশ্ন করা হলো আমাদের। সফরের উদ্দেশ এবং বাংলাদেশের জন্য কি কাজে লাগবে তার বিস্তারিত জানাতে হলো। আমার নামের অর্থ বিশ্লেষণ করতে হলো। হাতে থাকা লাগেজ তিনবার স্ক্যান করা হয়। জুতো, বেল্ট খুলে তল্লাশি চললো। আমাদের সবার তল্লাশি শেষ হতে ঘন্টা খানিক লাগলো। প্রশিক্ষিত কুকুর দিয়ে লাগেজ তল্লাশি চললো। প্রতিটি ইঞ্চি স্ক্যানিং হলো। জীবনে অন্তত দুই শতাধিক বার বিশ্বের বিভিন্ন বন্দর নিরাপত্তা তল্লাশি পার হয়েছি। কিন্তু ৯/১১ প্রথম বার্ষিকীতে ওয়াশিংটন ডিসির বিমান বন্দরের তল্লাশি বাকি সবকিছুকে হার মানিয়েছে। মাঝে মাঝে বিরক্তি লেগেছে কিন্তু কিছু করার উপায় নেই। মুখে হাসি রেখেই সবাইকে সেই ঝক্কি সামাল দিতে হয়েছিল। পুরো সফরে প্রতিটি কার্যালয় এবং স্থাপনায় পরিদর্শন কালে নিরাপত্তার তল্লাশির কথা নাই বা লিখলাম!
৯/১১ সেই হামলা এবং প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব পরিস্থিতি একশো ভাগ পাল্টে গেছে। ইরাকে ,আফগানিস্তানে দীর্ঘকালীন যুদ্ধের ধ্বংসলীলা দেখেছে। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে কাজের সুবাদে দীর্ঘকালীন রিহ্যাবিলিটেশন প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলাম আমি। চোখের সামনে দেখেছি কিভাবে ধংস হয়ে গেছে সাজানো বাগান!
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
ঢাকা/এমএম