মেহেদী হাসানঢাকা, ১৩ জানুয়ারি: সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা কাজ করে হাঁপিয়ে উঠেছি। ভাবছিলাম কোথাও একটু ঘুরতে যাওয়া দরকার। এমন সময় আমার বন্ধু কাউসার জানাল, অফিসের কাজে পাবনা যাচ্ছে সে। তত্ক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিই পাবনা থেকে ঘুরে আসার। ওর কাজও হলো, এদিকে পাবনার পদ্মার চরটাও দেখা হলো।
ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে রাজশাহীগামী পদ্মা এক্সপ্রেসে চড়ে ঈশ্বরদী বাইপাসের উদ্দেশে যাত্রা করি। দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা ট্রেনের ভুঁ ঝিক ঝিক শব্দে দুলতে দুলতে রাত সাড়ে ৩টায় নেমে পড়ি ঈশ্বরদী বাইপাসে। রাতটা যেকোনো রকমে কোথাও বসে পার করব, স্টেশনে তেমন ব্যবস্থা ছিল না। এ সময় স্টেশনের নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ কবির হোসেন ঈশ্বরদী বাজারে যাওয়ার জন্য ভটভটির ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানকার এক হোটেলে রাতটা থেকে পরদিন সকালে পাবনার বাসে চড়ে বসি।
পৌরসভা অফিসের অপর পাশের এক হোটেলে সকালের নাস্তা শেষে দেখি, অফিস খোলার তখনো ঘণ্টাখানেক সময় আছে। তাই সে সময়টা শেখ রাসেল শিশু পার্কে চলে যাই। চারপাশের সুনশান নীরবতা, পাখির কিচির মিচির শব্দ শুনতে শুনতে কখন যে সময়টা পেরিয়ে গেল, টেরই পেলাম না।
দুপুরের মধ্যে কাউসারের কাজ শেষ হয়ে যায়। সেখান থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে বের হলাম সিএনজির খোঁজে। উদ্দেশ্য পদ্মা নদীর পাড়। অনেক দরদামের পর ৫০ টাকায় রফা হলো। পদ্মা নদীতে যেতে শিকস্তি চরের গ্রামগুলোর মধ্য দিয়ে পাঁচ কিলোমিটার পাকা রাস্তা। কী চমত্কার সব দৃশ্য! দুই দিকেই সবুজের সমারোহ আর নাম না জানা পাখির কিচির মিচির শব্দ।
দুই পাশেই রয়েছে লিচুবাগান, আমবাগান আর তার মাঝে ধানক্ষেত। এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ মনে হলো যেন সবুজের মাঝে হারিয়ে গেছি। কিন্তু পথের তো শেষ হয়ই। কোমরপুর ও সাদিপুরে পদ্মা নদীর এ পাড়ের মাথায় গিয়ে পথের শেষ হলো। এখান থেকে তখন ধূসর বালুর সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতি কী যে সুন্দর, তা বোঝানো যাবে না, শুধু বলা যায় তা মুগ্ধ করেছে, দেবতা থেকে শয়তান সবাইকে। কী অপরূপ দৃশ্য....।
পাশে বাঁশ আর টিন দিয়ে তৈরি ছোট সুন্দর কতগুলো মুদি দোকানের একটিতে আশ্রয় নিতে হলো আমাদের। দোকানের ছাউনির নিচে পাতা বেঞ্চে দুজনে বিস্কুট আর এক কাপ চা খেয়ে পাড়ের দিকে হাঁটতে লাগলাম। পদ্মার পাড় এখন মানুষের বিনোদন স্পটে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে জায়গাটি হয়ে ওঠে কোলাহলপূর্ণ। নদীর পাড়ে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিকালে নারী, পুরুষ, শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষের পদভারে মুখরিত হয়। খুবই মনোরম পরিবেশ। না দেখলে বিশ্বাস করার মতো নয়। তবে এখানে আগতদের বসার বা বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থা নেই। কিছু দোকানপাট গড়ে উঠেছে মাত্র। পরিকল্পিতভাবে যদি সরকারি উদ্যোগে এখানে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য কিছুটা ঠাঁই নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে, জায়গাটি পেতে পারে পর্যটনকেন্দ্রের মতো পরিবেশ।
নদীর পাড় থেকে মূল নদী প্রায় দুই আড়াই কিলোমিটার দূরে। কী করা যায়? পথ আছে তিনটে। ঘোড়াগাড়িতে চড়ে, অথবা বাইকে চেপে অথবা হেঁটে যেতে হবে। রাত জাগরণে আমরা দুজনই ক্লান্ত ছিলাম। বিধায় ঘোড়াগাড়িতে চড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনেক দরদামের পর জনপ্রতি ২০ টাকায় রফা হলো। আমাদেরসহ আরো দুজন নিয়ে পদ্মার ধু-ধু বালুচর পাড়ি দিচ্ছে ঘোড়াগাড়ি। কী যে এক অনুভূতি, তা বলে বোঝানো যাবে না। আহ..হা..কী..আনন্দ এ ত্রিভুবনে...
পদ্মার বালুচর তার অপার মহিমা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে ধরণীকে। আমি মুগ্ধ আর অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। শুধু আমি না, কাউসারও অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। নদী শুকিয়ে পুরোটাই যেন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। আদিগন্ত বালিয়াড়ি। সোনালি তরঙ্গ।
এখানে নদীর মাঝে চর পড়ে সরু ক্যানেলের মতো হয়েছে। মনোরম এ চরে বেড়াতে যাওয়ার জন্য ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করলাম। রবীন্দ্রনাথের কুটি বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মার সে বিশালতা আর নেই। এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। তারপরও পদ্মার রূপ, অকৃত্রিম সৌন্দর্য আমাদের মন রাঙিয়ে দেয়। আর তার মাঝে চরের পর চরের রূপ, মাধুর্য আর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল আমাদের দেশটা কত সুন্দর। এরই মাঝে কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, তা আমাদের একমাত্র মাঝি ছাড়া কেউ টেরই পেলাম না।
ট্র্যাভেল ব্যাগ: বেড়ানোর সময় আপনার ট্র্যাভেল ব্যাগটি দেখেশুনে নির্বাচন করুন। ছাতা, রাবারের স্যান্ডেল সঙ্গে নিন। ক্যামেরা, মোবাইল ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক সামগ্রী পানি থেকে বাঁচাতে ব্যাগে সবসময় একটি ভালো মানের পলিব্যাগ রাখুন। সহজে শুকিয়ে যায় এমন কাপড়ের ট্রাউজার কিংবা অন্যান্য বস্ত্র সঙ্গে নিন।
কোথায় থাকবেন: পদ্মার চরে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। আপনাকে থাকতে হলে পাবনা শহরে ফিরে যেতে হবে। সেখানে থাকার প্রচুর হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে এসি ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা আর নন-এসি ২৫০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। আপনার পছন্দ বা সামর্থ্য অনুযায়ী হোটেলে থাকতে পারেন।
কীভাবে যাবেন: পদ্মা নদীর পাড়ে যেতে হলে ট্রেন বা বাসে করে যাওয়া যায়। ভালো হবে বাসে যাওয়া। গাবতলী থেকে পাবনা এক্সপ্রেসে যেতে পারেন (ভাড়া ৪০০ টাকা নন-এসি আর এসি ৬০০-৯০০ টাকা)। তার পর পাবনা শহর থেকে সিএনজিতে পাবনা থেকে পদ্মা নদীর পাড়ে যাওয়া যাবে। সিএনজিতে জনপ্রতি ২০ টাকা। আর ট্রেনে যেতে হলে চাটমোহর/ঈশ্বরদী বাইপাসে নামতে হবে। সেখান থেকে নসিমনে ঈশ্বরদী বাস স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে পাবনার বাসে উঠতে হবে। শহর থেকে সিএনজি করে পদ্মার পাড়ে যেতে পারেন। বক্তিগতভাবেও গাড়ি নিয়ে পাবনা পদ্মার চরে যাওয়া যাবে।
রাইজিংবিডি / মেহেদী / এএম