মোসতাফা সতেজ : কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর হেমেন্দ্রকুমার রায় ভূমিষ্ঠ হন। ‘প্রসাদ দাস’ তার পিতৃপ্রদত্ত নাম। জীবনে ৮০টি গ্রন্থ লিখেছেন তিনি। করেছেন বেশ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা। বাংলায় প্রথম চলচ্চিত্র, নাট্য-নৃত্যশিল্প বিষয়ক পত্রিকা ‘নাচঘর’ তার হাতেই প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি ছিল সে যুগের নবনাট্য আন্দোলনের মুখপত্র। প্রথম জীবনে হেমেন্দ্রকুমার চিত্রবিদ্যা শিক্ষা নিয়েছিলেন সরকারি আর্ট স্কুল থেকে। চিত্র চর্চার সূত্রে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। এ প্রসঙ্গে হেমেন্দ্রকুমার লেখেন : ‘একদিন অবনীন্দ্রনাথের কাছে ভয়ে ভয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করলুম, আমিও প্রাচ্য চিত্রকলার শিক্ষার্থী হতে চাই। তিনি বললেন, এখন আপনার মতো ছাত্রই আমার দরকার। যারা একসঙ্গে তুলি আর কলম চালাতে পারবে। আঁকুন তো দেখি একটি পদ্মফুল।’তবে চিত্রকর হিসেবে তিনি ততধিক পরিচিত নন। সাহিত্যজীবনে প্রথম থেকেই কবিখ্যাতি ছিল তার। লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। প্রথম কবিতার বই ‘যৌবনের গান’ রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছিলেন। গত শতকের ত্রিশ দশকের শেষকাল পর্যন্ত নানা পত্রপত্রিকায় কবিতা লিখেছেন তিনি। গীতিকার হিসেবেও তার পরিচিতি ছিল। এক হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন। গানগুলোতে সুর দিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম, শচীনদেব বর্মন, কৃষ্ণচন্দ্র দে, হিমাংশু দত্ত, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এবং তিনি নিজে। গান নিয়ে তার ‘সুর লেখা’ বইটি পাঠকপ্রিয় হয়। শিশির কুমার ভাদুড়ীর বিখ্যাত ‘সীতা’ নাট্যাভিনয়ের জন্যে রচিত জনপ্রিয় গানগুলো বইটিতে রয়েছে। উল্লেখ্য যে, ‘সীতা’র নৃত্য পরিচালক ছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়।ত্রিশের দশকে তার কয়েকটি উপন্যাস ও কাহিনির চলচ্চিত্র রূপ দেওয়া হয়। এগুলো বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কিশোর উপন্যাস ‘যখের ধন’, ‘গাঁয়ের ধুলো’, ‘শ্রীরাধা’, ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর মতো ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংগীত রচনা এমনকি নৃত্য পরিচালনার দায়িত্বও তিনি পালন করেন। তিনি রহস্য-রোমাঞ্চ, কল্পবিজ্ঞান, ঐতিহাসিক উপন্যাসের পথিকৃৎও বটে। হেমেন্দ্রকুমার নিজেই লিখেছেন : ‘‘যতদূর মনে পড়ে ‘ভারতী’তে আমার প্রথম রচনা প্রকাশিত হয় ১৩১৫ সালে। উড়িষ্যার শিল্প সম্পর্কীয় প্রবন্ধ। স্বর্ণকুমারী দেবী চিঠি লিখে আমাকে তার সঙ্গে দেখা করার আহবান করেন। তিনি বলেন, ‘বঙ্কিম যুগের কথা’ লিখতে চাও, এ খুব ভালো প্রস্তাব। তুমি লেখা শুরু করো। কিন্তু হেমেন্দ্র, বয়স তোমার কাঁচা, তোমাকে নাম ভাঁড়িয়ে লিখতে হবে। সকলে ভাববে কোনো সেকেলে লেখকের লেখা।... তাই হলো। প্রসাদ দাস রায়ের লেখা ‘বঙ্কিম যুগের কথা’ মাসে মাসে বেরুতে লাগল। তারপর ঐ নামে আমি অনেক পত্রিকায় অনেক লেখা লিখেছি। আসলে এটিই হচ্ছে আমার পিতৃপ্রদত্ত নাম। স্বর্ণকুমারী দেবীর পরামর্শে আমার আসল নামটিকেই আমি ব্যবহার করেছিলুম ছদ্ম নামের মতো।’’রবীন্দ্রনাথ তার সম্পর্কে এক চিঠিতে লেখেন : ‘হেমেন্দ্রকুমার আমার অকৃত্রিম সুহৃদ। কোনো দিন অসম্মান পাইনি তার কাছ থেকে। অথচ তিনি কবি, গল্প লিখিয়ে, সাহিত্যিক ও বাঙালি।’ ‘ছন্দা’ পত্রিকার জন্যে রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি একটি কবিতা প্রার্থনা করেন এই বলে : ‘অনেক দিন পাইনি আপনার নিজের হাতের লিপি ও সেই সঙ্গে লেখা।’ রবীন্দ্রনাথ এরপর কবিতা পাঠিয়ে দেন এবং কবিতার নামকরণও করে নিতে বলেন হেমেন্দ্রকে। সে যুগের পক্ষে মস্ত দুঃসাহসী একটি কাজ তিনি করে বসেছিলেন; লেখাই ছিল তার জীবিকা। অথচ লেখালেখিকে জীবিকা করা এ যুগেও খুব কঠিন। সে যুগের মতো এ যুগেও এ কথা বলা যায়, প্রকাশকদের বেশির ভাগই ধোয়া তুলসী পাতা নন। তাই হেমেন্দ্রকে এক সময় বাধ্য হয়ে অনেক বইয়ের কপি রাইট বিক্রি করে দিতে হয়। অনেক লিখতে গিয়ে অনেক সময় কাহিনির জোগান তাকে অন্য জায়গা থেকে ধার করতে হয়েছে। অনেক সময় ধীরে সুস্থে একটি রচনাকে নির্মাণ করে তুলবার সুযোগ বা অবসরও তার হয়নি। তার তৈরি চরিত্র বিমল, জয়ন্ত, মানিক, সুন্দর বাবু, হেমন্ত, রবীনের নাম এক সময়কার শিশুদের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো। মেঘদূতের মর্তে আগমন, ময়নামতীর মায়া কানন, সূর্যনগরীর গুপ্তধন, ড্রাগনের দুঃস্বপ্ন, অমৃতদ্বীপ নামের বইগুলো তখন শিশুরা লুফে নিতো। ছোটদের মাসিক পত্রিকা ‘মৌচাক’-এর আত্মপ্রকাশ হেমেন্দ্রকুমারের সাহিত্যজীবনে পরিবর্তন এনে দেয়। তিনি এরপর বিভিন্ন পত্রিকায় রহস্য উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। সেগুলো দ্রুত পাঠকপ্রিয় হতে থাকে। তার প্রথম গল্প ‘কেরানি’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘যমুনা’য়। প্রথম গল্পেই তিনি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। গল্পটি পড়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার কাছে প্রশংসাসূচক চিঠি লেখেন। যদিও অনেকে দাবি করেন, ১৯০৩ সালে ‘বসুধা’য় তার প্রথম গল্প ‘আমার কাহিনী’ প্রকাশিত হয়। গল্পকার হিসেবে তার খ্যাতি বিদেশেও পৌঁছেছিল। ১৯৩০-এ বার্লিন থেকে ড. রাইনহার্ড হাগনারের একটি পত্র ও বই পান তিনি। বাংলা গল্পের জার্মান ভাষায় অনুবাদ সংকলন। তাতে অন্যান্য সাহিত্যিকের পাশাপাশি তার ৫টি গল্প ছিল। হেমেন্দ্রকুমার ছোটদের পাশাপাশি বড়দের জন্যও অনেক লিখেছেন। ‘জলের আল্পনা’, ‘বেনোজল’, ‘পদ্মকাঁটা’, ‘ঝড়ের যাত্রী’, ‘যাদের দেখেছি’, ‘বাংলা রঙ্গালয় ও শিশির কুমার’, ‘ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ প্রভৃতি গ্রন্থ তিনি বড়দের জন্য লিখেছিলেন। তার লেখা ‘সিঁদুর চুপড়ি’, ‘শিউলি ও কুসুম’ গল্প দুটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ হয়ে এক সংকলনগ্রন্থে স্থান পায়। শিল্প সমালোচনায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ১৪ বছর বয়স থেকে সাহিত্যচর্চা শুরু করে ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত অবিরাম লিখেছেন তিনি। এ কারণে তার ডান হাতের তর্জনীতে কড়া পড়ে গিয়েছিল। সে সময় অনেকেই বিলেতি গল্পে এ দেশের প্রলেপ দিয়ে সেগুলো দেশীয় কাহিনি হিসেবে উপস্থাপন করতেন। উল্লেখ থাকতো, বিদেশি গল্পের ভাব ধারায় বা ছায়া অবলম্বনে এ কাহিনি রচিত। হেমেন্দ্রকুমার রায়ও এই ধারায় যোগদান করেন। কিন্তু এভাবেও যে সৃজনশীলতার পরিচয় দেওয়া যায় তার প্রমাণ অস্কার ওয়াইল্ডের নাটক অবলম্বনে তার লেখা ‘ইভা দেবীর ভ্যানিটি ব্যাগ’। কিশোর সাহিত্যের দিকপাল হেমেন্দ্রকুমার মারা যান ১৯৬৩ সালের ১৮ এপ্রিল।রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ এপ্রিল ২০১৫/তাপস রায়