আমাদের গ্রামের পাশে বিশাল বড় একটি বিল ছিল। বিলটির নাম সোনামুখির বিল। এই বিলে সারা বছর মাছ পাওয়া যেত। তবে বর্ষা এবং শরতেই মিলত সবচেয়ে বেশি। অনেকেই বেশি মাছ পাওয়ার আশায় গভীর রাতে হারিকেন আর খেপলা জাল নিয়ে চলে যেতো বিলে।
সকালে সবাই যখন চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে বের হতো। সে সময় চোখের সামনে দিয়ে খারুই ভর্তি মাছ দুলিয়ে দুলিয়ে চলে যেতো ওইসব রাত জাগা মাছ শিকারিরা। আর খারুই বোঝাই নানা প্রজাতির মাছ দেখে চোখের ঘুম নিমেষেই হাওয়া হয়ে যেতো ঘুম কাতুরেদের।
মাছ ধরতে আমার খুব ভাল লাগে। সোনামুখির বিলে বেশ কয়েকবার মাছ ধরতে গিয়েছি। এত বড় বিলে মাছ পাওয়া বেশ দুস্কর। দুপুরের আগে আগে গিয়ে খেপলা বেয়ে বেয়ে হাত ব্যাথা করে কয়েকটা মাছ নিয়ে ফিরতে হয়েছে। এজন্য ওদিকে আর তেমন আগ্রহ ছিল না। সাহস করে কোনোদিন রাতে মাছ ধরতে যেতে পারিনি। কারণ শুনেছি এক একা গেলে নাকি মেছো ভূতেরা নানান ঝামেলা করে।
সেদিন রাতে এই নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে খেতে নানান ধরনের কথা বলছিলাম। তার মধ্যে এই প্রসঙ্গও বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল। আমার মতো একই আফসোস দেখলাম আবুলের মনেও রয়েছে। সেও কখনো খারুই ভর্তি মাছ ধরতে পারেনি। সে সময় আবুল বলল, ‘তোর যদি সাহসে কুলোয় তাহলে চল কাল ভোরের আগে আগে আমরা দুজনে মিলে যাই সোনামুখিরবিলে। যা মাছ পাবো দুজনে ভাগ করে নিলেই হবে।’
ওর কথা শুনে রাজি হয়ে গেলাম। আর বেশি কথা না বাড়িয়ে বাড়ি চলে গেলাম। তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে ঘুমানো দরকার। হাতের কাছে জাল আর খারুই প্রস্তুত রেখে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। যার আগে ঘুম ভাঙবে সে অন্যকে ডেকে তুলে নিয়ে যাবে। এমনটাই কথা ছিল। এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছিল আমার মধ্যে। কারণ এ ধরনের অভিজ্ঞতা এর আগে আর কখনো হয়নি। মাছ ধরার উত্তেজনায় ঘুম আসছিল না। এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছি বলতে পারি না। ঘুম ভাঙলো আবুলের ব্যস্ত কণ্ঠস্বরের তাগাদায়।
‘কিরে এখনো ঘুমাচ্ছিস! জলদি ওঠ, আকাশ যে ফর্সা হয়ে এলো। এরপর গেলে আর মাছ পাবি না।’ এ কথা বলে জাল আর খারুই সে নিজেই হাতে তুলে নিয়ে হাঁটতে লাগল। আমি কোনো রকম চোখ মুছতে মুছতে তার পেছনে এক প্রকার দৌড় লাগালাম। কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হলো- আরে যা, হারিকেন নিতেই তো ভুলে গেছি। কথাটা আবুলকে বলতেই সে কেমন যেনো একটু হেসে উঠলো। বলল, ‘মেলা দেরি হয়ে গেছে। একটু পরেই ফর্সা হয়ে যাবে। এখন আর হারিকেন দিয়ে কি হবে? এজন্যই তো আমিও হারিকেন নিয়ে আসিনি। শুধু শুধু বোঝা বাড়িয়ে লাভ আছে? জলদি পা চালা’ বলে সে আরো জোরে হাঁটতে লাগল।
হাঁটার যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কৌশল করতে গিয়ে আমাকে প্রায় দৌড়াতে হচ্ছে। তবু আবুলের নাগাল পাওয়া মুশকিল। অন্ধকারে এতো জোরে হাঁটছে কি করে তা আমার মাথায় আসছে না। আমারতো পায়ে এটা ওটা বেঁধে পড়ে যাওয়ার দশা হলো বেশ করেকবার। পেছনে না তাকিয়েও সে ধমকে ওঠে, ‘চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি! এতো ভালো অন্ধকারেও হাঁটতে পারছিস না!’ সে সময় আমার প্রথম খটকা লাগে। কিন্তু তখন মনে হচ্ছিল, মাছ ধরার উত্তেজনায় হয়ত আবুল এরকম করছে। পাছে দেরি হয়ে যায় সে জন্য আমিও জোরে পা চালালাম।
পেছন থেকে একবার ওকে বললাম, ‘আচ্ছা আবুল, মাছ সত্যিই পাবো তো? আবুল হাসে। তার হাসিটা কেমন যেনো বেখাপ্পা লাগে। এরকম খচ্চরের মতো করে এর আগে আর কখনো হাসেনি আবুল। বলে, ‘মাছতো পাওয়া যাবেই সঙ্গে আরো কিছু পাবি।’ ওর হাসি আর কণ্ঠস্বর কেমন যেনো লাগছে। তবে তেমন পাত্তা দিলাম না। ভাবলাম ঘুম থেকে ওঠার কারণেই হয়ত এরকম লাগছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। তবে মাছের নেশায় সেদিকে তত খেয়াল দিলাম না। তা ছাড়া আবুল আমার ছোটবেলার বন্ধু। ওকে সন্দেহ করার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বন্ধুরাতো অকারণেও কত মশকরা করে!
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা বিলের ধারে পৌঁছে গেলাম। ‘প্রথমে তুই জাল ফেলবি না আমি?’ ওকে জিজ্ঞেস করতেই ও আবার হাসল। বলল, ‘তুই ভালো জাল ছুড়তে পারিস। তুই আগে, পরে আমি ফেলব।’ এই প্রথম ও এতো কাছ থেকে কথা বলল। তার শরীর এবং নিঃশ্বাসের সঙ্গে কেমন যেনো একটু আঁশটে আঁশটে গন্ধ এসে লাগল নাকে। নাক কুঁচকে গেলো। মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে। একটু পিছিয়ে এলাম।
এরকম পচা গন্ধ মানুষের শরীর থেকে বের হয় কিভাবে মাথায় এলো না। মেজাজ খারাপ হলো আবুলের ওপর। জিজ্ঞেস করেত গিয়েও কিছু বললাম না। তার মনে আঘাত লাগতে পারে ভেবে বিষয়টা চেপে গেলাম। সেই সঙ্গে সাবধান হওয়ার আরেকটা সুযোগ হারালাম।
খেপলা জাল নিয়ে পানিতে নামলাম। পেছনে আবুল। হাঁটুর একটু ওপর পর্যন্ত পানি। আরেকটু সামনে গেলে হয়ত কোমর সমান হবে। তবে এই পানিতেই জাল ছোড়া সহজ। কোমর সমান পানিতে জাল ছোড়া যায় না। বেশকিছুক্ষণ চেষ্টার করে একটিও মাছ উঠল না। পেছন থেকে কেমন যেনো গজ গজ করতে লাগলো আবুল। বলল, ‘আরেকটু সামনে গেলে কি তোকে আমি কিছু বলব? মাছগুলোতো আরেকটু সামনেই রয়েছে। কিছুই দেখিস না দেখছি। কানার মতো জাল ফেলছিস।’
কথাগুলো আমার কাছে তেমন ভালো লাগল না। মেজাজ খারাপ লাগছিল। তবে আরেকটু সামনে গিয়ে জাল ফেলতেই জালে মাছের ঘাই বুঝতে পারলাম। মুখে হাসি চলে এলো। মেজাজ খারাপ উধাও। ‘এতক্ষণ বলিসনি কেন গাধা।’ বলে ওর হাতে থাকা খারুইয়ে কয়েকটির মাঝারি সাইজের মাছ রাখলাম।
এরপর প্রায় প্রতিবারই জালে মাছ উঠছে। মন খুশিতে ভরে উঠেছে। মাছ নিয়ে আবুল পেছনে রয়েছে। মাছ ধরার নেশায় কোনোদিকে তেমন খেয়াল ছিল না। হঠাৎ মনে হলো কতগুলো মাছ হয়েছে একটু দেখি। সেই সঙ্গে একটু জিরিয়েও নেওয়া যাবে। পাড়ে উঠে আবুলকে বললাম মাছ কেমন হলো দেখি। সে যেনো কেমন ইতস্তত করতে লাগলো।
তবু খারুই এগিয়ে দিল। দেখলাম প্রায় ফাঁকা। আরে! কিছুক্ষণ আগেই যে বড় টাকি আর শোল মাছটা খারুইয়ে রাখলাম তা গেলো কোথায়? চিংড়িগুলোও হাওয়া। কেবল কতকগুলো টেংরা মাছ পড়ে আছে খারুইয়ের তলায়। ‘মাছ কি ছেড়ে দিয়েছিস নাকি?’ কোনো কথা বলে না আবুল। ‘কি হলো?’ ধমকি দিতেই কাজ হলো। কথা বলে উঠল আবুল। তবে কথা না বললেই যেনো ভালো ছিল।
আবুলের মুখের মধ্যে মাছ। সে গাল ভর্তি কাঁচা মাছ চিবাতে চিবাতে বলল, ‘মাছ সব খেয়ে ফেলেছি। আরো খাবো। না পেলে তোর মুণ্ডু চিবিয়ে খাবো।’ এ কথা বলে আগুনের ভাটার মতো লাল চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল। তার মুখের মাংশ সরে গেছে এখন। ধারালো বড় বড় দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। হাতে বড় বড় নখ দেখা যাচ্ছে। ফিকে হয়ে আসা অন্ধকারে সেগুলো আরো ভয়াবহ দেখাচ্ছে।
ভয়ে আমার গায়ের রক্ত ঠান্ডা হয়ে এলো। মুখো কোনো শব্দ জোগালো না। গলার মধ্য থেকে এক ধরনের গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরিয়ে এলো। তবে ঠিকই জানি সেটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে জোরে করা চিৎকার। হঠাৎ মনে হলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভয়াবহ মূর্তিটি কেমন সচকিত হয়ে উঠল। সম্বিত হারানোর আগে দেখলাম কে যেনো একটা হারিকেন নিয়ে ছুটতে ছুটতে এদিকেই আসছে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মে ২০১৫/সনি