প্রেমে পড়লে যেখানে সাধারণও কবি হয়ে ওঠেন, সেখানে কবির প্রেমে কাব্যধারা বইবে এ আর আশ্চর্য কী? হয়েছেও তাই। এ কারণে দ্রোহের কবির কলমে আমরা পেয়েছি অসংখ্য প্রেমের কবিতা, অজস্র বিরহের গান।
বিরহ কেন?
কাজী নজরুল ইসলাম প্রেমে পড়েছেন একাধিকবার। কখনও সে প্রেম সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো এসে আছড়ে পড়েছে কবির হৃদয় তটে, কখনও প্রেম এসেছে নীরবে। কবি কখনও প্রেম আপনার করে পেয়েছেন, কখনও হয়েছে সে দূর আকাশের তারা। নইলে প্রথম প্রেম সৈয়দা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে যে কবি লিখলেন ‘হার-মানা-হার’, সেই হার-মানা-হারই একদিন কেন তিনি পরিয়ে দিলেন প্রমীলা দেবীর কেশে। কবি লিখলেন :
‘হে মোর রানী ! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে। আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে। আমার সমর-জয়ী অমর তরবারী দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, হ’য়ে উঠে ভারী, এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে।’
(বিজয়িনী, কাজী নজরুল ইসলাম)
এর কারণ খুঁজতে হলে আমাদের যেতে হবে ১৯২১ সালে। নজরুল তখন ২২ বছরের তরুণ। সে বছর ৩ এপ্রিল কবি বন্ধুসম আলী আকবর খাঁর আমন্ত্রণে কুমিল্লা এসে পৌঁছেন। কুমিল্লা কবির গন্তব্য নয়, তিনি যাবেন দৌলতপুরের খাঁ বাড়িতে। এই বাড়িরই ছেলে আলী আকবর। এই যাত্রা বিরতিতে আকবর খাঁ কবিকে নিয়ে স্কুল জীবনের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় ওঠেন। কবি তখনও কি বুঝেছিলেন-পথ সেদিন তাকে কোন পথে নিয়ে এসেছে, জড়াতে চাইছে কোন বাঁধনে? এই বাড়িরই এক মেয়ে হয়েছিলেন তাঁর জীবন পথের সঙ্গী। কিন্তু বিধাতার চিত্রনাট্য তৈরিই ছিল। সেখানে প্রেমাবেগ যেমন ছিল সর্বোচ্চ, তেমনি রহস্যও ছিল দুর্ভেদ্য।
খাঁ বাড়িতে এসে কবি অল্পদিনেই সকলের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। কবির প্রাণ খোলা হাসি, সময়ে অসময়ে গলা ছেড়ে গান, উদাস দুপুর কিংবা জোৎস্না রাতের বাঁশি সবাইকে আপন করে নেয়। কবির বাঁশি শুনে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হন সৈয়দা খাতুন- আলী আকবর খাঁর ভাগ্নি। নজরুলের বাঁশির সুর মাতিয়ে দিল তাকে, অন্যদিকে প্রথম দর্শনেই কবি প্রেমে পড়ে গেলেন তার। এক সময় কবির প্রেমে সৈয়দা খাতুন সাড়া দিলেন। ভালোবেসে কবি প্রেয়সীর নাম রাখলেন ইরানি এক সাদা গুল্মফুলের নামে- নার্গিস। নার্গিস আসার খানম। খেয়ালি কবির অস্থির মন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, নার্গিসকেই তিনি বিয়ে করবেন। খাঁ বাড়ির মুরুব্বীরা বাউন্ডুলে নজরুলের ব্যাপারে মৃদু আপত্তি তুললেও আলী আকবার খাঁর কারণে সে আপত্তি টিকল না। দ্রুত বিয়ের দিন ধার্য করা হলো। বিয়েও হয়ে গেল নির্দিষ্ট দিনে কিন্তু হায়! বাসর হলো না। অপমানে, অভিমানে, ক্ষোভে কবি বিয়ের রাতেই খাঁ বাড়ি ছাড়লেন। ইতিহাসে এর কারণ আজও রহস্যাবৃত। কবির জীবনে নার্গিস অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি।
১৩২৮ সনের ৩ আষাঢ় বিয়ের দিন রাতে কবি কুমিল্লা এসে বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় ওঠেন। এই বাড়ির বিরজাসুন্দরী দেবীর সঙ্গে কবির ৫ দিনের পরিচয়। সামান্য ক’দিনের পরিচয়েই যে অন্তরঙ্গতা তৈরি হয় তা তৈরি করে দেয় আত্মীয়তার সম্পর্ক। বিরজাসুন্দরী দেবীকে কবি ‘মা’ ডাকতেন। তারই জায়ের একমাত্র মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্ত মা গিরিবালাকে নিয়ে এই বাড়িতেই থাকতেন। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মানসিক চাপ এবং ক্লান্তিতে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিরজাসুন্দরী দেবী প্রমীলাকে নিয়ে কবির সেবায় মনোযোগী হন। এর মধ্য দিয়েই প্রমীলার সঙ্গে কবির প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কবি সুস্থ হয়ে কলকাতা চলে এলেও প্রমীলার উদ্দেশ্যে রচিত হতে থাকে গান, কবিতা। ‘দোলন চাঁপা’ কাব্যগ্রন্থে ‘দোদুল দুল’ কবিতায় কবি প্রমীলার রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :
‘মৃণাল-হাত নয়ান-পাত গালের টোল, চিবুক দোল সকল কাজ করায় ভুল প্রিয়ার মোর কোথায় তুল? কোথায় তুল? কোথায় তুল? স্বরূপ তার অতুল তুল, রাতুল তুল, কোথায় তুল দোদুল দুল দোদুল দুল!’
কবির এই প্রণয় সমাজ তো বটেই পরিবারের লোকেরাও মেনে নিতে রাজি হননি। যদিও শেষ পর্যন্ত প্রেম পরিণতি পায়। অনেক বাঁধা পেরিয়ে নজরুলের জীবনসঙ্গিনী হন প্রমীলা। পারিবারিক সম্মতিতে ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল তাদের বিয়ে হয় স্ব-স্ব ধর্মপরিচয় বহাল রেখেই। তখন প্রমীলার বয়স ১৪ নজরুলের ২৩। এই বিয়ের সিদ্ধান্তে গিরিবালা দেবী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, একত্রে থেকে মেয়ের সংসার আগলেও রেখেছেন তিনি। যদিও এর প্রতিদান তিনি পাননি। অপমানে, লজ্জায় তাকেও একদিন সকলের অজান্তে সেই সংসার ত্যাগ করতে হয়েছিল। সে অন্য গল্প।
নজরুলের জীবনে এরপরও আরো কিছু নারীর নাম শোনা যায় কিন্তু এর সত্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। রানু সোম, শিল্পী কানন দেবী, উমা মৈত্র তেমনই তিনটি নাম। এর মধ্যে প্রথম দুজনের সঙ্গে কবির সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যার। রানু সোম বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করে ‘প্রতিভা বসু’ নামে খ্যাত হন। কলকাতায় থাকাকালীন সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়ের কাছে নজরুল রানু সোমের কথা জানতে পারেন। ১৯২৮ সালে ঢাকায় এসেই কবি কাজী মোতাহার হোসেনের সহায়তায় রানু সোমের বাসা খুঁজে উপস্থিত হন। এক পর্যায়ে কবি তাকে গান শেখাতে শুরু করেন। এক হিন্দু ষোড়শীর গৃহে মুসলমান যুবক কবির আনাগোনা সমাজ ভালোভাবে নেয়নি। এই আগুনে ঘি ঢালেন সজনীকান্ত সেন। তিনি ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক। এ নিয়ে পত্রিকাটিতে একটি প্যারোডি প্রকাশিত হয়। এতে পাড়ার যুবকরা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। একদিন রানুদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তারা নজরুলকে আক্রমণ করে। নজরুলও পাল্টা আক্রমণ করেন। ব্যাপারটা পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
শিল্পী কানন দেবীকেও নজরুল গান শেখাতেন। এ সময় রটিয়ে দেওয়া হয়- কবিকে কোথাও না পেলে কানন দেবীর বাড়িতেই পাওয়া যাবে। এই রটনার পেছনেও ‘শনিবারের চিঠি’র ঘৃণ্য ভূমিকা ছিল। উমা মৈত্র (নোটন) ছিলেন আধুনিক, উদার পরিবারের সন্তান। কবি তাকেও গান শেখান। এই পর্যায়ে কবির সঙ্গে উমার যে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তা প্রেমের সম্পর্কে গড়িয়েছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে কাজী মোতাহার হোসেনের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : ‘...নোটনের কাছ থেকে কোনো রকম সাড়া পাওয়া যায় নি। তাঁর মুখের ভাবে স্বীকৃতির বিন্দুমাত্র চিহ্নটুকু ফুটে ওঠেনি কখনও। যেন দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার মত তিনি ছিলেন সকল ধরা ছোঁয়ার বাইরের এক মূর্তিমতী রহস্য।... কেবল নোটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অন্তরঙ্গতার জন্য নির্বাক আবেদনের যতটা প্রয়োজন ছিল অন্যের বেলায় ততটা ছিল না।’
ফজিলাতুন্নেসার কথা উল্লেখ না করলে নজরুলের প্রেমিক জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বলতে দ্বিধা নেই বিয়ের চার বছরের মাথায় কবি ফজিলাতুন্নেসার প্রেমে পড়েন। এবং অবধারিতভাবেই এই প্রেম ছিল একতরফা। কিন্তু তাতে কী! কবি অবলীলায় সোই প্রেম সাগরে ডুব দিয়েছেন। প্রায় তিন বছর সেই প্রেমাবেগে আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি। ঘটনা হলো, ১৯২৮ সালে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় অধিবেশনে যোগ দিতে ঢাকা আসেন। এ সময় তিনি বর্ধমান হাউসে কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায় ওঠেন। এই বাড়িতে ফজিলাতুন্নেসার যাতায়াত ছিল। কবি জ্যোতির্বিদ্যা জানেন- মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে এ কথা জেনে ফজিলাতুন্নেছা কবির কাছে হাত দেখানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বোনের ইচ্ছা পূরণে মোতাহার হোসেন কবিকে নিয়ে এক বিকেলে ফজিলাতুন্নেসার বাসায় উপস্থিত হন।
সম্ভবত এটাই তাদের প্রথম দেখা। প্রথম দেখাতেই কবি ফজিলাতুন্নেসার প্রেমে পড়ে যান। তার প্রেমিক মন টালমাটাল হয়ে ওঠে। কিন্তু অপরপক্ষ তখনও অধরা। কবি একে একে চিঠি লিখতে থাকেন, উত্তর আসে না। বহু প্রতীক্ষার পর যাওবা উত্তর এলো সেখানে কবিকে অনুরোধ করা হলো- চিঠি আর না লেখার জন্য। বলাবাহুল্য কবি সে অনুরোধ রাখতে পারেননি। এক পর্যায়ে কবি তার ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থ ফজিলাতুন্নেসাকে উৎসর্গ করবার অনুমতি চেয়ে চিঠি লেখেন। ফজিলাতুন্নেসা এই চিঠির উত্তর দেননি। আজ আমরা জানি নজরুল কাব্যগ্রন্থটি পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেছিলেন।
ফজিলাতুন্নেসা পরে উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত চলে যান। এখানে উল্লেখ্য যে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী ছিলেন। এ সময় নজরুল তার উদ্দেশ্যে গান লেখেন :
‘জাগিলে পারুল কিগো ‘সাত ভাই চম্পা’ ডাকে, উদিলে চন্দ্র-লেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে।। চলিলে সাগর ঘু’রে অলকার মায়ার পুরে, ফোটে ফুল নিত্য যেথায় জীবনের ফুল্ল-শাখে।। আঁধারের বাতায়নে চাহে আজ লক্ষ তারা, জাগিছে বন্দিনীরা, টুট ঐ বন্ধ কারা। থেকো না স্বর্গে ভুলে, এ পারের মর্ত্য কূলে, ভিড়ায়ো সোনার তরী আবার এই নদীর বাঁকে।’
নজরুল প্রেমে পূর্ণ নিমগ্ন হয়ে তাকে আপন করে চেয়েছেন। এ জন্য ন্যায়-অন্যায়, সমাজের বাধা কিছুই মানেননি তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই, আত্মসমর্পণ করেও তিনি কোনো নারীর কাছেই তা পাননি। নার্গিসের প্রতি তার প্রেম গভীর এবং আজীবনের, প্রমীলার প্রতি প্রেম তাকে বাধনহারা থেকেও সংসারে বেঁধেছে। কবির প্রেম মনে করিয়ে দেয় প্রেয়সীর চেয়ে এখানে প্রণয়ই মুখ্য। আমরা কবিকে বারবার প্রেমের স্তবগান রচনা করতে দেখি। কবি এখানে প্রেমপূজারী। যে কারণে তিনি নার্গিসকে লিখতে পেরেছিলেন :
‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই কেন মনে রাখ তারে ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে। আমি গান গাহি আপনার দুখে, তুমি কেন আসি দাঁড়াও সমুখে, আলেয়ার মত ডাকিও না আর নিশীথ অন্ধকারে।’