শিল্প ও সাহিত্য

দুই নগর দুই মানুষ : মাঝখানে কাঁটাতার ও ধর্মের অসুখ

মনি হায়দার : বইটি সর্ম্পকে লিখবার আগে তানভীর মোকাম্মেলকে নিয়ে কয়েকটি বাক্য লেখা দরকার।  তানভীর মোকাম্মেল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ।

 

বাণিজ্যিক ঘরানার নিম্মমানের ছবি তিনি বানান না। তিনি বানান মানুষের ছবি, বাঙালির ছবি, মুক্তিযুদ্ধের ছবি। যে ছবির ক্যনভাসে ইতিহাস আর মানুষ পরস্পর হাত ধরাধরি করে যাত্রা করে, যে যাত্রা কখনো বিশ্রাম নেয় না। বিশেষ করে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিশাল আলেখ্য নিয়ে তানভীর মোকাম্মেলের কাজ তুলনারহীত। তিনি লালনকে নিয়েও ছবি নির্মাণ করেছেন। অনুবাদ করেছেন। গল্পও লিখেছেন। সম্প্রতি তিনি লিখেছেন উপন্যাস- দুই নগর।

 

খুব বিশাল আকারের উপন্যাস নয় দুই নগর। দুই নগর উপন্যাস সর্ম্পকে বিশিষ্ট লেখক মুম রহমান দুই পৃষ্ঠার একটা বয়ান দিয়েছেন। সেই বয়ানে মুম উপন্যাসের প্রশস্তিই গেয়েছেন এইভাবে, ‘পাঠকের ভাবনা ও বোধে ঝাঁকি দেওয়ার মতো উপন্যাস হয়তো জনপ্রিয় ধারায় আমারা কমই পাই। সেই বিবেচনায়, নেহাতই বিনোদন-পিয়াসী বা সময় কাটানোর খোরাক হবে না তানভীর মোকাম্মেলের দুই নগর। দুই বাংলার মানুষ, ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্মবোধ জানতে-বুঝতে, ভাবতে ভাবাতে এই উপন্যাস হতে পারে মাইলফলক।’

 

সন্দেহ নেই, মুমু ছোট করেই আসল এবং গোপন কথাটাই লিখেছেন দুই নগর উপন্যাস সর্ম্পকে। দুই নগর উপন্যাস বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে আমি কয়েকটি বিষয়ের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। দুই নগর উপন্যাসের আখ্যান গড়ে উঠেছে কলকাতা এবং ঢাকাকে কেন্দ্র করে। স্বাভাবিকভাবে, ইতিহাসের অনেক উপাদান যুক্ত করেছেন তানভীর মোকাম্মেল। সেই ইতিহাসকে প্রতিপাদ্যে রেখেই দৃষ্টি আকর্ষণ আমার।

 

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে কিংবদন্তী। তিনি যদি আর কোনো উপন্যাস না লিখে কেবলমাত্র তিন খণ্ডের  ‘শ্রীকান্ত’ লিখে ইস্তাফা দিতেন, তবুও তিনি বাঙালি পাঠকদের কাছে নমস্য থাকতেন। তিনি ছিলেন ভয়ানক সমাজ সচেতন মানুষ, গোড়ামীমুক্ত মানুষ। ছিলেন কোনো একটা শহরের কংগ্রেস দলের সভাপতিও। তিনি বিখ্যাত ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম বা দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লিখেছেন, বাঙালি ও মুসলমানদের মধ্যে ফুটবল খেলা হইতেছিল। বাক্যটা পুনবার পাঠ করুন, বাঙালি ও মুসলমানদের মধ্যে ফুটবল খেলা হইতেছিল। কাদের মধ্যে? বাঙালি আর মুসলমানদের মধ্যে। বাঙালি কারা? হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। আর মুসলমান? বলাবাহুল্য অধিক ব্যাখার প্রয়োজন নেই। ভারতের হিন্দুদের কাছে তার নিকটতম প্রতিবেশিরা কখনোই মানুষ নয়, বাঙালিতো নয়ই- মুসলামান রয়ে গেছে, এখনও।

 

দ্বিতীয় আকর্ষণ, বাংলাদেশের বই ভারতে তো ভালো, পশ্চিমবঙ্গেও যেতে পারে না। যেতে পারে না নয়, প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। বিপরীতে ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের বইয়ে বাংলাদেশ সয়লাব।

 

তৃতীয় আকর্ষণ, বায়ান্ন সালে জীবন দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নাগপাশ থেকে বাংলা ভাষা মুক্ত করেছিলাম। কিন্তু সেই বাংলা ভাষা আজ একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রবল সহায়তাকারী ভারতের হিন্দি ভাষী ভারতের টিভি চ্যানেলের আগ্রাসী আক্রমণের মুখে। আমাদের দেশের শিশুরা এখন কথায় কথায় হিন্দি শব্দ উচ্চারণ করে। আর মাত্র ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের একটি চ্যানেলও ভারতে প্রবেশ করতে পারে না।

 

চতুর্থ আকর্ষণ, প্রতিবেশি ছোট্ট বাংলাদেশ ঘিরে ভারতের সীমান্ত প্রায় চার হাজার কিলোমিটার। পুরো সীমান্ত জুড়ে ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে, ফেলানীদের ফাঁদ পেতে গুলি করে ঝুলিয়ে রাখবার জন্য।

 

আরত আছে আকর্ষণ করবার প্রসঙ্গ। কিন্তু এই চারটে আকর্ষণকে সামনে রেখে, আমি তানভীর মোকাম্মেলের ‘দুই নগর’ উপন্যাস পর্যালোচনার চেষ্টা করবো।

 

তানভীর মোকাম্মেল প্রচণ্ড প্রতিভাবান মানুষ। প্রচণ্ড প্রতিভা না থাকলে চলচ্চিত্রের মতো জটিল শিল্পপ্রকরণ নিয়ে কাজ করা যায় না। তাও আবার নিন্ম মধ্যবিত্তে সয়লাব, ধর্মে আর্কীণ মন মগজে ঠাসা বাংলাদেশে, ভাবতেই কেমন তড়িতাহৎ হই। সেই সঙ্গে তিনি সাহিত্য চর্চা করছেন। লিখছেন গল্প, উপন্যাস। একমাত্র ব্যতিক্রম একাত্তরের উত্তাল দিনে অকালে হারিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। আমি তানভীর মোকাম্মেলকে তুলনা করবো না জহির রায়হানের সঙ্গে, কেবল মিল দেখালাম।

 

দুই নগর উপন্যাসের আখ্যান বিন্দুতে জয়তী। জয়তী চক্রবর্তী। উপন্যাসতো ঘটনাচক্র। সেই চক্রে জয়তীর সঙ্গে যৌগ হলো মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রায়হানের সঙ্গে। রায়হানের চির উন্নত মম শির এর ভেতরে প্রবহমান মুক্তচিন্তার স্রোত অবিরল। জয়তী ঢাকায় এসে উঠেছে একটা রেস্টহাইজে। সূত্র বন্ধু রুমানা। চরিত্রের সঙ্গে চরিত্রের সংযোগ যাত্রার ভেতর দিয়ে আখ্যানের অগ্রযাত্রা। উপন্যাসিক তানভীর মোকাম্মেলও দুইনগর এ সেই যাত্রার পালা গেঁথেছেন ইতিহাসের সঙ্গে সমকালীন মানুষের মধ্যে চিন্তা ও চেতনার রসায়ন ঘটিয়ে। ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে জয়তীকে গ্রহণ করে রুমানা এবং ওর স্বামী আবিদ।

 

আসতে আসতে আবিদ জানায় বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যমান দর্শন, ‘ডান দিকে দেখ।’ জয়তী তাকিয়ে দেখলো খুব মজবুত চেহারার শক্ত কংক্রিটের একটা বিশাল দালান।

 

‘ওটা আমাদের জাতীয় সংসদ- মানে পার্লামেন্ট ভবন’ একটু মুচকি হেসে বলল, ‘বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে এক বড় সময়টাই তো কাটলো সামরিক আর আধা সামরিক সব সরকারের আন্ডারে। গণতন্ত্র আর কই? কিন্তু পার্লামেন্ট ভবনটা দেখেছো? এ রকম মজবুত  পার্লামেন্ট বিল্ডিং দুনিয়াতে তুমি খুব বেশি একটা পাবে না।’ আবিদের মুখ দিয়ে তানভীর মোকাম্মেল আমাদের গণতন্ত্রের গালে চমৎকার একটা চড় বসিয়ে দিলেন। কিন্তু যাদের জন্য চড় বা থাপ্পর সেই তাহারা কি এই উপন্যাস কেনোদিন পাঠ করিবে? লজ্জা পাইবে?

 

রুমানাদের বাসায় যেতে যেতে জয়তী জানলো শাহবাগে চলছে একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ঘৃণ্যা রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে তরুণ-তরুণীদের বিশাল আন্দোলন। আর আগামী রাতে ডিনারের আমন্ত্রণ রুমানাদের বাসায়। সঙ্গে থাকবেন তরিকুল আর রায়হান। তরিকুল মুর্শিদাবাদের খুবই দরিদ্র গ্রামীণ এক পরিবার থেকে উঠে এসেছে। দেশ ভাগের পর ভারত ছেড়ে এদেশে এসে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। তরিকুল জয়তীর বাবা ইতিহাসের অধ্যাপক দেবব্রত চক্রবর্তীর বন্ধু। দুই দেশের বিভক্তির ফলে কিছু মানুষের কপাল খুলেছে, সেই কপাল খোলাদের একজন তরিকুল। বন্ধু তরিকুল সর্ম্পকে দেবব্রত চক্রবর্তীর বিশ্লেষণ- ‘ তরিকুল যে খুব ব্রাইট ছিল তা নয়। কিন্তু ছিল গভীর আন্তরিক আর কঠোর পরিশ্রমী। সেটাই ওকে উন্নতির পথে নিয়ে গেছে।’

 

‘দুই শহর’ উপন্যাসে তানভীর মোকাম্মেল গভীর মনন দিয়ে খনন করেছেন ৪৭ সালে দুই দেশের বিভক্তির সেই সময়ের মানুষ- হিন্দু মুসলামনের সর্ম্পক, স্মৃতি, বেদনা, অক্ষমতা, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, পরিবারের বিবিধ বিচিত্র ভাঙ্গণ আর হাহাকারের ক্ষরণ। সেই ক্ষরণের দুয়ারে পশ্চিম বাংলার কলকাতা থেকে জয়তী এসেছে ‘পার্টিশন অ্যান্ড ট্রমা অব উইমেন’ প্রসঙ্গে গবেষণা করতে। গবেষণা করার ফাঁকে যাবে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় ওর দাদুর বাড়ি, আর বরিশালের গৌরনদীতে যাবে ঠাকুরদার বাড়ি দেখতে। দুই বাড়ির কতো গল্পই না জয়তী শুনেছে দাদু আর ঠাকুরদার কাছে। জয়তী এই সময়ের কন্যা। আধুনিক, উদার, মুক্ত এবং মানবিক। জয়তীকে জীবনের যাবতীয় দহণকে সহজে গ্রহণ করবার ক্ষমতায় অংকন করেছেন তানভীর মোকাম্মেল।

 

পরের রাতে ডিনারের নানা প্রসঙ্গে আলোচনার সূত্রে তরিকুল বলেন, বাংলাদেশের মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি দুদুটো প্রমোশন পেয়েছে-১৯৪৭ সালে একবার মুসলমান হয়ে, আর ১৯৭১ সালে একবা বাঙালি হয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে  বিরল ভাগ্যবান এক শ্রেণি।’ তরিকুলের মুখ দিয়ে তানভীর মোকাম্মেল আড়ালে রাখা একটি প্রকট সত্যাকে সামনে এনেছেন।

 

ভারত ভাগের ফলে যারা এই দেশে ভারত থেকে এসেছে তারা কোনো না কোনোভাবে নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে, খুব বেশি প্রতিযোগিতা ছাড়াই। এমনিতে পূর্ব বাংলার শিক্ষিত বিকশিত সম্প্রদায় ছিল হিন্দুরা, তারা দলে দলে চলে যাওয়ায় বিরাট যে ভ্যাকুয়াম বা শূণ্যতা তৈরি  হয়েছে, তার ভেতরে নিজেদের সেটিয়ে দিয়েছে তারা অতীব যোগ্যতার সঙ্গে। হিসাব করলে দেখা যাবে, সেই শ্রেণিটি এখনও দিব্যি আছে। সেই সময়ের উন্মূল শাসকশ্রেণিও ভারত থেকে আসা রিফুইজিদের পক্ষে ছিল। কারণ, তারাও রিফুইজি ছিল, নিরপত্তাহীনতায় ভুগছিল। অনেকটা মাইনাসে মাইনাসে প্লাস আর কি! কিন্তু ভূমিপুত্ররা থেকে গেছে বলয়ের বাইরে। তারা তখনও লড়াই করেছে, এখনও এই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দাঁত কামড়ে লড়াই করছে। তানভীর মোকাম্মেল ভূমিপুত্রদের প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেছেন। আর একটা ছোট উপন্যাস কতটাই বা আনা যায়? এমনিতে নানা তথ্যে ও তত্তে পরিপূর্ণ উপন্যাস ‘দুইনগর’।

 

‘দুই নগর’ উপন্যাসে উপন্যাসিক একই ভাষার দুটি ধর্মের শহরের মানুষের আচার আচারণ ইতিহাস ও সংস্কৃতির বন্ধন, দূরত্ব দেখাতে চেয়েছেন। দূরত্বের মধ্যে সর্ম্পকের যে একটি নিবিড় সূত্র আছে, সেটা এনেছেন সূক্ষ্ম নিবেদনে।

 

জয়তী যখন বাংলাদেশে আসে, তখন শাহবাগ জ্বলছে লাখো লাখো বাঙালি তরুণ আর তরুণীর আকাশ মাটি কাঁপানো স্লোগানে- রাজাকারদের ফাঁসি চাই। সেই উড়ন্ত জলন্ত সময়ের সঙ্গে জয়তীর পরিচয় ঘটে। এই আন্দোলনে জড়িত রায়হান, অকুতোভয় যোদ্ধা একাত্তরের। রায়হানের ঘাড়েই পড়ে জয়তীকে ফরিদপুর আর বরিশালে নিয়ে যাবার। একটা গাড়িতে যাত্রা করে দুজনে। ওদের নিয়ে যেতে যেতে উপন্যাসিক যে বিবরণ দেন-‘ জয়তীরা যাবে দুই জায়গায়।... ভোরবেলা বলে ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যামটা এড়াতে পারল। বুড়ীগঙ্গার ব্রিজটা বেড়িয়ে জয়তী বুঝল শহর ছেড়ে ওরা ক্রমে ক্রমে গ্রামাঞ্চলে এসে পড়ছে। দুধারে দোতলা তিনতলা বাড়ির বদলে ভেসে উঠতে থাকল সবুজ ধানক্ষেত, ছোট ছোট জলাভূমি ও খাল। রায়হানও যেন ক্রমশ প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে থাকল। জয়তী জানতে পারল যে জায়গাটি ওরা এখন পার হচ্ছে তার নাম কেরাণীগঞ্জ।  সামনেই পড়বে ধলেশ্বর নদী। আর এসবই বিক্রমপুর অঞ্চল। ইতিহাস প্রসিদ্ধ বাংলার সেই প্রাচীণ জনপথ- বিক্রমপুর! অতীশ দীপঙ্কর, চিত্তরঞ্জন দাশ, জগদীস বসুর দেশ বিক্রমপুর।...অনেক ইতিহাসের স্বাক্ষী সেই বিক্রমপুরের ভেতর দিয়ে ও এখন চলেছে ভেবে জয়তী বেশ শিহরিত হলো।

 

বাংলার যে কেনো জায়গা দিয়ে যেতে যেতে, ইতিহাসই সামনে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। যেতে যেতে জয়তী অবাক হলো সুবিশাল পদ্ধা দেখে। জয়তী আর রাযহানের মধ্যে কথার সর্ম্পক তৈরি হতে থাকে। রায়হান তার অভিজ্ঞতার চোখে, চিন্তার চলমানতায় জয়তীকে বাংলাদেশের সমাজ আর মানবমনের জটিল ধর্মীয় জিগির সর্ম্পকে বোঝায়। এবং জয়তীর মনের ভেতর একটা পাখি ডেকে ওঠে।

 

রায়হানের মুখে গোঁফ আছে। বেশ ঘন পুরুষালী গোঁফ। জয়তী আড়চোখে তাকায়, আচ্ছা গোঁফওয়ালা পুরুষের চুম্মন কেমন লাগবে?

 

চুম্বন? সকল মানবমানবীর সর্ম্পকের প্রথম সূত্র-চুম্বন। পারবে কি পশ্চিমবঙ্গের জয়তী আর বাংলাদেশের মধ্যবয়স্ক, বিবাহিত পুরুষ রায়হান বাসনার নদী অতিক্রম করে দুটি দেশ, দুটি ধর্মের প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে চুম্বনের যাত্রা করতে? তানভীর মোকাম্মেল চলচ্চিত্রকার। ক্যামরায় চোখ রেখে দেখেন মানুষের অস্থির ভেতরে বসানো কংকালে কামনার কামকলা। তিনিইতো জানেন কিভাবে মানুষের- নারী ও পুরুষের শরীরে বাঁশির মর্মরিত সুর, বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছাস আর মিলনের দরজা খুলতে হয়!

 

এক সময়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় জয়তীদের দাদুর বাড়ি পৌঁছে গেল। বাড়িটা এখন স্কুল। ছয়শ ছেলে মেয়ে লেখাপড়া করে। স্কুলে হিন্দু মুসলমান শিক্ষক মিলে পড়াচ্ছে। জয়তীকে পেয়ে সবাই খুব উচ্ছ্বসিত। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সবাইকে ডেকে জয়তীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। স্কুলটা নাম ‘উদয়তারা চক্রবর্তী হাইস্কুল’।

 

তানভীর মোকাম্মেল শুভ বুদ্ধি ও কল্যাণবোধের মানুষ। নিজের ধ্যনস্থ চিন্তার ভেতরে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান  সব ধর্মের মানুষকে একই সমতলে দেখেন। ভারত থেকে আগত হিন্দু জয়তীকে এলাকার সবাই খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করল, কোনো প্রশ্ন কেউ তুলল না, আগ্রাসী আগ্রাসনের কালে ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। হয়তো হতেও পারে, হলেতো ভালোই। কি দরকার ছিল ৪৭ সালের বিভক্তি?

 

স্কুলের হেডমাস্টার আলতাফ হোসেন  বললেন, ‘আপনাদের পরিবারটি তো ভাঙ্গায় খুবই পরিচিত। আপনার দাদু ইস্কুলটার জন্য জমি বাড়ি সব লিখে গেলেন তখন থেকেই দীননাথ চক্রবর্তীর নাম এ অঞ্চলের ঘরে ঘরে।”  দীর্ঘ দিবস রজনী পার হয়ে স্মৃতির পেরেক গেঁথে রাখা এইসব ঘটনা যখন নাতনী শোনে, স্বাভাবিকভাবে বোধের জলে এক ধরনের তরঙ্গ প্রবলভাবে বহিয়া যায়। জয়তীও সেই প্রবল তোড়ে ভাসে, দাদুর জন্মভিটাকে অনুভব করার চেষ্টা করে। যদি ৪৭ সালে দেশটা ভাগ না হতো অন্তত যদি অখণ্ড বঙ্গ থাকতো, এই জয়তীর জন্মতো এই বাড়িতেও হতে পারতো!

 

স্মৃতি, সুখ আর চাপা দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে জয়তী পুনবার যাত্রা করে আর এক দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাসের দিকে- বরিশাল। আবার পথ। মানুষের ঠিকানা আসলে পথ। সেই পথের বর্ণনা আর জয়তীর থরো থরো আবেগে দিচ্ছেন তানভীর মোকাম্মেল- ‘আবার ওরা ফিরে এলো ফরিদপুর বরিশাল রোডে। ভাঙ্গা বাজার পেরিয়ে ওদের মাইক্রোবাস ছুটল  বরিশালের গৌরনদীর দিকে। একটা অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূত আচ্ছন্ন করে রাখল জয়তীর মন। সত্যি সত্যিই ও তাহলে এসে নিজের চোখে দেখে যেতে পারল ওর মায়ের অনেক গল্পের সেই দাদুর ভাঙ্গার বাড়িটা? বাড়িটা  হয়তো ভালো নেই, হয়তো ভেঙ্গে ফেলা হবে কিন্তু স্কুলটা তো আছে। ওর দাদুর মায়ের নামে উদয়তারা চক্রবর্তী হাইস্কুল। যে স্কুলটার জন্যে এই এলাকার মানুষ গর্বিত। কত শত শত ছেলে-মেয়ে এই স্কুল থেকে পড়াশুনা করে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। দাদুর স্বপ্ন বিফলে যায়নি। পাশের মানুষটার প্রতিও এক গভীর কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল জয়তীর মন। হ্যাঁ, রায়হানের জন্যেইতো সম্ভব হলো জয়তীর এই সফল সফর। জয়তী আড় চোখে তাকাল মানুষটির দিকে।’

 

মানুষের ইতিহাস মূলত এই-ই। কেউ ছেড়ে যায়, যেতে বাধ্য হয়, রেখে যাওয়া ভিটায় তৈরি হয় নতুন বসতি, ভিন্ন স্বপ্ন। জয়তী মূলত ইতিহাসের এই পালাবদলের  সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। ঠিক একই কামনায় অনেক মুসলমানও  ছেড়ে এসেছে ভারতের নানা জায়গায় অসংখ্য ভূমিখণ্ড। যেখানে ছিল নারকেল বিথী, জাম জারুলের বন, ছিল দীঘি আর হাঁস মুরগীর সংসার। বাংলাদেশের কোনো কোনো প্রত্যাগত নাগরিক তার সন্তান, তার নাতী নাতনীদের কাছে সেই বিরান ইতিহাসের দূভার্গ্যের  খেরোখাতা তুলে ধরেন। আর নিদাঘ দুপুরে ঘুঘু ডাকা শ্রান্ত মনে গভীর স্মৃতিকাতরায় ত্যাগ করে দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস।  বাস্তভিটা মানুষের সঙ্গে সঙ্গে যায়।

 

জয়তী দ্বিতীয় বাস্তভিটার দিকে যায়। না, ভাঙ্গার মতো গৌরনদীর বাস্তভিটা সহজে ধরা দেয় না। শুরুতেই দখলকারীরা প্রশ্ন তোলে, কোথায় কিসের জমিদারী? ঠাকুরদাদার দালানটা টিকে আছে। একটা পরিবার বাস করছে। লোকজন বাড়ছে। কেউ একজন বলছে, ‘কলকাতা থেকে আইছে। হিন্দু।’ অবস্থা বেগতিক দেখে রায়হান ফোন করে একাত্তরের সহযোদ্ধাদের। যাদের সঙ্গে কাঁধে কাধ মিলিয়ে একাত্তরে হায়েনা পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে এই অঞ্চলে যুদ্ধ করেছিল। বাইকে এসে নামে কাজী ফারুক আর মনোয়ার। জয়তীর সঙ্গে পরিচয়ের পর ফারুক।

 

ফারুক স্থানীয় কলেজের শিক্ষক। ছাত্ররা ভিড় করে। জয়তীর জড়তা কাটে।

 

বাড়ির দখলদার ইনসান আলীকে ডাকা হলে সেই জয়তীকে ঘুরিয়ে দেখায় বাড়িটা। সেই সাতচল্লিশ আর এই সময়ের ব্যবধানে কতো ইতিহাস পাল্টে যায়, আর এতো মানুষের দখল। পরিবর্তন অনিবার্য। ঘুরতে ঘুরতে জয়তী দেখে-‘মূল বাড়িটা তো নেই। ওখানে এখন হলুদের ক্ষেত। বাকী অংশটা জুড়ে দুটো নতুন টিনের ঘর। ভাড়া দেয়। দক্ষিণের দীঘিটিকে, যা জেঠু বা ছোট কাকার বর্ণনায় মস্ত দীঘি, সেটা বড় পুকুর ছাড়া কিছুই মনে হলো না জয়তীর।...জয়তী হ্যান্ডব্যাগটা থেকে পলিথিনের ছোট একটা ব্যাগ বের করে বাড়িটার আঙ্গিনা থেকে এক মুঠো মাটি তুলে সযত্মে ব্যাগটাতে রাখলো। বাবা বলেছিলেন, চৌদ্দপুরুষের ভিটায় যাচ্ছিস, কিছুটা মাটি নিয়ে আসিস।,

মাটি!

 

জগত জুড়ে এতো মাটি, মাটি গ্রাস করে মানুষ, কিন্তু মানুষের মাটি দখল আর শেষ হয় না। মাটির প্রতি মানুষের মায়া মমতার এই দর্শন কি আগ্রাসনের আরেক রূপ?

 

ফেরার পথে ফরিদপুর- বরিশালের মাঝে মাদারীপুরের এক এনজিওর রেস্ট হাউজে ওঠে জয়তী আর রায়হান। রেস্ট হাউজ সাধারণত পরিপাটি হয়। উপন্যাসিক তানভীর মোকাম্মেল এই রেস্ট হাউজেই সেই চুম্বনের চুম্বন রচনা করলেন, মানব আর মানবীর খোলা হাওয়ায় হাওয়ায়...।

 

বৃষ্টির কারণে বাইরে থেকে ভেতরে এলো রায়হান আর জয়তী। জয়তী রুমের ভেতর থেকে টাওয়াল এনে দিলে মাথা মুছতে থাকে রায়হান। তানভীর মোকাম্মেল লিখেছেন-‘ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রায়হান মাথা মুছতে থাকলে ওর হাত ধরে জয়তী ভেতরে নিয়ে এলো, ভেতরে আসুন ভিজে যাচ্ছেন তো। তারপর কী যেন হলো! প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়মেই দুজন মানব মানবীর দেহ ক্রমশ কাছাকাছি এলো। দুটো মুখও। রায়হানের বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে জয়তী অনুভব করলো গোঁফওয়ালা পুরুষের চুম্বন কেমন! একটা সুখদ তৃপ্তির আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো ওর দেহ মনে।’

 

পরের লাইনে উপন্যাসিক লিখেছেন-‘জয়তী এর আগে দুজনের সঙ্গে শুয়েছে।’ জয়তী যে ঘরানার মেয়ে, রুচিস্নিগ্ধ  মানুষ, মননে দৃপ্ত, সেই জয়তীর সঙ্গে ‘শুয়েছে’ শব্দটা মনে হয় বেমানান। সাধারণত আমরা তৃচ্ছ, তাচ্ছিল্য এমন কি অপমান অর্থে শব্দটা ব্যবহার করি। জয়তী, জয়তীরা এই সময়ের কন্যা। আধুনিকতো বটেই চূড়ান্ত ব্যক্তি স্বাধীনতার কালের মানুষ। যেকেনো পুরুষের সঙ্গে সর্ম্পকতো হতেই পারে। হতে পারে শারিরীর সংরাগ। কিন্তু শুয়েছে শব্দটা কোনোভাবেই যায় না। ‘দুই নগর’ উপন্যাসের প্রধানতম চরিত্রকে এতোটা অপমান করা উচিজৎ হয়নি উপন্যাসিকের।

 

উপন্যাসের পরতে পরতে তানভীর মোকাম্মেল ইহিতাসের নানা উপাদান ঢুকিয়েছেন। কারণ, তিনি চটুল উপন্যাস বা বাণিজ্যিক উপন্যাস লিখতে চাননি। দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিল অন্তমিল গোজামিল আর দীর্ঘশ্বাস বয়ান করেছেন। সুতরাং এই উপন্যাসে অনেক চরিত্রের সঙ্গে ইতিহাসও একটা চরিত্র। দুই পারের মানুষের, কাঁটাতারের ক্ষত বিক্ষত দিনরাত্রির ঘটনা, ঘটনার আগের রটনা, ঘটনার পরের ঘটনার উসকে দেয়া আগুনের শেক দিতে চেয়েছেন সচেতন পাঠকদের। এখানে আমি সচতেনভাবে ‘সচেতন পাঠক’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছি।

 

জয়তীর মিশন শেষ। চলে গেছে কলকাতায়। কি নিয়ে গেছে? পাঠকতো জানেনই। কিন্তু জয়তীর কোনো শংকা নেই। জয়তীরা যে জয় করতে জানে, নিজেকে, শরীরকে এবং ইতিহাসকে তো বটেই। যদিও উপন্যাসের নাম ‘দুই নগর’ কিন্তু উপন্যাসে ঢাকা শহরের কিছুটা বর্ণনা থাকলেই কলকাতার বর্ণনায় খামতি আছে। আর ইতিহাসের মানুষেররা যতোই ইতিহাস চর্চা করুক, যতোই স্মৃতি কাতরতায় অশ্রুপাত করুক- কাটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা ফেলানীর লাশ প্রমাণ করে দিয়েছে, দেশ বিভাগ অনিবার্য ছিল। ‘দুই নগর’ উপন্যাসের চরিত্ররা, আখ্যানভাগের ঘটনা দেখা হয়েছে পাখির চোখে, শিক্ষিত চিন্তায় জাগ্রত মানুষের চোখ থেকে, সীমান্ত এলাকার মানুষ, গড় পরতার মানুষের কাছে এই উপন্যাস কোনোদিন যেমন পৌঁছুবে না, তেমনি উপন্যাসিকের মানবিক বোধ, শুদ্ধ বোধ কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের কানেও পৌঁছাবে না।

 

আমার প্রিয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই লাইনটা  আবারও উপস্থাপন করে, রচনা শেষ করতে চাই-‘বাঙালি ও মুসলমানদের মধ্যে ফুটবল খেলা হইতেছিল।’ মানুষ কোথায়?’ 

 

ক্রিয়েটিভ ঢাকা পাবলিকেন্স থেকে বইটি যত্ম করে প্রকাশ করা হয়েছে। যর্থাথ প্রচ্ছদ এঁকেছেন আবিদ এ আজাদ। দাম ২৫০ টাকা।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬/সাইফ