|| সুহিতা সুলতানা || সত্তরের দশকের অন্যতম প্রধান কবি কামাল চৌধুরী। যাঁর কবিতায় উঠে এসেছে মাটি, মানুষ, প্রেম, প্রকৃতি ও দেশপ্রেম। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা কবিতার পটভূমি আত্ম-সচেতনতায় ঋদ্ধ দেশমাতৃকার অসাম্প্রদায়িক চিন্তার বিকাশ কামাল চৌধুরীর কবিতার প্রধান উপজীব্য। দুঃশাসন থেকে মাতৃভূমি উদ্ধার, মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত অমিততেজ তরুণ কবি কামাল চৌধুরীর অস্তিত্বজুড়ে ক্রমশ বেড়ে উঠতে থাকে। দেশপ্রেম, জন্মভূমি রক্ষার সংকল্প বাঙালি জাতিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের মহিমা জাগ্রত হয়েছে তাঁর কবিতায়। ঐতিহ্য প্রোথিত শেকড় অনুসন্ধানী অভিন্ন রহস্যঘন দীর্ঘ অনিঃশেষ পথের দৃশ্যায়ন ঘটেছে তাঁর কবিতায়। ভাবনার ক্রমাগত জটিল উত্থান-পতন মর্মমূলে বিষাদময়তা সৃষ্টি করলেও অনুভবের তীব্রতা ছুঁয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের কবিতার পটভূমিজুড়ে ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রজ্জ্বলিত কবি কামাল চৌধুরী কবিতায় নিমগ্ন হলে তাঁর কবিতার গূঢ়রহস্য উম্মোচন করা সম্ভব। প্রবল দেশপ্রেম, রোমান্টিসিজম নৈতিক চেতনা বিষাদময়তা তাঁর কবিতার মূল সুর। কবি কামাল চৌধুরী রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অত্যন্ত দক্ষ ডাকসাইটে আমলা। তাঁর কবিত্ব শক্তি ব্যক্তিত্ব ও সারল্য তাঁকে এনে দিয়েছে খ্যাতি ও সকলের ভালোবাসা। একজন সত্যিকারের কবিই পারেন দেশ ও দেশের মানুষকে উদার মানবতা দিয়ে গ্রহণ করতে। যুদ্ধকালীন বাংলাদেশে মানুষের যন্ত্রণা, পীড়ন বিধস্ত জনপদ তাঁর ভাবনা জগতকে যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষের জীবনের কাছাকাছি নিয়ে আসে। তিনি লেখেন: ‘তখন স্বদেশজুড়ে শকুনের উড়াউড়ি, পাখসাটে
বয়ে আনে মৃত্যু
গ্রামগঞ্জে পাড়ায় পাড়ায় তীব্র বেগে ধেয়ে আসে
চকচকে হেলমেটবাহী ট্রাক
মাঝরাতে কারো কোনো বিপন্ন চিৎকারে
ছত্রখান হয়ে যায় হিম নীরবতা
ধারালো ছুরির মতো তীক্ষ্ম স্বরে কেঁদে যায়
ভয় পেয়ে নিশির কুকুর।’
(মুক্তি ও বিপ্লব-এর কবিতা, টানাপোড়েনের দিন) কামাল চৌধুরীর কবিতা পাঠ করলে সহজেই সনাক্ত করা যায় তাঁর কবিতার সুর। আত্ম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই একজন কবির স্বভাবজাত আত্মকথন উপলদ্ধি করা যায়। তাঁর কবিতার মধ্যে প্রেম ও দ্রোহের চিত্রায়ণ সহজেই লক্ষ্যনীয়:
‘সারি সারি পদ্য লিখে তাঁর নাম ছুড়ে দেব বলে
যেখানে জোয়ারের জল স্রোতস্বিনী
স্নান শেষে পাপ নিয়ে যাবে’
(নিসর্গ কুমারী, মিছিলের সমান বয়সী)
প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ থাকে। কখনো কখনো সে দুঃখের ভার একজন কবিও কাঁধে তুলে নেন। তাঁর কবিতার প্রকাশভঙ্গি অন্যান্য কবির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নতর, আধুনিক বাংলা কবিতার আঙ্গিক সুর প্রধান ধারার সে বৈশিষ্ট্য তা কামাল চৌধুরীর কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। আবেগ ও বেদনার নৈকট্য তাঁর কবিতায় সঞ্চারিত হয়েছে। তীব্র সংরাগ ও শাশ্বত মানব-মানবীর যে রূপ তা স্বপ্ন প্রয়াণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর কবিতার মধ্যে শান্তি ও সৃষ্টির সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। ঘোরলাগা মনস্তাত্বিক যাদুবাস্তবতা ক্লান্তিহীন শেকড়ের সন্ধানে স্বপ্নময় করে তোলে:
‘দিন শেষ হলে সব কথা মনে থাকে কার?
কে থাকে আচ্ছন্ন সুখ, এক বুকে ধরে রাখে
সারাটা দিবস...
একটি দিনের শেষে সারাদিন স্মৃতি হয়ে যায়
কে এমন স্মৃতি ফেরা মুখ? পশ্চাৎ পূজক?’
(একটি দিনের শেষে) প্রকৃতির অচেনা জগতের রূপকথা, প্রেম ও দ্রোহের অবিচ্ছিন্ন পথে কবি হেঁটেছেন দীর্ঘপথ। প্রাচীন কাব্যের ঐতিহ্য পেছনে ফেলে সম্পূর্ণ আধুনিক কবিতার বিষয়কে বক্তব্য নির্ভর করে অপরিমেয় উল্লাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন কবি...
‘ছত্রিশ বছর এই বর্ণিল বসন্ত
তবু এখনো ভাসেনি পতাকা, হন্তদন্ত
ন্যাড়া মাথা ঘোরে বনে বনে’
(ছত্রিশ বছর)
আবেগ-উচ্চকিত, নতুন সমাজসৃষ্টির জয়গান, রহস্যঘন অভিন্ন পথ তিনি অতিক্রম করতে চেয়েছেন। অচেনা জগতের অচেনা-হাওয়া তাঁকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে এবং নতুন পথের দিকে অর্থাৎ চাঁদের কাছে লগ্ন হয়ে থাকতে চায় পুরোটা সময়। তিনি নির্মাণ করতে চান স্বপ্নের ভুবন। তিনি কখনই অস্পষ্ট জীবন-যাপন করতে চাননি। প্রেম ও দ্রোহের দীর্ঘ সংলাপ তাঁকেও সমানভাবে টানতে থাকে। তিনি লেখেন: ‘কাম কোনো নির্বাণ নয়- দেবী জানে এই আলিঙ্গন
ধর্মেরও বিধিসম্মত
মহাকাম শ্রেষ্ঠ পুরুষের নেশা
আমি কি নিষিদ্ধ কোনো প্রেমিকার বাহুলগ্ন হয়ে?
রাত্রী গভীর হয়- মনে হয় অন্ধকার মিশে গেছে
প্রেম ও পতন
সবাই খুলতে জানে, একজনে ক’জনে
দেহে সেই অনাদি উত্তাপ
পতঙ্গ নিজেই পোড়ে অর্থবিত্ত কিংবা হৃদয়ে।
(আমাকে জম্ম দাও ভিন্ন কোনোভাবে) কবি কামাল চৌধুরীর কবিতায় প্রতীক, উপমা, রূপক, চিত্রকল্প ও যাদুবাস্তবতার বিচিত্র রূপ বহুমাত্রিকতায় পূর্ণতা পেয়েছে। তাঁর কবিতার পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে আধুনিক কবিতার যে মেজাজ এবং বৈশিষ্ট্য তাঁর কবিতা পাঠ করলেই অনুভব করা যায়। বক্তব্য, ভাষা এবং কবিতার যে চিত্রকল্প তাঁর প্রতিটি কবিতার ভেতরেই মূর্ত হয়ে উঠেছে। কবিতা এক মহাশক্তি যা বিদ্বেষ ও ঘৃণাকে চিহ্নিত করতে পারে। সময় ও কাল ধারণ করে কামাল চৌধুরী তাঁর কবিতাকে সম্মুখভাগে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, যেখানে একজন পাঠক তাঁর সমস্ত বিশ্বাস ও ঘটনাকে চিহ্নিত করতে পারে:
‘এই দেশে আমি আছি রক্তভেজা এই জনপদে
সহস্র মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয়ে যায়
তবু আমি ভয়হীন দীপ্র-বর্ণ অনার্যযুবক
অনায়াসে ছিন্ন করি হাতকড়া, আঁধার নীলিমা’
অথবা ‘আমি তো বিশ্বাসী নই শ্রমহীন জাগতিক প্রেমে’
(রক্তাক্ত পঙ্ক্তিমালা) কবির কাছে এক অনিঃশেষ ভালোবাসা তাঁর কবিতা। অনুভব তাঁকে ছুঁয়ে যায় কিন্তু অতৃপ্ত চরণ তাঁকে কাঁদায়। ওপরের উদ্ধৃত কবিতাংশের মধ্য দিয়ে কবির মৌলিক স্বর চিহ্নিত করা যায়। প্রতিবাদী ও দ্রোহী সত্তার তীব্র গতিময়তা কামাল চৌধুরীর কবিতার বৈশিষ্ট্য। তাঁর কাব্য ভাষা অন্যান্য কবিদের থেকে তাঁকে ভিন্নতর আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিন দশকের অধিক সময় ধরে কামাল চৌধুরী কাব্য সাধনায় নিয়োজিত রয়েছেন। কবি কামাল চৌধুরীর কাব্যভাষা অত্যন্ত সাবলীল ও স্মার্ট। আধুনিক শব্দের বুনন ও বক্তব্যের দিক থেকে তিনি সত্তরের দশকের অন্যান্য কবিদের থেকে অনেকটা এগিয়ে। প্রকৃতি, প্রেম, মানুষ ও সমাজ তাঁর কবিতার অন্যতম বিষয় হলেও রাজনীতি থেকে দূরে নয়। ব্যাখ্যা ও যুক্তির মধ্য দিয়ে তিনি পাঠকের জবাবদিহিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন; তাঁর মতে বোধের অতীত সবই কবিতার বিষয়। সত্যানুসন্ধান এবং উপলদ্ধিজাত সমগ্র বিষয় তাঁকে স্পর্শ করে। তিনি মনে করেন-আধুনিককালের কবিতামাত্রই স্বাভাবিক কবি। অন্ধকার ও স্তব্ধতা ভেঙে ভেঙে কবিও অগ্রসর হতে চান সামনের দিকে, যে পথের শেষ নেই। নগর সভ্যতার সাথে সাথে তাঁর কবিতায় নিসর্গ মগ্নতা লক্ষ্য করা যায়। কখনো কখনো কবিরও লোকালয় ছেড়ে কোথাও চলে যেতে মনে চায়। একজন কবির জন্য এটা প্রয়োজনও বটে। তবে আবেগের অতিরঞ্জন নয়। তাঁর প্রকাশিত ৯টি কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে অনুধাবন করা যায় কাব্যিক সুষমা ও আত্মকথন। একজন কবি তাঁর যাপিত জীবনের চিত্র তাঁর কবিতার প্রকাশ করতে চান। প্রকৃতির ওপর কবি লগ্ন হয়ে থাকতে চান অনাদিকাল। ছায়াবৃক্ষ তাঁকে হাত ছানি দিয়ে ডাকে আর অসংখ্য পাখির পালক কবিকে আদ্রিয়মান করে রাখে:
‘সাঁওতাল রমণীর ঘোর লাগা চোখের মণি
প্রতিদিন ঝুড়ি ভরে জমা হয় রোদ। মনে হয়
ছায়াবৃক্ষ থেকে নেমে এসে অসংখ্য অতিথি পাখি
মিশে গেছে সাজানো সবুজে’
(শ্রীমঙ্গলের দিন) নাগরিক জীবনের টানাপোড়েন ও অনুভূতিহীন মানুষের রক্তচক্ষু অবলোকন করেছেন কবি। তাঁর সাহসী উচ্চারণ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কবিতার সময় ও দিন মনে করলে অনুধাবন করা যায় তিনি কীভাবে অপশক্তির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। তিনি লিখেছেন:
‘যেখানে ঘুমিয়ে আছে, শুয়ে থাক
বাঙালির মহান জনক
তোমার সৌরভ দাও, দাও শুধু প্রিয়কণ্ঠ
শৌর্য আর অমিত সাহস
টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামগুলো
তোমার সাথে নেবে
(টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে) ক্রমাগত কবি কামাল চৌধুরীর কবিতা পাঠ করলে বোধের সমীকরণ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। মূর্ত হয়ে ওঠে ইতিহাস, রাষ্ট্রদর্শন ও কবিতাশিল্পের বহু বর্ণিল রূপকময়তা। কামাল চৌধুরীর কবিতাসমূহ পাঠের সময় জীবনানন্দীয় ও লোরকার আত্মকথনের মতো মনে হলেও তাঁকে আলাদাভাবে চেনা যায়। কাব্যশৈলী, অভিজ্ঞতা, জীবনের অনুভূমি ক্রমাগত বিস্তৃত হয়েছে তাঁর কবিতায়। কাব্যভাষার ক্রমপরিশীলন সর্বোপরি অস্তিত্বের সংকট কবির মানসলোকে বাসা বাঁধলেও তিনি প্রজ্ঞাবান। স্বপ্নময় ভুবনের দিকে মানব ও প্রকৃতি প্রেমে মগ্ন হয়ে থাকতে চান কবি। আধুনিক কবিতার রহস্যকে প্রগাঢ়ভাবে স্পর্শ করতে চেয়েছেন তিনি। বোধের আলোয় স্নাত হয়ে পরিকীর্ণ বেদনা পেছনে ফেলে অবিরাম হাঁটতে চেয়েছেন দিগন্তঅবধি। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জানুয়ারি ২০১৭/তারা