‘আহ! তুমি খুব মিষ্টি। আর হয়তো আমি আরো মনোরম, মধুর আর আরো সুচিক্কন আরো আকর্ষণীয় রয়ে যাবো তোমার কাছে আর তুমি আবার আমার প্রেমে পড়বে।’ ‘সর্বনাশ’, আমি বললাম, ‘আমি তোমাকে এখনও যথেষ্ট ভালোবাসি। তুমি আর কী চাও? আমাকে ধ্বংস করতে?’ ‘হ্যাঁ, আমি তোমাকে শেষ করে দিতে চাই।’ ‘বেশ’, আমি বললাম, ‘আমিও তাই চাই।’ - আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস (১৯২৯)
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১) তীব্রভাবেই একজন প্রেমিক ছিলেন। নোবেলজয়ী লেখক, জীবনবাদী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (বেচারা শেষতক আত্মহত্যা করেন) বিশ্বাস করতেন, ‘যখন তুমি প্রেমে পড়ো তখনই সেরা লেখাগুলো আসে।’ হয়তো এ কারণেই হেমিংওয়ে প্রেমে পড়েছেন প্রচুর! তিনি নিজে খুব শক্তপোক্ত, দিলখোলা পুরুষ ছিলেন। লেখালেখির পাশাপাশি মুষ্ঠিযুদ্ধ, সমুদ্রে মাছ ধরা, ষাঁড়ের লড়াইয়ের মতো পুরুষালি বিষয়াদি তাকে আকৃষ্ট করতো। আর হেমিংওয়ে আকৃষ্ট করতেন নারীদের।
হেমিংওয়ের জীবনে প্রেম, বিবাহ তথা নারী সম্পর্কের আধিক্যের অন্যতম একটি কারণ হলো বৈচিত্রময় জীবন। দু’-দু’টো বিশ্বযুদ্ধ, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সাক্ষী ছিলেন তিনি, আর কাটিয়েছেন দীর্ঘ কর্মবহুল জীবন; সেইসঙ্গে ঘুরেছেন প্রচুর দেশ। মাত্র ১৭ বছর বয়সে মার্কিন এই লেখক কানসাস সিটির এক সংবাদপত্রে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি ইতালি চলে যান। আর সেই সময়ই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এ সময় অ্যাম্বুলেন্সের সার্ভিসে যুক্ত হন তিনি। কিন্তু তার দৃষ্টিশক্তি প্রখর না-হওয়ায় তাকে তালিকাভূক্ত করা হয়নি। এটা বিস্ময়কর যে, ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়েই পরে হেমিংওয়ে একের পর এক বিশ্বজয়ী সাহিত্যকর্মগুলো রচনা করেছেন। ইতালিতে যুদ্ধে আহত হলে দু’মাসের মাথায় তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু হেমিংওয়ের যেন পাখা ছিল। এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতেন না। বাড়ি ফেরার কিছুদিন পরেই তিনি আবার ইউরোপ চলে যান যুদ্ধে; প্রতিবেদক হিসেবে।
মার্থা ও হেমিংওয়ে
যুদ্ধে আহত হওয়ার সময় হেমিংওয়ে প্রেমে পড়েন রেড ক্রিসেন্টের সেবিকা এগনেস ভন কুরোস্কির। বলার অপেক্ষা রাখে না, আহত হেমিংওয়েকে তিনিই দেখাশোনা করতেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগেই তারা পরিকল্পনা করেন আমেরিকা গিয়ে বিয়ে করবেন। কিন্তু সেবিকাটি অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলেন। প্রথম প্রেমের এই প্রত্যাখ্যানের বেদনা হেমিংওয়ে নিতে পারেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোনোদিন কোনো নারী যেন আর তাকে প্রত্যাখ্যান করতে না পারে।
বিশ্বের তাবত লেখকদের মধ্যে হেমিংওয়ে ছিলেন সেরা এক প্রেমিক। শুধু প্রেম করেই ক্ষান্ত হননি, বিয়েও করেছেন বারবার। তার দ্বিতীয় স্ত্রী পলিন ফাইফার বলেছিলেন, ‘আর্নেস্ট প্রেমে পরলে আমি কিছু মনে করবো না। কিন্তু প্রত্যেকটা মেয়েকেই কেন তার বিয়ে করতে হবে?’ একটা, দুটো নয়, চারটা বিয়ে করেছিলেন হেমিংওয়ে।
তবে প্রেম-বিবাহ আপাতত যতো রোমান্টিক মনে হোক না কেন, তারও তো দহন আছে। প্রেমেরও যে রয়েছে পোড়ানোর ক্ষমতা, জ্বালানোর ক্ষমতা তা ভূক্তভোগী মাত্রই জানেন। হেমিংওয়েও প্রেমে জ্বলেছেন, পুড়েছেন, তবে প্রেমের পথে খাঁটি সোনা হয়েছেন কিনা তা অবশ্য জানি না। কিন্তু এটুকু জানি যে, সারা জীবন তিনি প্রেম খুঁজেছেন। লেখালেখির স্বার্থেই হোক আর নিজের মনের টানেই হোক, এক নারী থেকে আরেক নারীতে বারবার ছুটে গেছেন হেমিংওয়ে। তার এই ছুটে চলার পথে অন্তত চারটি মাইলফলক হিসেবে চারজন স্ত্রীর কথা বলাই যায়।
এগনেসের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার দু’বছরের মাথায় হেমিংওয়ের সঙ্গে দেখা হয় হ্যাডলি রিচার্ডসনের। তিনি ছিলেন সুরকার। ১৯২০ সালে শিকাগোর এক পার্টিতে নিজের চেয়ে আট বছরের বড় হ্যাডলিকে দেখার পর হেমিংওয়ে তার প্রেমে পড়েন। দ্রুতই বিয়ে করেন তারা। বিয়ের এক বছরের মাথায় তারা প্যারিস চলে যান। হেমিংওয়ে সেখানে বিদেশি সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। লেখক হিসেবেও তেমন নামধাম হয়নি তখন তার। প্যারিসের জীবন ও অভিজ্ঞতা তিনি লেখালেখিতে কাজে লাগান। প্যারিসে দু’বছর থাকার পর তারা আবার টরেন্টো ফিরে আসেন। হেমিংওয়ে এখানে সাংবাদিকতা করেন। এখানেই হ্যাডলির গর্ভে জন্ম নেয় হেমিংওয়ের প্রথম সন্তান জ্যাক। কিন্তু হেমিংওয়ে হাঁপিয়ে ওঠেন আর তারা তিনজন ফিরে যান প্যারিসে।
পলিন ও হেমিংওয়ে
এক বছরের মাথায় প্যারিসেই হেমিংওয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় তরুণী সাংবাদিক পলিন ফাইফ ফাইজারের। পলিনের সঙ্গে হ্যাডলির গাঢ় বন্ধুত্ব হয়। তারা একসঙ্গে পারিবারিক অবকাশও কাটান। কিন্তু এই বন্ধুত্বপূর্ণ পারিবারিক সম্পর্ক অটুট থাকার কোনো কারণই নেই। ছয় বছরের বিবাহিত সম্পর্ক ছেদ করে হেমিংওয়ে এবার বিয়ে করেন পলিনকে। তবে হেমিংওয়ে তার পরবর্তীকালের উপন্যাস ‘আ মুভেবল ফিস্ট’ রচনা করতে গিয়ে রিচার্ডসনের প্রতি প্রেমময় সম্পর্কের শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। প্রকাশ না করেই বা উপায় কী! লেখালেখির অনুপ্রেরণার জন্যই তো এই প্রেম। আর এটা তো মিথ্যা নয়, হেমিংওয়ে হ্যাডলি রিচার্ডসনকে ভালোবেসেছিলেন তীব্রভাবে। উল্লেখ করা দরকার, হেমিংওয়ে শেষপর্যন্ত তার প্রথম শ্বশুর, রিচার্ডসনের বাবার মতোই আত্মহত্যা করেছিলেন।
পলিন আইওয়াতে জন্ম নিলেও প্যারিসের বিখ্যাত পত্রিকা ‘ভোগ’-এর সাংবাদিক ছিলেন। অভিজাত পরিবারের কন্যা ফ্যাশন সচেতন পলিন নিজের কাজেও দক্ষ ছিলেন। হেমিংওয়ের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’-এর পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে তার তীক্ষ্ম মতামত ও পর্যবেক্ষণ হেমিংওয়েকে মুগ্ধ করেছিল। তবে সুন্দরী, বুদ্ধিমতী হলেও পলিন ছিলেন ভীষণ কেরিয়ার সচেতন। সত্যি বলতে, হেমিংওয়ের সঙ্গে রিচার্ডসনের সম্পর্ক ভাঙার ক্ষেত্রে তার ভূমিকাই বেশি ছিল। এমনকি ‘আ মুভিবল ফিস্ট’ স্মৃতিকথায় হেমিংওয়ে স্বয়ং তাকে খল চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পলিন ও হেমিংওয়ের বিয়ে ১৩ বছর স্থায়ী হয় এবং পলিনের গর্ভে হেমিংওয়ের আরো দুই পুত্র প্যাট্রিক ও গ্যাগরির জন্ম হয়।
যেমন করে রিচার্ডসন হ্যাডলির কাছ থেকে হেমিংওয়েকে সরিয়ে নিয়েছিলেন পলিন ফাইফার তেমন করেই পলিন ফাইফারের কাছ থেকে হেমিংওয়েকে সরিয়ে নিয়েছিলেন মার্থা গিলহর্ন। পলিনের মতো মার্থাও ছিলেন সাংবাদিক এবং পেশা সচেতন। মার্থা ছিলেন যুদ্ধ প্রতিবেদক এবং তার ছয় দশকের সাংবাদিক জীবনে বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ সংঘাত আর যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। তিনি ঔপন্যাসিকও ছিলেন। স্বর্ণকেশি মার্থা ছিলেন চৌকস, অভিজাত, বুদ্ধিদীপ্ত, রসিক- এক কথায় খোলা চাবুক। হেমিংওয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়ে ১৯৩৬ সালে এক রেস্তোরাঁয়। হেমিংওয়ে তখন শুধু বিখ্যাত লেখকই নন, বিশ্বের অন্যতম ধনী লেখকও বটে। নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, যুদ্ধ আর ভ্রমণ বিষয়ক কথা দিয়েই তিনি হেমিংওয়েকে মুগ্ধ করেন। মার্থা বন্ধুত্ব করেন পলিনের সঙ্গে এবং দুই সপ্তাহ হেমিংওয়ের বাগানে আসা যাওয়া করেন। এর মধ্যে মার্থা ফিরে যান আমেরিকায় কি ওয়েস্টে।
হেমিংওয়ে ইতোমধ্যে মার্থার প্রেমে হাবুডুবু। তিনিও হাজির হন সেখানে। ‘আমার একলা লাগছে’- এই কথা বলে হোটেলে তিনি নিয়মিত মার্থাকে ডেকে নেন। এ সময় হেমিংওয়ে আর মার্থা একসঙ্গে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহে কাজ করেন আর প্রেম করেন। ১৯৪০-এ পলিনের সঙ্গে হেমিংওয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, এর ১৬ দিন পরই তিনি মার্থাকে বিয়ে করেন। তবে এ বিয়ে খুব বেশি দিন টেকেনি। মজার বিষয় হলো, মার্থার সঙ্গে প্রেমের সময় হেমিংওয়ে একটি চুক্তি করেছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী মার্থাকে প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছিল মার্থা কোনো এসাইনমেন্টে একা যেতে পারবেন না, হেমিংওয়েকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। কারণ সে একা বোধ করে। মার্থা ছিলেন ভীষণ কাজ পাগল। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। কাজেই মার্থা সদাই ব্যস্ত থাকতেন। হেমিংওয়ে একবার বিশেষ মুহূর্তে রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি কি একজন যুদ্ধ প্রতিবেদক নাকি বিছানায় আমার বৌ?’ এমনকি হেমিংওয়ে চেয়েছিলেন মার্থাকে চাকুরিচ্যুত করতে। মার্থা শেষ পর্যন্ত হেমিংওয়েকে নয়, চাকরিই বেছে নিয়েছিলেন।
হ্যাডলি ও হেমিংওয়ে, দুজনের প্রথম প্রেম এবং বিয়ে
১৯৪৫ সালে মার্থার সঙ্গে হেমিংওয়ের বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার আগেই ১৯৪৪ সালে ম্যারি ওয়েলসের সঙ্গে তার পরিচয়। তাদের যখন দেখা হয় তারা দু’জনই বিবাহিত এবং তারা সিদ্ধান্ত নেন দু’জনেই পুরনো সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে আসবেন। হেমিংওয়ের জন্য এটা ছিল চতুর্থ বিবাহ আর ওয়েলসের জন্য তৃতীয়। অন্য সব বিয়ের তুলনায় হেমিংওয়ে আর ওয়েলেসের বিয়েটা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল (পনেরো বছর)। হেমিংওয়ের আত্মহত্যা ওয়েলসকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। সে ভীষণ রকম নেশায় ডুবে যায়। মদ্যপান হয় সঙ্গী। এদিকে হেমিংওয়ের মৃত্যুর পর প্রকাশিত দুই বই ‘আ মুভেবল ফিস্ট’ এবং ‘দ্য গার্ডেন অব ইডেন’ তার তত্ত্বাবধানে এবং স্বত্বাধিকারীতে প্রকাশিত হয়।
১৯৪৬ সালের মার্চে কিউবায় তাদের বিয়ে হয়। তারা প্রায় বারো বছর কিউবায় একসঙ্গে থেকেছেন। হেমিংওয়ে সেখানে এক ইতালিয় তরুণীর প্রেমে পড়েন। সেই প্রেমের সম্পর্কেও টানাপোড়েন শুরু হয়। ১৯৫৯ সালে তারা একত্রে কিউবা ছেড়ে আইডাহোতে বসবাস করতে আসেন। কিন্তু ততোদিনে হেমিংওয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৬০ সালে এমনকি শক থেরাপিও তার কাজে আসেনি। অবশেষে হেমিংওয়ে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন।
নিজেকে হননের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রেম-বিবাহ সংক্রান্ত টানাপোড়েন। ভালোবাসা খুঁজতে থাকা একটা মানুষ শেষতক মৃত্যুর কোলে ঠাঁই নেন। কে জানে তার পরমকাল তাকে পরম প্রার্থনীয় প্রেম দিয়েছে কিনা!