শিল্প ও সাহিত্য

‘জয় বাংলা’ স্লোগান কোনো কবিতা থেকে আসেনি

আজ বাঙালির আত্মপরিচয়জ্ঞাপক স্লোগানে পরিণত হয়েছে ‘জয় বাংলা’। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীজমন্ত্র হিসেবে কাজ করে এই স্লোগান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বিগত শতকের ছয়ের দশকে পরিচালিত বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এই স্লোগান যে গতি ও শক্তি সঞ্চার করে তার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে নেই। কাজী নজরুল ইসলাম ‘নবযুগ’ পত্রিকায় ১৯৪২ সালেই লেখেন ‘বাঙলার জয় হোক’ আর বঙ্গবন্ধু ১৯৭১-এর ৭ মার্চ গগণবিদারী স্লোগান তোলেন ‘জয় বাংলা’। এ যেন চেতনার ক্রমধারাবাহিকতা মাত্র!

তবে একথাও সত্য, একদা বাঙালির ‘প্রকৃতনেতা’র অভাববোধ করেছিলেন নজরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুই কি নজরুলের সেই স্বপ্নপুরুষ, যিনি তাঁর প্রবন্ধ থেকে চয়ন করে ধ্বনি তুললেন ‘জয় বাংলা’ আর বাঙালি দেখল মুক্তির পথ? ‘বাঙালির বাঙলা’ : খুবই ছোটো প্রবন্ধ; মাত্র ৭৫০ শব্দের মতো- কিন্তু অগ্নিগর্ভ একটি রচনা। এই রচনায় নজরুল প্রাজ্ঞ ও দিব্যজ্ঞানীর মতো কিছু বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন এবং দিশা দিয়েছেন স্বাধীনতার। স্বাধীনতা- শুধু ভারতের স্বাধীনতাই নয়, ভারতের অন্তর্ভুক্ত বাংলার স্বাধীনতাও। ১৯৪২ সালে যখন ভারতের স্বাধীনতার জন্যই সবাই ভাবিত, সে সময় বাংলার মুক্তির কথাও ভেবেছিলেন নজরুল। বিস্ফোরক বাক্য দিয়ে প্রবন্ধটি আরম্ভ করেছেন নজরুল। বলেছেন: ‘‘বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে- ‘বাঙালির বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।’’ এখানে তিনি তিনটি কথা বললেন:      ক. বাঙালির ঐক্যবদ্ধ হতে হবে;      খ. একটি সপ্রতিজ্ঞ বীজমন্ত্র নিতে হবে এবং সেটি ‘বাঙালির বাঙলা’;      গ. তারা ‘অসাধ্য’ সাধন করতে পারবে।

এরপরই কিন্তু নজরুল পরিষ্কার করে দেন, কী সেই ‘অসাধ্য’। তিনি বলেন, ‘বাঙালি একাই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে।’ এই বক্তব্যটি কোনো সাধারণ বাক্য বা অতি-আবেগী ভাষ্য নয়। ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে বাংলার যে অবদান তার প্রকৃত ইতিহাস রচিত হয়নি এবং প্রকৃত স্বীকৃতি আজো আসেনি। যদি আসতো তাহলে বাঙালির আসন উঠে যেত আরও উপরে। বাংলা থেকে যেমন ব্রিটিশেরা তাদের শাসনরথ পরিচালনা আরম্ভ করেছিল, এই বাংলাতে তারা প্রতিরোধের মুখেও পড়েছিল সব চেয়ে বেশি। অগ্নিযুগে হাজার হাজার বাঙালি যুবক-যুবতী ব্রিটিশ বিতাড়নের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন। আবার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুসহ বহু নেতার দূরদর্শিতায় ব্রিটিশদের বারবার পড়তে হয়েছে সংকটে। তাই বিপ্লবকেন্দ্র বাংলা থেকে ১৯১১ সালে ব্রিটিশেরা ভারতের রাজধানী নিরুপদ্রব দিল্লিতে স্থানান্তর করে।

এসব পর্যালোচনা করেই নজরুল বলেছিলেন, ভারতকে স্বাধীন করার শক্তি বাঙালির রয়েছে। তবে সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না তাদের কর্মকাণ্ড। তিনি বাঙালির গুণাবলি পর্যালোচনা করে বলেছেন, বাঙালির আছে জ্ঞানশক্তি আর প্রেমশক্তি; তবে কর্মশক্তির অভাব বর্তমান। কর্মশক্তির অভাবহেতু বাঙালির এই দুই শক্তি- জ্ঞানশক্তি ও প্রেমশক্তি সেভাবে কাজ করে না। এই কর্মবিমুখতার কারণে বাঙালি ব্যবসা-বাণিজ্যে পিছিয়ে আছে; আলস্যে নিদ্রাগমন ভালোবাসে; মৃত্যুভয়ে ভীত থাকে। এটিকে নজরুল বলেছেন তামসিকতা বা অন্ধকারাচ্ছন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে সেই জ্ঞানশক্তি ও প্রেমশক্তিকে হারিয়ে ফেলা। এখানে নজরুল দিব্যজ্ঞানীর মতো বাণী উচ্চারণ করেছেন: ‘এই তম, এই তিমির, এই জড়ত্বই অবিদ্যা।’ ‘অবিদ্যা’ কী করে? অবিদ্যা মানুষকে অন্ধকার পথে, ভ্রান্তির পথে নিয়ে যায়, আর তার মধ্যে যে তীব্রশক্তি উৎপন্নের সম্ভাবনা, সেটিকে বিনাশ করে। মানুষের মধ্যে সাধুগুণকে বিঘ্ন ঘটায় এই অবিদ্যা। এতে মনুষত্বের মৃত্যুও ঘটে; অমৃতের সন্ধান পাওয়া যায় না। এই ‘তম’কে- যা কিনা মানুষের ‘অবিদ্যা’র উৎপাদক এবং যে অবিদ্যা থেকে এতো ক্ষতি ঘটে যায়- নজরুল বলেছেন, সেই ‘তম’কে শাসন করতে পারে ‘রজগুণ’।

‘রজগুণ’ কী? ‘রজঃ’ অর্থ যদিও অহংকার কিন্তু এখানে নজরুল ‘রজগুণ’ অর্থে রাজসিক গুণের কথাই বলেছেন এবং তা হলো অধিকার প্রতিষ্ঠা অর্থে। রজগুণের অধিকারীরা নিজেদের রাজ্যাধিকার বিস্তৃত ও প্রতিষ্ঠা করে চলে। এই রজগুণটি বাঙালির খুবই প্রয়োজন বলে নজরুল মনে করেছেন। এই ‘রজগুণ’কে তিনি ‘ক্ষাত্রশক্তি’ বলে উল্লেখ করেন। নজরুল বাঙালির ক্ষাত্রশক্তি জাগরণের কথা বলেছেন বারবার। নজরুল লক্ষ করেছেন, বাঙালির জ্ঞানশক্তি ও প্রেমশক্তি আছে। তাদের মস্তিষ্ক ও হৃদয় অনেক কার্যকর কিন্তু দেহ পাষাণময়। আলস্যের কারণে তারা বিচ্ছিন্ন ও ঘরকুনো। এই পাষাণপ্রতিমাকে সংঘবদ্ধ হয়ে কার্য করণের কথা বলেছেন নজরুল।

নজরুল বাংলাদেশের প্রকৃতিতে থাকা ঐশ্বর্য ও সম্ভাবনার কথাও উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু তাঁর দুঃখ, যে বাঙালি পৃথিবীর অন্যান্য জাতিকে এক সময় সমাদর করেছে, সেই বাঙালি জাতি ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে দীন জাতিতে। বিদেশী দস্যু ও বণিকেরা বাঙালিকে শোষণ করে দিনের পর দিন আর বাঙালি জাতি হীনবল হয়ে ঘরে বসে থাকে- এটি নজরুল মানতে পারছিলেন না। তিনি তাই ক্ষোভমিশ্রিত কণ্ঠে বলেন: ‘বাঙালি সৈনিক হতে পারলো না। ক্ষাত্রশক্তিকে অবহেলা করলো বলে তার এই দুর্গতি তার অভিশপ্তের জীবন।’ বাঙালির মাঠের ধান পাট রবি ফসল তার সোনা তামা লোহা কয়লা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লুট হয়ে যায়। কাজী নজরুল ইসলাম স্পষ্টভাবে বলেছেন, বাঙালির ‘সর্ব ঐশ্বর্য বিদেশী দস্যু বাটপাড়ি করে ডাকাতি করে নিয়ে যায়’ কিন্তু বাঙালি বসে বসে দেখে। এই পর্যবেক্ষণটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখানেই নজরুল শেষ করেননি। তিনি ক্ষোভ নিয়ে লক্ষ করেছেন, বাঙালির এই ঐশ্বর্য লুটেরাদের, দস্যুদের বিরুদ্ধে ‘খবরদার’ বলার ক্ষমতা বাঙালির নেই। অর্থাৎ তিনি চেয়েছেন বাঙালির এমন নেতৃত্ব, যেখান থেকে এই দস্যু ও অপশক্তিকে প্রতিরোধ করার ডাক আসবে, এসব সংহার করার আহ্বান ঘোষিত হবে।

নজরুল তো সর্বাংশে কবি; তিনি তো শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতা নন! তারপরও তিনি আহ্বান জানিয়ে গেছেন: বাঙালিসমাজ, বিশেষ করে তরুণসমাজকে তিনি ডাক দিয়ে গেছেন এই বলে- বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে হবে বাংলাদেশ তাদের; বাংলায় ভিনদেশি ও ভিনজাতি যে শোষণের যন্ত্র নির্মাণ করেছে তা ধ্বংস করতে হবে। সব শেষে তিনি উচ্চারণ করেছেন: ‘বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।’ এখানেই কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ও বাঙালির নেতৃত্ব-জাগরণের প্রত্যাশা করেন ও জয়ধ্বনি ঘোষণা করেন। এর আগে ‘বাংলা’ ও ‘জয়’-এর এমন চমৎকার সাযুজ্য আর দেখা যায়নি।

বলা অসঙ্গত হবে না, নজরুলের কোনো কবিতা থেকে এই স্লোগান আসেনি। অনেকে লিখে থাকেন, তাঁর ভাঙার গান (১৯২৪) কাব্যগ্রন্থের ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান সৃষ্টি করেছেন। একথার সঙ্গে আবেগ আর ‘হালকা-দেখা’ আছে। ‘জয়’ আর ‘বাঙলা’ শব্দ দুটোকে পাশাপাশি দেখেই তাঁরা উল্লসিত হয়েছেন, কবিতাটি গভীরভাবে পাঠ করে এর মর্মে যাননি। যদি যেতেন তাহলে তাঁরা বুঝতে পারতেন-

প্রথমত, ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতার উদ্দিষ্ট-বিষয় দেশ বা বাংলা নয়, ব্যক্তিমানুষ রাজনীতিবিদ পূর্ণচন্দ্রের কারামুক্তি; দ্বিতীয়ত, এই কবিতায় ‘জয় বাংলা’ (যার অর্থ বাংলার জয়) বলে কোনো শব্দবন্ধ বা ধারণা ব্যক্ত হয়নি; কবিতায় উল্লেখ আছে ‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র’ (অর্থাৎ পূর্ণচন্দ্রের জয়, যিনি বাংলার মানুষ); তৃতীয়ত, এই কবিতাটি রচনার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিন বছরের শিশু (বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালে)। পরেও কবিতাটি এমন প্রসিদ্ধ হয়নি যে, মানুষের মুখে মুখে তা ছিল এবং বঙ্গবন্ধু তা মুখস্থ করেছিলেন, যার ধ্বনি-প্রভাবে তিনি রাজনীতিতে নামার এতকাল পরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি সৃষ্টি করেছেন। ফলে, এই কবিতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের প্রসূতি বা এখান থেকেই স্লোগানটির উদ্ভব- এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

নজরুলের সমবয়সী ছিলেন মাদারিপুরে জন্মগ্রহণকারী পূর্ণচন্দ্র দাস (১৮৯৯Ñ১৯৫৬)। তাঁরা দুজনেই তখন বহরমপুরে জেলে অন্তরীণ এবং সেখানেই তাঁদের সখ্যভাব চূড়ান্ত মাত্রা পায়। পূর্ণচন্দ্র বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিপ্লবী রাজনীতি ও বিপ্লবীদের প্রতি নজরুলের আগ্রহ প্রথম থেকেই ছিল গভীর। বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নি-বীণা’ উৎসর্গ করে সে প্রমাণও তিনি রেখেছেন। ১৯২৩-এর ১৫ ডিসেম্বর নজরুলের কারামুক্তি ঘটে। তার অন্তত দুমাস আগে মুক্তি পান পূর্ণচন্দ্র। পূর্ণচন্দ্র মুক্তি পাওয়ার সময় নজরুল জেলে বসে একটি কবিতা লেখেন, যার নাম: ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’। নামেই বোঝা যাচ্ছে, পূর্ণচন্দ্রের ‘পূর্ণ’ কবি ‘অভিনন্দন’ শব্দটির আগে যুক্ত করেছেন। করবেনইবা-না কেন? কবিতার লক্ষ্যই যে ব্যক্তি-পূর্ণচন্দ্র! কবিতাটি যখন ভাঙার গান কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন এর নিচে লেখা হয় এই কথা: ‘মাদারিপুর শান্তি-সেনা-বাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র দাস মহাশয়ের কারামুক্তি-উপলক্ষে রচিত।’

বাক্যটি এখনও রচনাবলি বা কাব্যগ্রন্থে মুদ্রিত আছে। তাহলে? সুস্পষ্ট সময় পাওয়া যায়: বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্রের কারামুক্তি উপলক্ষ্যে ১৯২৩ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে নজরুল কবিতাটি লেখেন, যা ১৯২৪-এ তাঁর ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ পায়। এখানে কবির দেশভাবনা বা বাংলাভাবনা প্রধান নয়, সমবয়সীবিপ্লবী পূর্ণচন্দ্রকে অভিনন্দন জানানোই মুখ্য। এখানে উল্লেখ্য, মহাত্মা গান্ধি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশসহ পছন্দের অনেক ব্যক্তিকে উপলক্ষ্য করেই নজরুল কবিতা লিখেছেন; ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটিও তেমনি।

৫৪ চরণের দীর্ঘ কবিতা ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’।  নজরুল অবশ্য গানের ভঙ্গিতে লিখেছেন এবং শিরোনামের নিচে ‘গান’ কথাটি লিখে দিয়েছেন। প্রতি স্তবক ৬ চরণে, মোট ৯টি স্তবক। এর মধ্যে পঞ্চম স্তবকের তৃতীয় চরণে মাত্র একটিবার আছে: ‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র’। বুঝবার সুবিধের জন্য স্তবকটি নিচে উদ্ধৃত করছি:      ‘ওগো অতীতের আজো-ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি ধূম্র্রশিখ!     না-আসা-দিনের অতিথি তরুণ তব পানে চেয়ে নির্নিমিখ।     জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ,     জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!     স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,     বাঙলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!’

এটি পাঠ করলে বোঝা যায়, এখানে ‘বাংলা’র জয় বোঝানো হয়নি। বাংলার পূর্ণচন্দ্র, ব্যক্তি-পূর্ণচন্দ্রের জয়কে বোঝানো হয়েছে। পরের চরণে ‘যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি’র জয়কে বোঝানো হয়েছে; সেখানেও পূর্ণচন্দ্রই। প্রকৃতপক্ষে কবিতাটি ব্যক্তি-পূর্ণচন্দ্রের মাহাত্ম্যজ্ঞাপক। তাই এর প্রথম চরণ এমন: ‘এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র! এস পূর্ণিমা-পূর্ণচন্দ্র!’ আর শেষ চরণ হলো: ‘বাঙলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!’ অর্থাৎ তুমি পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মিলনের প্রতীক (পদ্মা-ভাগীরথী নদী এখানে দুই বঙ্গের প্রতীক)। এই কবিতায় ব্যক্তি-পূর্ণচন্দ্র ছাড়া আর কোনো বিবেচনা নেই; দেশ বা বাংলার কথা বলা হয়নি। এই নিবন্ধের শেষে সম্পূর্ণ কবিতা তুলে ধরা হলো। কবিতাটি পাঠ করুন এবং মিলিয়ে নিন, এটি একান্তই ব্যক্তি-মাহাত্ম্যজ্ঞাপক কবিতা, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের উৎস এটা নয়।

এবার প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে বাংলার জয়ের কথা নজরুল বলেনইনি (পুরো কবিতার কোথাও দেশ বাংলা বিষয়ে কোনো বক্তব্যই নেই তাঁর) অনেকে সেখানে জোর দিয়ে লিখেছেন, ঐ কবিতা থেকেই নাকি বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এসময় বঙ্গবন্ধুর বয়স ছিল কত? তিন-চার বছর! ১৯২৪ সালে ‘ভাঙার গান’ প্রকাশ পায় মূলত কয়েকটি গান ও কবিতার সমন্বয়ে। এই গ্রন্থের ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’ ও ‘ভিক্ষা দাও ভিক্ষা দাও / ফিরে চাও ওগো পুরবাসী’ ছাড়া আর কোনো গান বা কবিতাই মানুষের মুখে মুখে ফিরবার মতো প্রভাববিস্তারী হয়ে ওঠেনি যে শিশু-বঙ্গবন্ধু যৌবনে পদার্পণের পর সেটি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে তাঁর কানে আসবে। তাই বইয়ের পাতায় থাকা স্বল্প পঠিত ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটি যে বঙ্গবন্ধু আদৌ পাঠ করেছিলেন, সে সন্দেহই বরং বেগবান হয়। প্রিয় পাঠক, আপনি নজরুলের অনেক কবিতাই জানেন এবং শুনেছেন। এই কবিতাটি কি আগে শুনেছেন? শোনেননি, কারণ এটি প্রভাববিস্তারকারী কবিতা হয়ে ওঠেনি।

বরং এটাই সত্য : ১৯৪২ সালে তরুণ বঙ্গবন্ধু কলকাতায় অবস্থান করছেন এবং রাজনীতিতেও তিনি গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তখনই তিনি কলকাতার হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে পর্যন্ত যুক্ত হয়ে গেছেন। লেখাপড়া আর রাজনীতি দুটোই করছেন; কিন্তু সময়টা বেশি দিচ্ছিলেন রাজনীতিতে। এসময়ই একদা মুজফ্ফর আহমদ সংশ্লিষ্ট ‘নবযুগ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘বাঙালির বাঙলা’। ১৯২০ সালে নবযুগ বের হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। কাজী নজরুলের সম্পাদনায় ১৯৪০-এ নবযুগ আবার বের হয় এবং আন্দোলনরত তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই পত্রিকায় নজরুলের প্রবন্ধ ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রকাশ পায় ৩রা বৈশাখ, ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ সংখ্যায়। লেখার শিরোনামটিই অনন্য এবং ১৯৪২ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুবই আগ্রহব্যঞ্জক, বিশেষ করে বাঙালিদের জন্য। নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু সেটি পাঠ করেছেন এবং শুধু তিনি নন, বাঙালি ছাত্রনেতাদের অনেকেই সেটি পড়ে থাকবেন। এই প্রবন্ধের প্রভাবেই বঙ্গবন্ধুর মনে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের ভ্রুণ স্থাপিত হয়েছিল যা পরে তিনি বাঙালির মুক্তির স্লোগান হিসেবে ছড়িয়ে দেন।

কাজী নজরুল ইসলাম ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধটি রচনা করার দশ বছর পরে বাঙালি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পন্ন করে এবং এরপর থেকেই মূলত ভাষাভিত্তিক একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের সংগ্রাম বেগবান হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বীজমন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসে বাংলার স্বাধীনতা- প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আগে থেকেই দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন। ১৯৭২ সালের ১৮ই মার্চ ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় একটি সংবাদ বের হয়, যার শিরোনাম- মণি সিংহ বলেছেন, ‘’৫১ সনে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন’। সেই সংবাদের প্রথমাংশ এখানে উল্লেখ করা হলো: ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতা কমরেড মণি সিংহ বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫১ সালে কারাগারে থাকাকালেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন, চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে তিনি তাঁর পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৩তম জন্মদিবস উপলক্ষে গতকাল (শনিবার) আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সেমিনারে বক্তৃতাদানকালে কমরেড মণি সিংহ বলেন, যদিও আমাদের মতপার্থক্য ছিল তথাপি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কাছে এটা জানতে চেয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামকে তিনি (মণি সিংহ) সমর্থন করবেন কিনা।’

ফলে বলা চলে, যে স্বপ্নের কথা কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সালে বলেছেন, ১৯৫১ সালে সে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুও দেখেছেন এবং তা বিস্তার ও প্রতিষ্ঠায় সমমনাদের সমর্থন চেয়েছেন। সে-সূত্রে বলা যায়, কাজী নজরুলের কল্পপুরুষই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বিদেশীশক্তিকে নজরুলের সেই ‘খবরদার’ বলেছিলেন; তাঁর উচ্চারিত ‘বাঙলার জয় হোক’ বচনেই বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিত করেছিলেন- যে স্লোগান হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের বীজমন্ত্র, স্বাধীনতার প্রথম আনন্দধ্বনি।

সংযোজন:

পূর্ণ-অভিনন্দন [গান]*

এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র! এস পূর্ণিমা-পূর্ণচাঁদ! ভেদ করি’ পুনঃ বন্ধ কারার অন্ধকারের পাষাণ-ফাঁদ! এস অনাগত নব-প্রলয়ের মহা সেনাপতি মহামহিম! এস অক্ষত মোহান্ধ-ধৃতরাষ্ট্র-মুক্ত লৌহ-ভীম!  স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাঙলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!

ছয়বার জয় করি কারা-ব্যূহ, রাজ-রাহু-গ্রাস-মুক্ত চাঁদ! আসিলে চরণে দুলায়ে সাগর নয়-বছরের মুক্ত-বাঁধ। নবগ্রহ ছিঁড়ি ফণী-মনসার মুকুটে তোমার গাঁথিলে হার, উদিলে দশম মহাজ্যোতিষ্ক ভেদিয়া গভীর অন্ধকার! স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাঙলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!

স্বাগত শুদ্ধ রুদ্ধ-প্রতাপ, প্রবুদ্ধ নব মহাবলী! দনুজ-দমন দধীচি-অস্থি, বহ্নিগর্ভ দম্ভোলী! স্বাগত সিংহ-বাহিনী-কুমার! স্বাগত হে দেব-সেনাপতি! অনাগত রণ-কুরুক্ষেত্রে সারথি-পার্থ-মহারথী! স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাঙলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!

নৃশংস রাজ-কংস-বংশে হানিতে তোমরা ধ্বংস-মার এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র, ভাঙিয়া পাষাণ-দৈত্যাগার! এস অশান্তি-অগ্নিকাণ্ডে শান্তিসেনার কাণ্ডারি! নারায়ণী-সেনা-সেনাধিপ, এস প্রতাপের হারা-তরবারী! স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাঙলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!

ওগো অতীতের আজো-ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি ধূম্রশিখ! না-আসা-দিনের অতিথি তরুণ তব পানে চেয়ে নির্নিমিখ। জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ, জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন! স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাঙলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!

স্বর্গ হইতে জননী তোমার পেতেছেন নামি’ মাটির কোল, শ্যামল শস্যে হরিৎ ধান্যে বিছানো তাঁহারই শ্যাম আঁচল। তাঁহারি স্নেহের করুণ গন্ধ নবান্নে ভরি’ উঠিছে ঐ, নদীস্রোত-স্বরে কাঁদিছেন মাতা, ‘কই রে আমার দুলাল কই?’ স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাঙলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!

মোছ আঁখি-জল, এস বীর! আজ খুঁজে নিতে হবে আপন মায়, হারানো মায়ের স্মৃতি-ছাই আছে এই মাটিতেই মিশিয়া, হায়! তেত্রিশ কোটি ছেলের রক্তে মিশেছে মায়ের ভস্ম-শেষ, ইহাদেরই মাঝে কাঁদিছেন মাতা, তাই আমাদের মা স্বদেশ। স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাঙলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!

এস বীর! এস যুগ-সেনাপতি! সেনাদল তব চায় হুকুম, হাঁকিয়ে প্রলয়, কাঁপিছে ধরণী, উদ্গারে গিরি অগ্নি-ধূম। পরাধীন এই তেত্রিশ কোটি বন্দীর আঁখি-জলে হে বীর, বন্দিনী মাতা যাচিছে শক্তি তোমার অভয় তরবারির। স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাঙলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!

গল-শৃঙ্খল টুটেনি আজিও, করিতে পারি না প্রণাম পা’য়, রুদ্ধ কণ্ঠে ফরিয়াদ শুধু গুমরিয়া মরে গুরু ব্যথায়। জননীর যবে মিলিবে আদেশ, মুক্ত সেনানী দিবে হুকুম, শত্রু-খড়্গ-ছিন্ন-মুণ্ড দানিবে ও-পায়ে প্রণাম-চুম। স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর, বাঙলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর! -------------------- * মাদারিপুর শান্তি-সেনা-বাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত পূর্ণদাস মহাশয়ের কারামুক্তি-উপলক্ষ্যে রচিত।

আরো পড়ুন:

* শ্রাবণ রাতের প্রেমিক * নজরুল-নিরূপম * কাজী নজরুল ইসলাম : কবি ও সাংবাদিক * নজরুল : বহুমাত্রিক সাহিত্য প্রতিভা * প্রেমিক নজরুলের প্রেমিকারা * নার্গিসকে লেখা নজরুলের পত্র