নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সংবর্ধনা সভায় ১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বহুকাল পূর্বে আর এক সভায় আমি বাঙালী সমাজের অনাগত অধিনায়কের উদ্দেশে বাণীদূত পাঠিয়েছিলুম। তার বহু বছর পরে আজ আর এক অবকাশে বাংলাদেশের অধিনেতাকে প্রত্যক্ষ বরণ করছি। ... দেশের দুঃখকে তুমি তোমার আপন দুঃখ করেছ, দেশের সার্থক মুক্তি অগ্রসর হয়ে আসছে তোমার চরম পুরস্কার বহন করে। ... দুর্গতির জালে রাষ্ট্র যখন জড়িত হয়, তখনই পীড়িত দেশের অন্তর্বেদনার প্রেরণায় আবির্ভূত হয় দেশের অধিনায়ক।’
বিশ্বকবি যে দেশনায়কের স্বপ্ন দেখেছিলেন নেতাজীর মধ্যে, তা ক্রম প্রসারিত হয়ে দেশনায়কে পরিণত করেছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাঙালির অসমাপ্ত স্বপ্নভাবনা মুজিবে এসে মূর্ত হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের লেখা আর গান তাঁকে লড়াইয়ের পথে উজ্জীবিত করেছে। তিনি রাজনৈতিক লড়াই ও সংগ্রামে বিশ্বকবির গান, কবিতা, লেখাকে সঙ্গী করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান যেমন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন তেমনি বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত একজন মানুষও ছিলেন। ষাটের দশকে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করলে দেশের বিশিষ্টজনেরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এ সময় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে রবীন্দ্রচর্চার প্রয়াস চলে। জগন্নাথ কলেজে [বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়] রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন বাঙালির নেতা মুজিব। রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা শোনার পাশাপাশি তৎকালীন অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন তিনি। খ্যাতনামা দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ সাইদুর রহমান ১৯৪৩ সালে বেকার হোস্টেলের সুপারিটেন্ডেন্ট ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি বিশেষ স্নেহ করতেন।
পাকিস্তান সরকার ও তাদের চিন্তার অনুসারীদের বিরোধীতা সত্ত্বেও বাঙালি পালন করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। এতে দেশে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের ধারা গতিশীল হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের ধারা অধিকতর বেগবান হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণার পর। তাঁর স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ কীভাবে প্রেরণা যুগিয়েছিল এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬৬ সালের ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের ৩ দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে। এই অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি দিয়ে, গানটির প্রতি ছিল তাঁর আলাদা আবেগ।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর সংযোগ ছিল। বাসায় থাকলে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা ছিল তাঁর সঙ্গী। তিনি বিশ্বাস করতেন রবীন্দ্রনাথের সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েই শান্তির পথ অন্বেষণ করা সম্ভব। একইসঙ্গে পরাধীন জাতির সম্মুখে মুক্তির আলোকবর্তিকা জ্বালানো যাবে। এ বিষয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মমিনুল হক খোকার স্মৃতিচারণে পাওয়া যায়, ‘আজ কানে বাজে সেগুনবাগিচার বাসাতে মিঞাভাইর গুনগুনিয়ে সুর ভাঁজা- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে’, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা’, ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’, ‘আমার সোনার বাংলা’ ও আরো নানা রবীন্দ্রসংগীতের পঙ্ক্তি।’
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ থাকে। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন বললেন, ‘রবীন্দ্রসংগীত আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়’। এর প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, ‘ক্ষমতাবলে হয়তো সাময়িকভাবে রেডিও ও টেলিভিশন হইতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার বন্ধ করা যাইতে পারে। কিন্তু গণচিত্ত হইতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুমধুর আবেদনকে কোনো কালেই মুছিয়া ফেলা যাইবে না।’
সংস্কৃতির ওপর এই হামলা রোধ করার জন্য জনগণের কাছেও আবেদন জানায় আওয়ামী লীগ। ১৯৬৭-এর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আইয়ুব শাহীর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বক্তব্য রাখেন বাঙালির মহান নেতা। ১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি ভাষণে তিনি বললেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সে তুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা; যিনি একজন বাঙালী কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখিয়া যিনি বিশ্বকবি হইয়াছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না- আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এই দেশে গীত হইবেই।’
তিনি রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর থেকে সর্বপ্রকার বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে অবিলম্বে রেডিও-টিভিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রবীন্দ্রসংগীত প্রচারেরও দাবি জানান। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের পতন এবং আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তাঁর দাবিকে তাই কর্তৃপক্ষ অগ্রাহ্য করতে পারেনি। বেতার ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছিল খানিকটা হলেও তাঁর প্রস্তাব অনুসরণ করতে।
১৯৬৯-এর ১৬ই ডিসেম্বর বাংলা একাডেমিতে রবীন্দ্রসংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ওই অনুষ্ঠানে বেতার-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। তিনি সে ভাষণে বলেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা ভাষা অসম্পূর্ণ এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাজের মাধ্যমে বাঙালির মাঝে আশা জাগিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জনসভা করেন বঙ্গবন্ধু। রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। ৩০০ ফুট দীর্ঘ এক সুবৃহৎ নৌকার অবয়বে তৈরি হয়েছিল মঞ্চ। এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা শপথ নিলেন ৬ দফা বাস্তবায়নই তাদের লক্ষ্য। এ থেকে তারা বিচ্যুত হবেন না।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরেন বাঙালির অবিসংবাদিত নায়ক। ভারতীয় দূতাবাসের নির্দেশে কূটনৈতিক অফিসার শশাঙ্ক এস ব্যাণার্জি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। তাঁর স্মৃতিচারণে জানা যায়, বিমানে বসে বঙ্গবন্ধু ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইতে শুরু করেন। এ সময় তাঁর চোখে জল দেখেন ভারতীয় কূটনৈতিক। গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করা উচিত বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি মিস্টার ব্যাণার্জিকে গানটি গাওয়ার অনুরোধ করেন। তাঁর ভাবনায় ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন আর নতুন রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীতও তিনি অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন ‘সংস্কৃতির চড়াই-উৎরাই’ প্রবন্ধে লিখেছেন:
পাঠে মগ্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আলোকচিত্র: জহুরুল হক
‘ছাপ্পান্ন সালের কথা। ঢাকাতে কোনো সরকারী বৈঠকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কিছু প্রতিনিধি এসেছিলেন। তাদের জন্যে কার্জন হলে আয়োজিত সংস্কৃতি সন্ধ্যায় আমি গান গাইবার জন্যে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। হঠাৎ একজন এসে খবর দিল, ‘আমার সোনার বাংলা গাইতে হবে, শেখ মুজিবুর রহমান এই গান খানি পশ্চিম পাকিস্তানের ডেলিগেটদের শোনাতে চান।’ ...কোনোমতে গানখানি গাওয়া হয়েছিল। তখন বুঝিনি, আজ বুঝি এটি কোনো বিছিন্ন ঘটনা ছিল না। সুপরিকল্পিতভাবেই এই গানখানি গাওয়ানো হয় সেদিন।’
রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্থ ছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার পঙ্ক্তি ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী,/রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি’ তিনি উচ্চারণ করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেয়ার সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেছেন। ‘নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি’ এবং ‘নাগিনীরা দিকে দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস’ তাঁর কণ্ঠে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথে স্নাত, তাঁর ভাবনা ও কর্মে সকল সময়েই বিশ্বকবি পাশে ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে দুঃখ-দৈন্য-সংকটে আবৃত্তি করতেন ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা’ কিংবা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ বহুল পরিচিত চরণসমূহ। জেলে যাওয়ার সময় তিনি ‘সঞ্চয়িতা’ হাতে তুলে নিতেন। বঙ্গবন্ধুর পাঠাভ্যাসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর গান, কবিতা, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ নিয়ে।
এ বিষয়ে তাঁর বড় কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে রচনা করেন, ‘১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানায় বই বেশিরভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন কিন্তু আমার মার অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনও দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলী, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নাড শ’র কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল। ...মা এই কয়টা বই খুব যত্ন করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলি এনেছেন কিনা। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মার সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বই কেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল। প্রচুর বই ছিল। সেই বইগুলি ওরা নষ্ট করে। বইয়ের প্রতি ওদের আক্রোশও কম না। আমার খুবই কষ্ট হয় ঐ বইগুলির জন্য যা ঐতিহাসিক দলিল হয়ে ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে সবই হারালাম।’
১৯৭২ সালের ৮ মে রবীন্দ্রজন্মবার্ষিকীতে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু সত্য, শ্রেয়, ন্যায় ও স্বাজাত্যের যে চেতনা বাঙালি কবিগুরুর কাছ থেকে লাভ করেছেন, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে তারও অবদান অনেকখানি। বাঙালির সংগ্রাম আজ সার্থক হয়েছে। বাঙালির রবীন্দ্র-সম্মাননার চেয়ে বড় কোনো দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই।’
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি গভীর মনোযোগসহকারে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে সকালের নাশতা সারতেন। এক স্মৃতিচারণে মাহবুব তালুকদার টুঙ্গিপাড়ার সফরসঙ্গী হিসেবে সকালে ঘুম থেকে উঠে বঙ্গবন্ধুকে নৌযানে বসে নদীর দুই পাড়ের গ্রামবাংলার দৃশ্য দেখে আবৃত্তি করতে শুনেছিলেন, ‘নম নম নম সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি/গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।’
১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলেন একাডেমির কর্মকর্তাবৃন্দ। তিনি তাঁদের বলেছিলেন, ‘আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি, ভালোবাসি তাঁকে- সাহিত্যে আমার পুঁজি তো ওইটুকুই।’ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এমনি লীন ছিলেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন তাঁর জীবন ও কর্মে। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালের মার্চে সাংবাদিক ও ছড়াকার অমিতাভ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এখানে বাঙালি জাতির জনক বলেছিলেন, ‘আমার রবীন্দ্র-প্রীতি ছোটবেলা থেকেই। মনে আছে, আমি তখন স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়ি। হঠাৎ একটি সাধারণ কবিতার অতি সাধারণ দুটি লাইন আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!’ গ্রামের ছেলে আমি, সাদামাটা লোক। মনে হলো, এত সাদামাটা কথায় বাস্তুহারা এক দুঃখী মানুষের কথা তো আর কেউ লেখেননি। আমি সেই প্রথম মানুষকে ভালোবাসতে শিখলাম। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের ওই যে লেখা ‘নমঃ নমঃ নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি/গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি’ পড়ার পরই আমি দেশকে ভালোবাসতে শিখলাম। রবীন্দ্রনাথকে আমি ভালোবাসি তাঁর মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের জন্য। তারপর বড় হয়ে পড়লাম ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ।’ আমাদের দেশের দুর্ভাগা মানুষের প্রতি এত দরদ আর কার আছে?’
সিলেটে জন্ম অমিতাভ চৌধুরীর। বাঙালির নেতার জন্য তিনি কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছেন রবীন্দ্র গ্রন্থাবলি- অখণ্ড গীতবিতান, সঞ্চয়িতা এবং সমগ্র রচনাবলি। উপহার পেয়ে মুগ্ধ নেতা বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের এই চোখ দুটিতে কী আছে বলুন তো? দেখুন, দেখুন চেয়ে দেখুন, চোখ দুটিতে জ্বলজ্বল করছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা। এ জন্যই তো তাঁকে আমি এত ভালোবাসি। আর এই ‘সঞ্চয়িতা’ সঙ্গে থাকলে আমি আর কিছুই চাই না। নাটক নয়, উপন্যাস নয়, কবিগুরুর কবিতাই আমার সব সময়ের সঙ্গী ছিল। কবিতার পর কবিতা পড়তাম আর মুখস্থ করতাম। এখনও ভুলে যাইনি। এই প্রথম মিয়াঁওয়ালি জেলের ক’মাস ‘সঞ্চয়িতা’ সঙ্গে ছিল না। বড় কষ্ট পেয়েছি। জানেন তো, আমার একটি প্রিয় গানকেই ‘আমার সোনার বাংলা’ আমি স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত করেছি। আর হ্যাঁ, আমার আর একটি প্রিয় গান ডিএল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা।’ দুটো গানই আমি গুনগুন করে গেয়ে থাকি।’
একই সময় বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, ‘আব্বা, মনে আছে তোমার, একটা বই- রবীন্দ্রনাথের- তাতে সব জেলের ছাপ ছিল?’ ‘সঞ্চয়িতা’র পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মুখ না তুলেই মুজিব তাঁর কন্যাকে বললেন, ‘মনে থাকবে না, ও বইখানা তো ওরা পোড়ায় দিছে।’