পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, পিতা সুকুমার রায় ও মাতা সুপ্রভা রায়ের মতো সত্যজিৎ রায়-ও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ ভক্ত। রবীন্দ্রনাথের প্রতি আজীবন শ্রদ্ধাবনত ছিলেন সত্যজিৎ।
বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে মাত্র দুই বছরের ছোট। সুকুমার রায় বয়সে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক ছোট হলেও তাঁর বিখ্যাত ছড়া ও রসবোধ দিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিলেন, এবং শান্তিনিকেতন ও কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ-সুকুমার একসঙ্গে বহু সভাসমিতি জলসায় অংশগ্রহণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ সুকুমারের গীতিকবিতায় সুরারোপ করেছেন। ওদিকে সুকুমার রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সত্যজিতের যোগাযোগের সময়, সত্যজিৎ ছিলেন নেহায়েতই বালক। কিন্তু সারাজীবন সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সমাজসেবার অসীম গুণগ্রাহী ছিলেন।
দশ বছর বয়সে একবার মায়ের সঙ্গে সত্যজিতের শান্তিনিকেতন যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সঙ্গে নিয়ে আসা সদ্য কেনা অটোগ্রাফ খাতায় লাজুক সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথকে কিছু লিখে দিতে অনুরোধ করলে তিনি বালক সত্যজিৎকে খাতাখানা পরদিন পর্যন্ত তাঁর কাছে রেখে যেতে বলেছিলেন। সেই অটোগ্রাফ খাতাতে পরদিন সত্যজিৎ পরম বিস্ময়ে আবিষ্কার করেন রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লিখিত দুর্লভ স্বদেশ ভাবনার সেই অমর কবিতাখানি- ‘বহু দিন ধ'রে বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ৭ই পৌষ, ১৩৩১, শান্তিনিকেতন
বাবা সুকুমার রায় বেঁচে থাকতে তো বটেই, তিনি মারা যাবার পরেও মায়ের সঙ্গে সত্যজিৎ মাঝেমধ্যে শান্তিনিকেতনে বা বিভিন্ন রবীন্দ্রসংগীতের আসরে যেতেন। সেইসব আসরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো। সত্যজিতের মা সুপ্রভা রায় (দাশ) ও মাসি কনক দাশ খুব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন এবং রবীন্দ্রনাথ এই দুই শিল্পীর গান খুব পছন্দ করতেন। সুপ্রভাকে রবীন্দ্রনাথ নিজে গান শেখাতেন সুযোগ পেলেই। দেখা হলেই মা সুপ্রভাকে জিজ্ঞেস করতেন রবীন্দ্রনাথ- কবে সত্যজিৎকে শান্তিনিকেতনে ভর্তি করাচ্ছে মা। মায়ের একান্ত ইচ্ছের কাছে হার মেনে অবশেষে সত্যজিৎ ১৯৪০ সালে ১৩ জুলাই শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভর্তি হন। সেটা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন আগের কথা।
শান্তিনিকেতনের প্রথম দিন সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কবি তখন নতুন তৈরি 'উদীচী'তে বসে তাঁর মাটির মূর্তি গড়ার জন্যে সিটিং দিচ্ছিলেন দুই পা চাদরে ঢেকে একটি টুলের ওপরে রেখে। আর তিনি নিজে একটি আরাম কেদারায় ঠেস দিয়ে বসে। ভাস্কর সামনে বসে কাজ করছিলেন। সত্যজিৎ বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি যে শেষপর্যন্ত শান্তিনিকেতনে ভর্তি হয়েছেন এজন্য গুরুদেব খুবই খুশি হয়েছেন, কিন্তু ভাস্কর্যের জন্যে পোজ দেবার কারণে তিনি তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারছেন না। অনড় হয়ে বসে থাকতে হয়েছিল তাঁকে।
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর যে বিশিষ্ট ব্যক্তিদ্বয়ের স্নেহ সত্যজিৎ সারাজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন তারা হচ্ছেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। শান্তিনিকেতন থেকে দুটো জিনিস তিনি শিখেছিলেন- ছবি আঁকা এবং প্রকৃতি চেনা। ফলে ভালো লাগুক না-লাগুক, শান্তিনিকেতনেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর ভবিষ্যতের ঠিকানা। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘The place had opened windows for me. It had brought to me an awareness of our tradition which I knew would serve as a foundation for any branch of art that I wished to pursue.'
চার বছরের জায়গায় আড়াই বছর শান্তিনিকেতনে চিত্রকলার শিক্ষাগ্রহণ করে অধ্যক্ষ নন্দলাল বসুর অনুমতি নিয়ে কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হওয়ার বাসনায় তিনি কলকাতা ফিরে আসেন। আজীবন স্মরণ করার মতো কিছু ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এখানে সাক্ষাত হলেও শান্তিনিকেতনের ঋজু নিয়মকানুন ও ভাবধারা সত্যজিতের মনের মতো ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর রচনার প্রতি সত্যজিৎ কতখানি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তার প্রমাণ, রবীন্দ্রনাথের ওপর সত্যজিৎ একটি তথ্যচিত্র 'রবীন্দ্রনাথ' (১৯৬১) ও রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পকে ভিত্তি করে তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘তিনকন্যা’ (১৯৬১), ‘চারুলতা’ ( ১৯৬৪) এবং ‘ঘরে-বাইরে’ (১৯৮৪) নির্মাণ করেছেন। সত্যজিতের জীবনের অন্যতম শেষ রচনাও রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই লেখা, যেখানে রবীন্দ্রনাথের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা বর্ষিত হয়েছে।
তিনি স্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর জীবনে প্রথম আত্মিক বন্ধন রবীন্দ্রসংগীতের মাধ্যমেই রচিত হয়েছে। সত্যজিৎ যখন খুব ছোট, তাঁর মা তাঁকে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে ঘুম পাড়াতেন। ফলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রাথমিক যোগাযোগের মাধ্যম তাঁর গান। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলো, সত্যজিতের মতে বিশ্বের সেরা গল্পের অন্তর্ভুক্ত। যে তিনটা ফিচার ফিল্ম বানিয়েছেন সত্যজিৎ রবীন্দ্র রচনা থেকে, তার প্রথমটি রবীন্দ্রনাথ রচিত তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ছোটগল্পের (পোস্টমাস্টার, মণিহার ও সমাপ্তি) চিত্রায়ণ। দ্বিতীয়টিও (চারুলতা) একটি ছোটগল্পের (নষ্টনীড়) চিত্ররূপ। তবে ছোটগল্প 'নষ্টনীড়'-এর চাইতে সত্যজিতের ছায়াছবি 'চারুলতা'র গাঁথুনি (স্বীকার করে নিয়েই যে এ দু'টি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার কলা এবং সময়ের বিচারেও চলচ্চিত্রটি ধারণ করা হয়েছে গল্পরচনার সময়ের অনেক পরে) অনেক বেশি অটুট, গল্পের মোড় পরিবর্তন ও সংলাপে চলচ্চিত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমিতি বোধের পরিচয় পাওয়া গেছে। গল্পের তুলনায় চলচ্চিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি আরো আধুনিক, বাস্তব, সংহত ও নাগরিক মনে হয়েছে। সম্পর্কের দোলাচলও ছিল বহুমাত্রিক এবং অপেক্ষাকৃত বেশি প্রচ্ছন্ন ও জটিলতর মনস্তাত্বিক আখ্যান পরিবেশিত হয়েছে চলচ্চিত্রে।
তাঁর তৃতীয় ছায়াছবিটি তিনি তৈরি করেছেন রবীন্দ্রনাথের ওই নামেরই একটি উপন্যাস (ঘরে বাইরে) অবলম্বনে। ‘নষ্টনীড়’ ছায়াছবিতে বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত 'ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে', 'আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’ এবং 'ঘরে বাইরে' চলচ্চিত্রে 'বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান' গানের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহারের কথা প্রায় সকলেরই মনে দাগ কেটে আছে। চারদিকে এতো স্বনামধন্য ও প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী থাকা সত্বেও বাংলা ও হিন্দি গানের সম্রাট কিশোরকুমারের ভরাট গলায় এসব ছায়াছবির প্লেব্যাক সংগীত পরিবেশনও ছিল অভিনব ও উপভোগ্য।
সত্যজিৎ রায়ের মতো তাঁর স্ত্রী বিজয়াও রবীন্দ্রনাথের অতি স্নেহের পাত্রী ছিলেন। সত্যজিতের সঙ্গে বিবাহের অনেক আগে থেকেই বিজয়াকে জানতেন রবীন্দ্রনাথ। বিজয়া একজন উঁচু মাপের সংগীতশিল্পী ও অভিনেত্রী ছিলেন। বাংলা গান ছাড়াও পিয়ানো বাজানো ও পশ্চিমী ধ্রূপদ সংগীতে তিনি যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে ৮ বছর বয়সে রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন বিজয়া যার জন্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নৃত্যনাট্যে ‘বর্ষামঙ্গল’–এ বিজয়াকে নিয়েছিলেন। একবার ডেনমার্কের যুবরাজ ভারত এলে রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে বিজয়া দু’খানি রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শুনিয়ে সকলকে অভিভূত করে দেন। বিজয়ার বয়স ছিল তখন মাত্র আট। যুবরাজের সম্মানে গাওয়া বিজয়ার গানের সঙ্গে এস্রাজ বাজিয়েছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যে গান দুটো বিজয়া গেয়েছিলেন সেদিন তা হলো- নীলাঞ্জন ছায়া ও বন্ধু রহো রহো। বিজয়ার পিতা চারুচন্দ্র দাশের খুব শখ ছিল কন্যাকে প্যারিস কন্সারভেটরিতে রেখে বিখ্যাত সংগীতশিল্পী বানাবেন। কিন্তু অল্প বয়সে সুদীর্ঘকালের প্রবাসী ব্যারিস্টার পিতা চারুচন্দ্রের অকালমৃত্যু হওয়ায় সে আশা পূর্ণ হয়নি।
সংগীত ছাড়া অভিনয়েও দক্ষতার পরিচয় দেন বিজয়া। দুটি বাংলা ছায়াছবি (১৯৪৪ সালে), ‘সন্ধ্যা’ ও ‘শেষরক্ষা’ (শেষরক্ষা রবীন্দ্রনাথের রম্যনাটকের চলচ্চিত্র রূপ) এবং দু’টি হিন্দি ছায়াছবিতেও নায়িকার ভূমিকায় প্রথিতযশা অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয় করেন বিজয়া। দুটো ছবিতে গানও করেন তিনি। ‘সন্ধ্যা’ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন হিমাংশু দত্ত। সেই ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গান করেন বিজয়া। রবীন্দ্রসংগীত ছাড়াও তাঁর অতুলপ্রসাদের গানের রেকর্ড আছে। ‘শেষরক্ষা’ ছবিতে বিজয়ার গাওয়া দু’টি রবীন্দ্রসংগীত ছিল- ‘মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো’ ও ‘স্বপ্নে আমার মনে হলো’।
ফলে দেখা যায়, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক উভয় পরিমণ্ডলেই রবীন্দ্রনাথ দিয়ে ছায়াচ্ছিদিত ছিলেন সত্যজিৎ। সত্যজিতের সৃজনশীলতা বিকাশে, তাঁর জীবনে, আদর্শে ও স্বপ্নে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান ছিল অনেক উঁচুতে। রবীন্দ্রনাথ সার্বিকভাবে এক উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন সত্যজিৎ রায়ের কর্মজীবনের প্রতি পদক্ষেপে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সত্যজিৎ সবসময় একজন আদর্শ ব্যক্তি ও অসামান্য প্রতিভা, এবং একজন অনুকরণীয় মহাপ্রাণ হিসেবে অন্তরে ধারণ করেছেন।