মূলত চলচ্চিত্রকার হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের খ্যাতি গড়ে উঠলেও শিল্প-সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তাঁর দক্ষতা ও সাবলীল বিচরণ ছিল ঈর্ষণীয়। চলচ্চিত্র এমনই এক প্রকাশ মাধ্যম যা অভিনয় ছাড়াও সাহিত্য, সংগীত, নৃত্যকলা, চিত্রকলাসহ শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমকে অন্তর্ভুক্ত করে। আরো প্রয়োজন পড়ে উচ্চ প্রযুক্তিজ্ঞানের। এ সব কিছুর সার্থক সম্মিলনেই নির্মিত হয় একটি সফল চলচ্চিত্র।
বিশ্বের বড় বড় চলচ্চিত্র পরিচালকের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের মৌলিক পার্থক্য হলো, তিনি একাই অনেকগুলো মাধ্যমের কাজ মুন্সিয়ানার সঙ্গে করে গেছেন। চারুকলার শিক্ষার্থী হিসেবে অধীত বিদ্যাকে প্রকাশনাসহ চলচ্চিত্রের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেছেন। চিত্রনাট্যের দৃশ্য বিভাজন, ক্যামেরার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ সত্যজিৎ রায় শুটিং-এর আগেই স্কেচ করে রাখতেন। বই, পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ কাজের বাইরে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনায় স্কেচের মাধ্যমে দৃশ্য চিত্রায়নের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। কিন্তু এই বিষয়টি চিত্র সমালোচকরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি বলে তাঁর আক্ষেপ ছিল।
করুণা শংকর রায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন: ‘এমন কোনো লেখা আমি পড়িনি যেটা দেখে বোঝা যায় যে ফিল্মের কতগুলো বিশেষ দিক আছে সেগুলোকে তাদের মনে একটা স্পন্দন, একটা রিয়্যাকশন-এর সৃষ্টি করেছে, যা থেকে তারা ওই দিকগুলো বিচার করবে— একটা চিত্রনাট্যকে কীভাবে ভাগ করা হয়েছে, তার ছন্দ তার ফর্ম— অর্থাৎ যেসব গুণের এর ফলে একটা ছবি সিনেমা হয়।’
ঠিক একইভাবে চলচ্চিত্রে সংগীত নিয়েও তাঁর ভীষণ অতৃপ্তি ছিল। আর সেই অতৃপ্তি থেকেই তিনি নিজের ছবির আবহসংগীত এবং পরবর্তীতে গান রচনার কাজটি করেছিলেন। আর বলতে দ্বিধা নাই যে সেই কাজে তাঁর পারদর্শিতা তাঁর অন্যান্য সৃষ্টিশীলতার মতোই সফল হয়েছিল। এক্ষেত্রে তিনি নিজেই ছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী।
১৯৮৪ সালে উৎপলেন্দু চক্রবর্তী কর্তৃক নির্মিত The Music of Satyajit Ray তথ্যচিত্রে তিনি নিজেই জানাচ্ছেন যে একটি সংগীত পরিবারে তাঁর জন্ম। দাদু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন একজন সংগীতস্রষ্টা। তিনি বেহালা, বাঁশি, মৃদঙ্গ ও করতাল— এই চারটি যন্ত্র খুব দক্ষতার সঙ্গে বাজাতে পারতেন। তাছাড়াও পিয়ানো বাজাতেন এবং পিয়ানো বাজিয়ে নতুন গানের সুর তুলতেন। তাঁর মায়ের ঠাকুর দাদা কালি নারায়ণ গুপ্ত ছিলেন বিখ্যাত সংগীতস্রষ্টা। আর মাতৃকুলের প্রায় সবাই ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত গাইয়ে। সত্যজিৎ রায়ের দিদিমা ও তাঁর সকল বোন গাইতে পারতেন। মা, মাসি, মামারাও গান গাইতেন। আর তাই সংগীতের ভেতরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। রবীন্দ্র সংগীত ও ব্রহ্মসংগীত ছিল প্রতিদিনকার চর্চার বিষয়।
খুব ছোটবেলায় তাঁর পাশ্চাত্য সংগীতের হাতেখড়ি। বাড়িতে একটি গ্রামোফোন ছিল। জন্মদিনের উপহার হিসেবে পাওয়া ধ্রুপদী সংগীতের রেকর্ডগুলো তিনি বাজিয়ে শুনতেন। যখন তাঁর বয়স ১৪ বছর তখন বাংলার সাথে সাথে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রতি দুনির্বার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। তাঁর এক বন্ধুর প্রচুর পাশ্চাত্য সংগীতের রেকর্ড ছিল। তাঁর বাড়িতেই তিনি বাখ, বেটোফেন ও মোৎসার্ট শুনতেন এবং পাশ্চাত্য সংগীতের উপর পড়াশোনা করতেন। অন্যান্য বন্ধুরা যখন কবিতা লেখার চেষ্টা করত, তখন তিনি কীভাবে সুর সৃষ্টি করতে হয় সেই প্রচেষ্টায় মেতে থাকতেন। ওই বয়সেই তিনি সুর সৃষ্টির অনেক কলাকৌশল রপ্ত করেছিলেন। কিন্তু ছবি নির্মাণের শুরুতেই তিনি সংগীতের দায়িত্ব নিজে নিতে পারেননি। তিনি আস্থা রেখেছিলেন পণ্ডিত রবি শঙ্করের উপর। তার কিছু কারণও ছিল। চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনার জন্য যে চলচ্চিত্র বোধের প্রয়োজন, তা তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন রবি শঙ্করের মাঝে। রবি শঙ্করের মধ্যেই ‘ধরতি কে লাল’, ‘নিচানগর’ ইত্যাদি ছবির সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আরও করেছেন ‘Discovery of India’র মতো সৃজনশীল কাজ। ফলে তাঁর ওপর সত্যজিৎ আস্থা রেখেছিলেন এবং রবি শঙ্করও সফল প্রতিদান দিয়েছিলেন।
অন্ধকারের মধ্যে পাখোয়াজের বোলের সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’র নামপত্র প্রদর্শন, পুকুরের মলিন জলে জলজ পাতার ফাঁকে নৃত্যরত গঙ্গাফড়িং-এর সঙ্গে ‘রূপক’ তালে সেতারে গৌড় সারং, মান্ড ও বিলাবল রাগের ধুন, মেঘলা আকাশের নিচে দুর্গার মুখে কুমারীব্রতের ছড়ার সঙ্গে পাখোয়াজের দ্রিম দ্রিম বোল, সেইসঙ্গে প্রথমে সুরমণ্ডল পরে সেতারে ‘দেশ’ রাগের মুর্ছনা, দুর্গার মৃত্যু-পরবর্তী শূন্যতা বোঝাতে সেতারে রাগ ‘মারওয়া’র গম্ভীর আলাপ, দুর্গার জন্য হরিহরের কিনে আনা শাড়িটি দাঁতে চেপে ধরে সর্বজয়ার কান্নার দমকের সাথে সানাইয়ে বেজে ওঠে রাগ ‘পটদীপ’ ইত্যাদি রবি শঙ্করের গভীর সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ‘জলসাঘর’ ছায়াছবিতে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব দেন ওস্তাদ বেলায়েত হোসেন খাঁকে আর ‘দেবী’ ছবিতে তিনি কাজ করেন ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ-এর সঙ্গে। কিন্তু পরবর্তীকালে এঁদের সঙ্গে তাঁর কাজ করা হয়ে ওঠেনি। কারণ তাঁরা ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সঙ্গীতজ্ঞ। সত্যজিৎ রায়-এর প্রয়োজনের সময় ব্যস্ততার কারণে তাঁরা আর সময় দিতে পারছিলেন না। ফলে ১৯৬০ সালে ‘তিন কন্যা’ নির্মাণের সময় তিনি নিজেই সংগীত পরিচালনার কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
এর দু'বছর পর তিনি নির্মাণ করেন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। এই ছবিতে তিনি প্রাকৃতিক শব্দ ও বিশেষ করে নিস্তব্ধতাকে ভিন্ন ব্যঞ্জনায় ব্যবহার করেছিলেন। এই বিষয়টি ভারতীয় চলচ্চিত্রে বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত যা সত্যজিতের ভাবনাজাত। আবার ছোট্ট বালকের কণ্ঠে নেপালি গান ‘সিন্দা সিন্দা সিন্দারা…ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি আবহ নির্মাণ করেছেন। আর এর ভেতর দিয়ে তাঁর উচ্চমার্গীয় সাংগীতিক ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
চলচ্চিত্রের প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভবের আগেই সত্যজিৎ রায় সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সংগীতের প্রতি ভালোবাসা থেকেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের খুঁটিনাটি নিয়ে তিনি ব্যাপক কাজ করছেন। কে জানে চলচ্চিত্র তৈরি না করলে তিনি হয়তো ভালো সংগীত পরিচালক হতেন! তিনি মনে করতেন, একজন ভালো চলচ্চিত্র পরিচালকের অবশ্যই জ্ঞান থাকা দরকার তাঁর ছবির কোন দৃশ্যে কোন ধরনের সংগীত ব্যবহৃত হবে। আর তাই তিনি পেশাগত সংগীত পরিচালকের শরণাপন্ন হন। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল ব্যতিক্রম। সংগীতে বিশেষ পারদর্শিতা থাকায় তিনি আগে থেকেই ঠিক করে নিতেন তাঁর ছবির কোন দৃশ্যে কোন ধরনের সংগীত ব্যবহার করা প্রয়োজন। ছবির সংগীতে তিনি তাঁর সুনির্দিষ্ট ভাবনার প্রয়োগ ঘটাতেন।
ছবিতে আবহ সংগীতের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর চলচ্চিত্র পরিচালকরা কিছু গৎবাঁধা নিয়মে আবহ সংগীত নির্মাণ করতেন যা সত্যজিৎ রায়ের একদমই পছন্দ ছিল না। ত্রিশের দশকের শেষ দিকে এবং চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে পরিচালকরা ছবিতে সংগীত ব্যবহারের একটা বিশেষ প্রথা নির্মাণ করেন। সুখ, দুঃখ-বেদনা, উদ্বেগ-উত্তেজনা, আবেগ ইত্যাদি প্রকাশের একটি বিশেষ সূত্র তৈরি করেন আর অলস সংগীত পরিচালকরা দিনের পর দিন সেই সূত্র অনুসরণ করে চলেন। তারা খুব আগ্রহ ভরে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রতি মনোনিবেশ করেন না। তিনি এই জরাজীর্ণ প্রথা থেকে বের হয়ে এসে স্বকীয়তা নির্মাণের লক্ষ্যে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। তিনি বলেছেন, সংগীতকে কতটা নিখুঁত করে ব্যবহার করা যায় সবসময় তিনি সেই চেষ্টা করে এসেছেন। এক পর্যায়ে তিনি গান লেখার কাজটিতে হাত দিলেন।
সত্যজিৎ প্রথম গান লিখেছিলেন ‘দেবী’ ছবিতে। রামপ্রসাদীর সুরে গানটির কথা ছিল: ‘মা মা বলে আর ডাকবো না/দিয়েছো দিয়েছো কতই যতনা।’ কিন্তু ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে তিনি প্রথম নিজের লেখা গানে সুরারোপ করেন। নমিতা ঘোষালের কণ্ঠে গীত গানটিতে মৃদু বিদ্রূপ লক্ষ্য করা যায়: ‘ভালোবাসার তুমি কি জানো/ পায়ের উপর পা টি তুলে/ হিসাবের খাতা খুলে/ বসে রও আপন ভুলে/ যত বলি ঢের হয়েছে/ মানা না মানো।’ এরপর যখন তিনি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্প গুপী গাইন নিয়ে ছবি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন তখন তাঁর সামনে আরো গান লেখার সুযোগ এসে গেল। এই ছবিতে তিনি অনেকগুলি গান লেখেন। ছবির চিত্রায়নের আগেই তিনি চিত্রনাট্যের কথা মাথায় রেখে কয়েকটি গান লিখে সুর করেছিলেন। নিজের বিবেচনায় সেগুলো সন্তোষজনক হওয়ায় তিনি গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজেই কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে তাঁর লেখা গানগুলো হলো: দেখো রে নয়ন মেলে জগতের বাহার/ দিনের আলোয় কাটে অন্ধকার/ কী বাহার!; এক যে ছিল রাজা তার ভারী দুখ; ভূতের রাজা দিল বর/ জবর তিন বর, এক দুই তিন; মহারাজা তোমারে সেলাম/ মোরা বাংলাদেশের থেকে এলাম; ওরে বাবা দেখো চেয়ে কত সেনা চলেছে সবলে/ কত সেনা কত সেনা হাজারে হাজারে/ হাতিয়ারে কাটাকাটি বুঝি করে; আছো হেথা যত আমীর ওমরা/ গাইছ না কেন আমীর ওমরা/ আর যত ব্যাটা হোমরা-চোমরা; ও মন্ত্রী মশাই ষড়যন্ত্রী মশাই/ থেমে থাক; ওরে বাঘারে ওরে গুপীরে/ এবার ভেগে পড়ি চুপি চুপিরে।
গীতিকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশের সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে আমরা তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী সংগীত সৃজনশীলতার প্রমাণ পাই। সুর সৃষ্টি, বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার, শিল্পী নির্বাচন ইত্যাদি প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমরা প্রথাবিরোধিতার সঙ্গে তাঁর স্বকীয়তা লক্ষ্য করি। অনুপ ঘোষালের সঙ্গে রবি ঘোষ, কানু মুখার্জি, জহর রায় প্রমুখের কণ্ঠকে তিনি বিশেষ দক্ষতায় অত্যন্ত পরিমিতির সাথে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন যা তাঁর ছবির ব্যঙ্গাত্মক আবহকে ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল। ফরমায়েশি কাজ করা সংগীত পরিচালকের কাছ থেকে এই ধরনের ব্যতিক্রমী কাজ পাওয়ার ব্যাপারে হয়তো তাঁর আশঙ্কা ছিল এবং সেই কারণেই নিজের সংগীত ভাবনা ও সাংগীতিক জ্ঞান ব্যবহারের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এ ব্যাপারেও তাঁর নিজস্ব মত ছিল। তিনি মনে করতেন, ‘…ফিল্মের বিষয় নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে ফিল্মের সামগ্রিক সাংগীতিক কাঠামোর একটা আভাস মনে কোথাও থাকে। সেই অস্পষ্ট আভাসের কাঠামোর ভেতরই গল্পটা তৈরি হতে থাকে। আবার গল্পের এই তৈরি হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই সাংগীতিক কাঠামো খানিকটা স্পষ্ট চেহারা নেয়। গল্পের শুরু, উত্থান, পতন, গতি সেই সাংগীতিক কাঠামোর সঙ্গতিতে প্রাসঙ্গিক হয়।’
এই ভাবনা থেকে যে কাজ করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন তাতে নিঃসন্দেহে তিনি যথেষ্ট সফল হয়েছিলেন। ‘ভূতের রাজা দিল বর’ গানটিতে অনুপ ঘোষালের সুরে গাওয়ার পাশাপাশি রবি ঘোষের আবৃত্তির মতো করে পুনরাবৃত্তি করার ধরনটি পাশ্চাত্যের অপেরায় দেখা যায়। পাশ্চ্যাত্য সংগীতে দখলের কারণে এই বিষয়টির সফল প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে এবং ছবির বিষয়ের সঙ্গে তা মানিয়েও গেছে।
‘হীরক রাজার দেশে’র ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এখানেও তিনি গান লিখেছিলেন নয়-দশটির মতো। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে/ সাথে সাথে পাখি ডাকে/ কত শোভা চারি পাশে; ধোরো নাকো ধোরো নাকো শান্ত্রি মশাই/ হাত কেন বাড়াও ভাই ধরো না/ বলি নড়ো নাকো ওইখানে দাঁড়াও; এসে হীরকদেশে দেখে হীরের চমক/ এত খাতির পেয়ে দেখে রাজার জমক/ মোদের মন ভরে গেছে খুশিতে/ মোরা সেই কথা জানাই; কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায় ও ভাইরে ভাইরে; মোরা গুপী বাঘা দুজন ভায়রা ভাই/ মোদের আর কোনো কাজ নাই/ মোরা ভূতের রাজার বরের জোরে/ পরের ভূত ছাড়াই; নহি যন্ত্র নহি যন্ত্র আমি প্রাণী/ আমি জানি হীরক রাজার শয়তানি; পায়ে পড়ি বাঘ মামা / করো নাকো রাগ মামা/ তুমি যে এ ঘরে কে তা জানতো; মোরা দুজন রাজার জামাই/ মোরা খাই দাই ঘুরি ফিরি/ আহা কি মোদের ছিরি/ মোরা দিনে করি জাদুগিরি/ রাতে আয়েশেই ঘুমাই।
‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’র গানও তিনি লিখেছেন। কেমন বাঁশি বাজায় শোনো/ মাঠেতে রাখাল/ তার সুরে বুঝি যাদু আছে/ মন হলো মাতাল; ওইযে দেখো দিনের আলো ফোটে/ পুবের আকাশ রাঙা করে/ সোনার সূরুজ ওঠে; এদ্দিনে দুইজনে ঘর ছেড়ে হয়েছি বার/ তাইতো মোরা ভাবনা ভুলে হালকা মনে গান করি আবার; আজ থেকে মোরা হয়েছি তৈয়ার/ গুপী বাঘা মোরা নেই যেন আর; আজকে মোদের আরাম বড়/ শেষ হয়েছে মোদের কাজ; হুঁশিয়ার! সব কাজ বন্ধ/ হাঁটাচলা বন্ধ, কথা বলা বন্ধ; ওরে শয়তান! তোর শয়তানির আজ হলো অবসান; কতকাল পরে মোরা এসেছি আবার/ বাঘা গুপী; মিছামিছি করো কেন চিৎকার/ বলি ভাবনার কিছু নাই; হুঁশিয়ার মোরা আসি ধেয়ে ধেয়ে/ দেখরে তোরা চেয়ে চেয়ে/ কেমনে মোরা গেয়ে গেয়ে/ করি মোদের কাজ;সুধীজনে যত আছ সবারে করজোরে নমস্কার/ করি নমস্কার/ এইতো মোদের গানের শুরু/ মোদের বুকটা করে দুরু দুরু।
গানগুলোর শব্দ চয়ন, সুর রচনা, যন্ত্রানুষঙ্গ এবং শিল্পী নির্বাচনে ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা লক্ষ্য করি যাকে এককথায় ‘সত্যজিতীয় বৈশিষ্ট্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। কোনো কোনো গান ২ মিনিটের কিছু বেশি, আবার কোনো কোনো গান দীর্ঘ ৭/৮ মিনিটের। চিত্রনাট্যের চাহিদা অনুযায়ী তিনি কাজটি করেছিলেন। ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’ একটি দীর্ঘ গান। একই গানের মধ্যে তিনবার সুর-তাল-লয় ও ভাব বদলে সাগর, অরণ্য ও পাহাড় বন্দনার কাজটিতে সত্যজিৎ রায় যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা এক কথায় অসাধারণ। আবার ‘পুরিয়া ধানেশ্রী’ রাগাশ্রিত সুরে গীত ‘পায়ে পড়ি বাঘ মামা’ গানটিতে তিনি যে নির্মল হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন তাই নয়, রাগ সংগীতের অসাধারণ দক্ষতার কিঞ্চিৎ প্রমাণ রেখেছেন। কিন্তু ছবিতে শুদ্ধ রাগ সংগীত ব্যবহারের সুযোগ খুবই সীমিত। এ প্রসঙ্গে তাঁর ভাবনাটি ছিল সুস্পষ্ট। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন, ‘সত্যি বলতে কী, রাগরাগিণীর শাস্ত্রীয় রূপ অবিকৃতভাবে ব্যবহার করার সুযোগ ছবিতে প্রায় নেই বললেই চলে। রাগরাগিণীর একটি নিজস্ব সত্তা আছে। কোনও ছবির পিছনে কোনও পরিচিত রাগ যদি প্রচলিত পন্থায় বিস্তারিত হতে থাকে, তবে সে রাগসঙ্গীত শ্রোতার মনকে ছবি থেকে সঙ্গীতের মার্গে টেনে নিয়ে যেতে চাইবে।’’
‘কেমন বাঁশি বাজায় শোনো মাঠেতে রাখাল’ গানটিতে কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। অনুপ ঘোষালের খালি গলায় গানটি বিশেষ একটি আবহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। মূলত তিনি একটি ব্যঙ্গধর্মী চলচ্চিত্রে সংগীত রচনার ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব চাহিদা ও ভাবনার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন। কোনো ফরমায়েশি গীতিকারের কাছ থেকে প্রত্যাশামাফিক কাজটি তিনি পেতেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। শুধু নিজের সংগীতপ্রতিভা প্রদর্শনের ইচ্ছা থেকে কাজটি করেননি। একটি ছবির সামগ্রিক বিষয়কে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার আগ্রহ থেকেই তিনি কাজটি করেছেন। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় নিজেই বলেছিলেন, ‘আমার নিজের মধ্যেই সংগীত নিয়ে নানা ধরনের আইডিয়া আসছিল। সেজন্য পেশাদারদের বদলে নিজেই সুর করার সিদ্ধান্ত নিই। না হলে তাদের একের পর এক পরামর্শ দিয়ে বিরক্ত করতাম।’
তবে এও মনে রাখতে হবে যে সত্যজিতের এই যোগ্যতাকে অনেকেই ভালোভাবে নিতে পারেননি। অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে সংগীতশিল্পী না হয়ে সংগীত পরিচালনা করা সত্যজিতের অবিমৃষ্যকারিতা। কিন্তু এ সব বিরূপ সমালোচনার যথোপযুক্ত জবাব তিনি দিয়েছেন তাঁর নিখুঁত সংগীত পরিচালনার মধ্য দিয়ে। চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে সত্যজিৎ যে গভীর সৃজনশীলতার ছাপ রেখেছেন তার তুলনা বিরল।
পড়ুন: রবীন্দ্রপ্রেমী সত্যজিৎ