ধুপখোলা মাঠের কিনারে বসেছিল ফয়সল।
একটু আগে গোমরা আকাশ ফিসফিস করে এক পশলা বৃষ্টিকণা ঢেলে গেছে। মাঠের কিনারে, যেখানে ফয়সল বসেছে সেখানে ঘাস তাজা কিন্তু ভেজা। অল্প দূরে কয়েকটি কিশোর মেতেছে খেলায়, ক্রিকেট খেলছে তারা। কিশোরের ক্রিকেট-ক্রেজ থেকে চোখ ফিরিয়ে হঠাৎ মাছরাঙার মতো টুপুস করে মনের পুকুরে ডুব দিলো ফয়সল। খোলা মাঠের কিনারে এখন আত্মমগ্ন সে। আকাশে ডিপ্রেশন, এ কথা সে আবহাওয়ার সংবাদে শোনেনি। তার মনের মধ্যেও মেঘের ওড়াউড়ি। বৈশ্বিক ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে তার ব্যক্তিগত উদ্বেগ আছে। নিজের মনের মতোই আকাশে রোদ-মেঘের চলাচল ঠিকই মাপজোঁক করতে পারে সে।
শরৎকালে বৃষ্টিপাত ফয়সলের মন ভিজিয়ে দেয়। এই মুহূর্তে সে আরেকটু ন্যাতানো। একটু আগে পত্রিকার স্টল ঘুরে এসেছে ফয়সল। ভাঁজ-করা পত্রিকাটি বগলে গুঁজে রেখেছিল। ভেজা ঘাসের ওপর বসে পত্রিকার রাশিফলের পাতা খুলে কোলের ওপর বিছিয়ে দিলো। কলামটি দুইবার পড়া হয়ে গেছে। রাশিফলের ভাষ্য আবার পড়ে সে।
ফয়সল মকর রাশির জাতক। তারিখ গুনে তা সে পত্রিকা থেকেই জেনেছে। আজকের রাশিফলে লেখা, সামাজিক যোগাযোগ ভালো। অবিবাহিতদের জন্য দিনটি শুভ। প্রণয়ের সংবাদ পেতে পারেন। প্রণয়! প্রণয় কী বিবাহ? বাড়ি ফিরে অভিধান দেখতে হবে। বিবাহের সম্ভবনা সে রাশিফলে সপ্তাহে প্রায়ই দেখে। লাভ হয় না। বিয়াল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া ফয়সল আজও অবিবাহিত। পেশায় প্রকৌশলী। আগে না হলেও, পরিবার এখন স্বচ্ছল। তার স্যালারির অঙ্কটিও অনেকের মুখে কালিঝুলি মেখে দেয়। উপার্জনের অঙ্কটি তাই কখনো কাউকে সে বলে না। ‘দেখতে খারাপ, স্বভাব-চরিত্র ভালো নয়’- এ রকম তিতকুটে কথাও কারও মুখে শোনেনি ফয়সল।
একটু খাটো সে। ফয়সল নিজেকে খাটো না বলে ‘ভার্টিক্যালি চ্যালেঞ্জড’ বলতে ভালোবাসে। পুরুষের গড়পরতা উচ্চতার থেকে খাটো হলেও সে বামুন নয়। পথে প্রায়ই লম্বা গড়নের মেয়ে পড়ে, উচ্চতায় তাকে চার ইঞ্চি ছাড়িয়ে যায়। ফয়সল ছোটবেলা থেকেই তার মেধার প্রশংসা শুনেছে। ‘এই ছেলেই সংসারের হাল ধরবে’- আত্মীয়-অনাত্মীয়, পড়শি সবার মুখেই সে একই কথা শুনে এসেছে। সময়ান্তরে তাই হয়েছে। কিন্ত সমস্যা একটাই, নিজের জীবনের হাল হাতড়ে খুঁজে পাচ্ছে না সে। ফয়সল এখনও অবিবাহিত।
ক্রিকেট-বলটি গড়িয়ে তার দিকে ছুটে আসছিল। খপ করে বলটি তালুবন্দি করে সে। তারপর ছুঁড়ে দেয় মাঠের ছেলেদের দিকে। তার ডান পাশের গলির মুখ দিয়ে কলকলিয়ে বেরিয়ে এলো দু’জন নারী। মাঠ বরাবর হাঁটছে তারা। হাতে শপিং ব্যাগ। ওপারে কয়েকটি বহুতল ভবন। হয়তো বাড়িঘর সেখানেই। তুই খুব ভালো বারগেইন করতে পারিস! না হলে আসমানি রঙের জামদানিটা কেনা হতো না। শপিং ব্যাগ হাতে বড় মেয়েটি বলছিল। এই বয়সের মেয়েদের ‘মহিলা’ বা ‘স্ত্রীলোক’ বলা হয়। তার বয়স কতো হতে পারে! ফয়সল অনুমান করার চেষ্টা করে। সে স্থূলকায়, পেটে-কোমরে মেদ। পাশে তিন-চার বছরের একটি বাচ্চা। মাঠের মধ্যে সে জোরেশোরে হাঁটে, পিছিয়ে পড়ে, আবার ছুটে মহিলার গা ঘেঁষে যায়। তাহলে বড় মেয়েটি বা মহিলাটি বিবাহিত এবং একজন মা। পাশের মেয়েটির কোমর সরু। মাঝারি দৈর্ঘ্যের চুল কোমর ছুঁতে পারেনি। সে বড়জোড় কুড়ি। ওরা ছোট মাঠ মুহূর্তেই পেরিয়ে গেল। মেয়েটির প্রতিবিম্ব আর রোমাঞ্চকর হাঁটার ভঙ্গি কাঁটার মতো লেগে থাকে ফয়সলের চোখে।
কোজাগরী পূর্ণিমার ছুটি। অফিস বন্ধ ছিলো আজ। সারাদিন সে ঢাকা শহর চষে বেরিয়েছে। ছুটির দিন সে বাড়িতে বই পড়ে কাটায়। আজ কিছুই টানেনি তাকে। সকাল নয়টায় অফিস আছে, বলে বেরিয়ে পড়েছিল। ফয়সল হিসেব কষলো, দু’টি স্ববিরোধী কাজ করেছে সে। সারাদিন বোহেমিয়ান হয়ে বাইরে ঘুরেছে আর ডাহা মিথ্যে কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে।
বাড়ির টান অনুভব করে ফয়সল। বাড়ির টানের সাথে মনে খচখচ করে বিজু খালা। আসবে না তো আজ! দু’দিন আসেনি। আজ আসতে পারে! একটি মেয়ের ছবি নিয়ে সে ছ’মাস ধরে ঘুরঘুর করছে বিজু খালা। ছবির মেয়েটি ভালো। অভাবী পরিবার, তবু ভালো। অনেকগুলি ভাইবোন। বাবা বেঁচে নেই। তবু ভালো- এমন মেয়ে ভালো হয়। অনুস্বার নাকে গুঁজে বিজু খালার আকুতি ও ওকালতি। তবু ফয়সল ছবি দেখার আগ্রহ দেখায়নি। দারিদ্র্যকে নিচু নজরে দেখে না সে , আবার মহানও ভাবতে পারে না।
ছোটবেলা থেকে সে দারিদ্র্য দেখেছে। দারিদ্র্যের সঙ্গে প্যাঁচ কষে আজ সত্যি সে পরিবারের হাল ধরেছে। বাড়িতে সবার মুখে এখন খইয়ের মতো হাসি। মায়ের মুখও কণকচাঁপা ফুল। দেখলেই নিজের ক্লান্তি-অবসাদ ভুলে যায় ফয়সল। সে আর দারিদ্র্যের গর্তে পড়তে চায় না। বিজু খালা কাউকে গছিয়ে দিচ্ছে না তো! বিজু খালার স্বভাব তেমন নয়। তবু ছ’মাস ধরে একই মেয়ের ছবি নিয়ে ঘোরাঘুরি- ফয়সলকে সন্দিগ্ধ করে। পরিবারের হাল যদি ফসকায়, তারচেয়ে নিজেই বেহাল থাকা ভালো।
আলো পড়ে এসেছে। মাঠে ক্রিকেট-ক্রেজ নেই। ওপারে আ্যপার্টমেন্টের জানালায় জোনাকি, টিপটিপ করে বাতি জ্বলে উঠছে। একটা রিকশা নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলো ফয়সল। অনুমান ঠিক, বিজু খালা বসে আছে। অফিসের কিছু জরুরি ফাইলপত্র বাড়িতে থাকে। ফয়সল ঘরে ঢুকেই ফাইলপত্র ছড়িয়ে বসলো। মুখ গুঁজে দিয়েছিল ফাইলের কাগজে। মায়ের আগমন বুঝতে পারেনি। মা যখন-তখন জানান না দিয়ে তার ঘরে আসে। তোর বিজু খালা মন খারাপ করে চলে গেল! ছবিটা একবার যদি- মা কথা শেষ করতে পারে না। মা, আমাকে তেতো করে এক কাপ চা দাও না। নিজের কপাল টিপে ধরে ফয়সল। তেতো চা! মায়ের চওড়া চোয়াল চুপসে যায়। কড়া চা , ফয়সল শুধরে বলে , মাথা ধরেছে, অফিসে কাজের চাপ। ও ও ইশ ধ্বনিগুচ্ছ বাতাসে চালান করে মা ফিরে যায় তেতো চা বানাতে। ফয়সল নিভে যায়, মায়ের সাথে প্রতারণা করলো সে! তার তো মাথা ধরেনি। এসবের শাস্তি হয়তো পেতে হবে একদিন।
পরের দিনই শাস্তি পেল ফয়সল। লম্বা ও চওড়া কাঁধের মেয়েটি সজোরে চড় মারলো ফয়সলকে। অফিসের গাড়ি আগেই ছেড়ে দিয়ে কাছের বই-পত্রিকার স্টলের দিকে যাচ্ছিল ফয়সল। পত্রিকার রাশিফল পড়া তার নেশা হয়ে গেছে। তখনি আড়াল থেকে ঢিল খাওয়ার মতো চড় খেল ফয়সল। অফিসের ডাকাবুকা ইঞ্জিনিয়ারের গালে ফুটপাথে মেয়ের হাতে চড়! ফয়সল বুঝে উঠতে পারে না। তার কানে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকাডাকির মধ্যে সে একটি মেয়ের চিৎকার শুনতে পেল, রাস্তায় হাঁটেন, রাস্তা দেখেন না!
ফয়সল তখনও বোঝেনি, তাড়াহুড়োয় সে মেয়েটির সাথে ধাক্কা খেয়েছে। মেয়ের শরীর। সংবেদনশীল অঙ্গ আছে। কোথায় লেগেছে কে জানে! মেয়েটা তখনও ফুঁসছে! নিজেকে সামলায় ফয়সল। আসলে আমি... ‘আসলে আমি তো চোখ উপরে তুলে হাঁটছিলাম’- তাই বলবেন তো! একটু আগেই তো দামি গাড়ি থেকে নেমে আমার পিছু নিলেন। কিছুই বুঝি না! রাস্তার সস্তা মেয়ে আমি! ফয়সল এদিক-ওদিক চায়। তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মেয়েটি সব উত্তর শক্তপোক্ত ভাষায় থুতুর মতো ফয়সলের মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছে। ফয়সলের ডিফেন্স ভেঙে যায়। পত্রিকার স্টল থেকে মালিক বেরিয়ে ফয়সালা করে দেয়।
বাড়ি ফিরে ফয়সল চিৎকার করে মাকে ডাকলো। আজ পত্রিকা কেনেনি সে। রাশিফল নয়, কপালে যাই থাক বিজু খালার ঠিক করা মেয়েকেই সে বিয়ে করবে। ছবি দেখারও কোনো প্রয়োজন নেই। রাশিফল দেখা আর কপাল দেখা একই কথা। মা হাসিমুখে ছবি হাতে ফয়সলের ঘরে ঢোকে। ধুলো নেই তবু যত্ন করে আঁচল বুলিয়ে ছবিটি ফয়সলের চোখের সামনে মেলে ধরে মা। নিজের ওপর বিরক্তি, ফয়সল মুখ ঘুরিয়েছিল। ছবির দিকে তাকিয়ে সে আজকের রাশিফল দেখলো, এতো সেই মেয়েটি! জনাকীর্ণ পথে তাকে চড়-থাপ্পর মেরেছিল। তারই ফটোগ্রাফ এখন সন্দিগ্ধ ও শরাহত, আসলে ‘চড়াহত’ বরের করতলে। ফটোগ্রাফে সেদিন নিজের রাশিফল পড়েছিল ফয়সল। পড়ছিল এবং ভিজুয়ালইজ করছিল। শুধু একবারই আঁতকে উঠেছিল সে। একবারই সংশয়ের সরু চোখে পরখ করেছিল। মনে হয়েছিলো এই মুহূর্তে ‘একটি সিক্ত য়ুঁথির মালা’ যদি তার হাতে থাকতো! এরপর ফয়সল আর সময় খরচ করেনি।
বিয়ের উৎসবের পাট চুকেবুকে গেলে মধ্যরাতের পর ক্লান্ত ফয়সল আঁখির মুখোমুখি হলো। বিবাহ-বিছানায় অল্প ফুল কিন্তু অনেক সুরভি। কিছু ফুল একপাশে সরিয়ে মুখোমুখি বসেছে ফয়সল আর আঁখি। ফুল সরাতে পেরেছে, সুরভি নয়- সুরভি সরানো যায় না বলেই।
চড়-থাপ্পর মনে রাখতে নেই, বহুদূরের পথ অতিক্রম করে মুখ খোলে আঁখি। যেন সে পেরিয়ে এসেছে অন্তবিহীন পথ। ফয়সলের মনের ভেতর রবীন্দ্রনাথ উঁকি দেয় ‘যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ আসিতে তোমার দ্বারে মনে হলো- ফুলের মতো রবীন্দ্রনাথকেও যত্ন করে পাশে সরিয়ে দেয় ফয়সল। তার কানে চড়া শব্দ ঢেলে দিয়েছে আঁখি। মৌনী ফয়সল ঋষির মতো ঝুঁকে পড়ে আঁখির দিকে।
চড়-থাপ্পর! ফয়সল ফুলের বিছানায় চড় শব্দটির জন্য প্রস্তুত ছিলো না। রাস্তায় সেদিন চড় মেরেছিলাম- আঁখি লজ্জায় মাথা নিচু করে। ফের মুখ তুলে হড়বড় করে বলে, ভুলে যান, সব ভুলে যান। এখনি ধুয়েমুছে ফেলুন মন থেকে। আঁখি একটু হাঁপায়। যা পায় তা সে ধরে রাখে জীবনে, হারতে চায় না। ফেললাম, এখনি ধুয়েমুছে ফেললাম। ফয়সল নির্বিকার, শুধু ডান হাত উঠতে চেয়েছিল গালের কাছে, যেখানে চড় পড়েছিল। সচকিত হয়ে সে হাত ফিরিয়ে নিলো। জীবনের চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিতে হবে না! একটা চড় কী তার থেকে বড় হলো! আঁখির কণ্ঠ একটু ভেজা। তাই তো জীবনে কতো চড়াই-উৎরাই! আঁখির জীবনবোধের প্রেমে পড়ে ফয়সল। চড় খুব ছোট আঘাত, তাই না! মুখ নিচু করেই আঁখি উত্তরের অপেক্ষায় থাকে। উত্তর তখনি আসে না।
চড়াই-উৎরাই কথাটা চড়-থাপ্পরের মতোই শোনায় ফয়সলের কাছে। জীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে এসেছে ফয়সল। আবার তারই দূরাগত এবং দুর্মর ধ্বনি এই ফুল্ল বিছানায়- আঁখি তার কোলের কাছেই উন্মুখ তরঙ্গ - ঝড় শেষে ডুবে মরতে চায় না সে। আলিঙ্গনে আবক্ষ ডোবা যায়, ডোবার ঘোলা জলে পা ভেজানো আর নয়। দূরে কবে-দেখা সরু নৌকার ওঠা-পড়া দেখেছে সে ঝড়ের মুখে, মনেও নেই, তার ছায়াচিত্র ভেসে আসে এখন। ঝড়ের মুখে ছিপছিপে সরু সিল্যুয়েট এই ভাসে এই ডোবে। সামাল-সামাল ধ্বনিগুচ্ছ সম্মোহিতের মতো শুনতে পায় সে। তবু সে নৌকা তীর ছুঁয়েছিল। ডেস্টিনেশন, ডেস্টিনি তারপর হরস্কোপ শব্দটি সিকোয়েন্স মেনেই মনে আসে তার।
সতর্ক ফয়সলের চোখে পুরাকালের ঢেউ ওঠে। গলায় সেই আদিম ঢেউয়ের ধাক্কা সামলে ফয়সল বলে, চড়াই-উৎরাই কথাটিও চড়ের মতোই শোনায়, ভয়-ভয় করে। ছলাকলা বলো, এঘরে এখন এ কথাই মানায়। ফয়সলের মুখে ছলাকলা শুনে খুকির মতো হাসিতে গড়ায় আঁখি। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় গড়িয়ে পড়ে ফয়সলের কোলে। ফয়সল প্রস্তুত ছিলো না। তবু সে আঁখিকে সামলে নেয়। ছিপছিপে আঁখি, ফয়সল সরু নৌকার মাঝি। ভাসে কী ডোবে- সামাল-সামাল ধ্বনি আবার শুনতে পায় সে। আঁখিকে বুকের কাছে- যেখানে হৃৎপিন্ডের ধুপপুক যেখানে অস্থিপিঞ্জর- সেখানে নিয়ে ফয়সল একটা ফয়সালায় আসে।
আঁখিই জীবন। জীবনকে সামলে রাখতে হয়। আঁখির বুকের ধুকপুক দূরে বৃষ্টি ও ঝড়ে ঝাঁপসা আকাশের নিচে জলে ভেজা মলিন মাঝিদের হাঁকডাকের মতো মনে হয়। তীরে ফেরার কী আকুল আকুতি, আজন্ম অলিখিত সংগ্রাম। মানুষের রক্তের ভেতর আছে। হরস্কোপে নেই।