এরিস্টটল থেকে নোয়াম চমস্কি, বহুজনই ছিলেন রাজনীতিবিদ এবং লেখক। সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতির যোগসূত্র থাকাই স্বাভাবিক। প্লেটো, সার্ত্র, অরুন্ধতি রায়গণ তাদের লেখায়, ভাবনায়, কখনো বা জীবনেও রাজনীতির চর্চা করেছেন। সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতির চর্চা নিবিড়। তবে, সব সময় রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্যের চর্চা নিবিড় নয়।
জগতের বহু খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ আত্মজীবনী লিখেছেন। নিজের জীবনের রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়েও লিখেছেন। সেসব আত্মজৈবনিক লেখার মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর ‘দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ’, জওহরলাল নেহেরুর ‘এন অটোবায়োগ্রাফি’, নেলসন মেন্ডেলার ‘আ ওয়াক টু ফ্রিডম’, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। তবে, এসব রচনার কেবল সাহিত্যগুণ বিচার্য নয়, বরং এর বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও ভেবে দেখতে হয়। উল্লেখ্য, ঠিক সাহিত্যচর্চার উদ্দেশ্যে এসব লেখা হয়নি। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, ইতিহাসে তারা ঠাঁই নিয়েছেন এবং তারা পঠিত হন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় রাজনীতি এবং সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তি হলে উইনস্টন চার্চিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটেনের এই প্রধানমন্ত্রী সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। নোবেল কমিটি পুরস্কার দেওয়ার সময় তাকে পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে বলেছিল, ‘তার ঐতিহাসিক এবং জীবনীভিত্তিক ওস্তাদি বর্ণনার দক্ষতার পাশাপাশি সমুন্নত মানবিক মূল্যবোধের রক্ষায় বাগ্মিতা’।
উল্লেখ্য, চার্চিলের চেয়ে যোগ্য সাহিত্যিকগণ নোবেল পুরস্কার পাননি। পাঠকের সুবিধার্থে জানানো দরকার যে, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, ইবসেন, মার্ক টোয়েন, বোর্হেসের মতো লেখকরা নোবেল পুরস্কার পাননি। তাতে অবশ্য তাদের সাহিত্যের মান নিয়ে প্রশ্ন আসে না। বরং মমতা ব্যানার্জি সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার পেলে সামগ্রিক পুরস্কার এবং সাহিত্য মান নিয়ে প্রশ্ন আসেই। কারণ, সাহিত্যচর্চাটা ক্ষমতার প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে বিবেচনা করা যায় না। চার্চিল স্বয়ং লেখক হিসেবে উইনস্টন এস চার্চিল ছদ্মনাম ধারণ করেছিলেন। কারণ, তার সময়েই মার্কিন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ছিলেন উইনস্টন চার্চিল নামে আরেকজন। দুজনের নাম নিয়ে বিভ্রান্তি এড়াতেই স্বয়ং চার্চিলকে নিজের নামে ‘এস’ যুক্ত করতে হয়েছে। চার্চিলের সাহিত্যকীর্তির মধ্যে একটি উপন্যাস, একটি ছোটগল্প গ্রন্থ আর অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ আছে। এর মধ্যে অধিকাংশই আবার তার বক্তৃতার অংশ। মমতা ব্যাণার্জির বক্তৃতাকেও হয়তো বই আকারে প্রকাশ করলে তার ছড়া বা কবিতার মতো এতটা বিতর্কের সৃষ্টি হতো না। চার্চিলের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কম নয়। তবে, তিনি একেবারে উড়ে এসে জুড়ে বসা লেখকও নন। যৌবনে (১৮৯৫ সালে) তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় রিপোর্ট বা কলাম পাঠাতেন। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদধারী চার্চিল সে সময় বেতন পেতেন ৩০০ পাউন্ড, কিন্তু ৫০০ পাউন্ড উপার্জন করতেন দ্য ডেইলি গ্রাফিক, দ্য ডেইলি পাইওনিয়ার, দ্য পাইওনিয়ার ইত্যাদি পত্রিকায় লিখে। রাজনীতিবিদ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ভূমিকার জন্য চার্চিলকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দিলে এত তর্ক-বিতর্ক হতো না। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো রচনা বৈদগ্ধ চার্চিলের ছিল না, তথাপি একটা সাহিত্য মান চার্চিলের ছিল। চার্চিল শেষ বয়সে এসে চিত্রকর হিসেবেও নিজেকে বিস্তৃত করেন। কিন্তু, মমতা ব্যানার্জির সাহিত্য মান আর যাই হোক চার্চিলের সাহিত্যের সঙ্গে তুল্য নয়। আর পুরস্কার প্রসঙ্গে যে বিতর্ক তা আদতে সাহিত্য আকাদেমিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
জানিয়ে রাখা ভালো, ভারতে ১৯৫৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার চালু হয় এবং প্রধান সবগুলো ভাষাতেই এই পুরস্কার দেওয়া হয়। বাংলা ১৯৫৫ সালে প্রথম সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান জীবনানন্দ দাশ তার শ্রেষ্ঠ কবিতার জন্য (মরণোত্তর)। পরের বছর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আরোগ্য নিকেতন উপন্যাসের জন্য। তারপর একে একে প্রেমেন্দ্র মিত্র, রাজশেখর বসু, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জীবন চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কর প্রমুখ এ পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কারের তালিকা থেকেই বোঝা যায়, ভারতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখকরাই এ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এতকাল। এই নামের তালিকার সঙ্গে কোনোভাবেই মমতা ব্যানার্জিকে মানায় না, গ্রহণ করা যায় না। অতএব, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু থেকে শংকর, ব্রাত্য বসু পর্যন্ত যারা এ পুরস্কার পেয়েছেন তারা সবাই প্রমাণিক কবি, অনুবাদক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার অথবা নাট্যকার। এই তালিকায় মমতা ব্যানার্জি নাম সংযুক্ত থাকলে পুরো আকাদেমি পুরস্কারই প্রশ্নবিদ্ধ হতো। তবু শেষ রক্ষা যে, সোশ্যাল মিডিয়ার নানা প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ার চাপেই হয়তো বা মমতা ব্যানার্জি স্বয়ং পুরস্কার থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
আরেকটি বিষয় বলা জরুরি, নিজের ঘরের কথা। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও লেখক। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার রচিত ‘ওরা কেন টোকাই’ এবং ‘সাদা কালো’ গ্রন্থ দুটির ভক্ত। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই লেখেন। লেখালেখি তার রাজনৈতিক সচেতনতারই অংশ। আবার তার বাক্যগঠন, সাহিত্যবোধও উল্লেখ করার মতো।
‘ওরা কেন টোকাই’ বইয়ে ছয়টি প্রবন্ধ আছে। এর মধ্যে প্রথম প্রবন্ধ ‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’ থেকে তার রচনাশৈলীর একটু উদাহরণ দেই—‘গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামখানি একসময় মধুমতি নদীর তীরে ছিল। বর্তমানে মধুমতি বেশ দূরে সরে গেছে। তারই শাখা হিসেবে পরিচিত বাইগার নদী এখন টুঙ্গীপাড়া গ্রামের পাশ দিয়ে কুলকুল ছন্দে ঢেউ তুলে বয়ে চলেছে। রোদ ছড়ালে বা জ্যোৎস্না ঝরলে নদীর পানি রুপোর মতো ঝিকমিক করে।’
এই যে শেষ লাইনের চিত্রময়তা ‘রোদ ছড়ালে বা জ্যোৎস্না ঝরলে নদীর পানি রুপোর মতো ঝিকমিক করে’ তা বাংলা সাহিত্যে বিরল নয়। কিন্তু, এর সরলতা, গীতময়তাও তো কম নয়। পরবর্তী অনুচ্ছেদেও শেখ হাসিনার রচনাশৈলীর সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একটা ধারাবাহিকতা পাই। রবীন্দ্রনাথ থেকে বিভূতিভূষণ, মানিক পাঠের সঙ্গে সংযুক্তি পাই। ‘নদীর পাড় ঘেঁষে কাশবন, ধান-পাট-আখ খেত, সারিসারি খেজুর-তাল-নারকেল-আমলকি গাছ, বাঁশ-কলাগাছের ঝাড়, বুনো লতা-পাতার জংলা, সবুজ ঘন ঘাসের চিকন লম্বা লম্বা সতেজ ডগা। শালিক-চড়ুই পাখিদের কল-কাকলি, ক্লান্ত দুপুরে ঘুঘুর ডাক। সব মিলিয়ে ভীষণ রকম ভালোলাগার একটুকরো ছবি যেন।’
এখন শেখ হাসিনার সমগ্র রচনার সঙ্গে এই স্মৃতিচারণের ‘ভীষণ রকম ভালোলাগা’ সবখানে পাওয়া যাবে না, যায় না। কিন্তু, আলোচ্য বিষয়টি হলো—সামগ্রিকভাবে অধিকাংশ রচনাই তার রাজনীতির অংশ হলেও, সেসব রচনা বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিকতা বিচ্ছিন্ন নয়। শেখ হাসিনার প্রসঙ্গটুকু আনতে হলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জির পুরস্কার পাওয়ার বিতর্কের সঙ্গে শেখ হাসিনার লেখালেখিরও তুলনা করছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, লেখক এবং অলেখকের মধ্যে তুলনা হয় না। প্রধামন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর তুলনা হতেই পারে।
আমাদের সময়ের রাজনীতির আরেক বিতর্কিত ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্প। বেফাঁস কাজকর্ম-কথাবার্তার জন্য তিনি যথেষ্ট তর্কে আসেন। কিন্তু, আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, রাজনীতিতে আসার আগে এই ধনকুবের ব্যবসায়ী লেখক হিসেবেও পরিচিত। তার প্রকাশিত ১৫টি বই আছে ব্যবসা এবং গলফ খেলা বিষয়ে। তার ‘দ্য আর্ট অব দ্য ডিল’ (১৯৮৭) গ্রন্থটি বাণিজ্য বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা। ফেডারেল রেকর্ডের এক হিসাবে তিনি বছরে ১৫ থেকে ৫০ হাজার ডলার রয়ালিটি পেয়ে থাকেন। ‘টাইম টু গেট টাফ’ (২০১১) বই থেকে তিনি দেড় লাখ ডলার আয় করেছেন এক বছরে। আপনারা যারা ধনী লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তারা ট্রাম্প রচিত ‘হাউ টু গেট রিচ’ এবং ‘থিঙ্ক লাইক বিলিয়নিয়ার’ বই দুটো পড়ে দেখতে পারেন। ধনসম্পদে আমার আগ্রহ নেই বলে আমি পড়িনি।
মার্কিন রাজনীতিবিদদের অনেকের সঙ্গে সাহিত্যের সংযোগ ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন জন এফ কেনেডি। তিনি ‘পোফাইলস ইন কার্জ’ (১৯৫৪) বইয়ের জন্য পুলিৎজার পুরস্কারও পেয়েছিলেন। উল্লেখ্য, পুলিৎজারকে আমেরিকার সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য গণ্য করা হয় আর কেনেডি সে সময় মার্কিন সিনেটর ছিলেন। কেনেডির এই বই তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের নিয়েই রচিত। তার সময়ে আমেরিকার আটজন সিনেটর নিয়ে কেনেডি লিখেছেন এবং বলার চেষ্টা করেছেন যে, এই ব্যক্তিগণ যথেষ্ট সাহসিকতার সঙ্গে তাদের দলীয় চাপ এবং সাংবিধানিক কাজকর্ম সামাল দিয়েছেন। বলা দরকার যে, কেনেডির এই রচনা আজও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচ্য হয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারও আত্মজীবনী লিখেছেন ‘হোয়াই নট দ্য বেস্ট?’ শিরোনামে। তবে, এটাকে অনেকেই তার রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ হিসেবে দেখেন। বারাক ওবামা এবং মিশেল ওবামাও লিখেছেন বই।
লেখাটা শেষ করি আমার প্রিয় একজন কবি, নাট্যকার, গদ্যকারকে দিয়ে। আমাদের দেশে তিনি অতটা পরিচিতি নন। তার নাম ভাক্লাভ হাভেল। এই ব্যক্তি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তার দ্য গার্ডেন পার্টি, দ্য মেমোরান্ডাম, অডিয়েন্স, প্রোটেস্ট, দ্য মাউন্টেন হোটেল ইত্যাদি বিশ্ব নাট্যসাহিত্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রচনা। নোবেলবিজয়ী এই লেখক ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত চেকোস্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আদতে তিনি ছিলেন চোকোস্লোভাকিয়ার শেষ প্রেসিডেন্ট। কারণ, ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে তৈরি হয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র—চেক রিপাবলিক এবং স্লোভাকিয়া।
রাজনৈতিক আলাপ অনেক হলো, লেখাটা শেষ করি ভাক্লাভ হাভেলের কবিতা দিয়ে। মমতা ব্যানার্জির কবিতা তো অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে পড়ে ফেলেছেন। এবার অধমের অনুবাদে হাভেলের একটি কবিতা পড়ুন।
এটা আমিই যাকে শুরুটা করতে হবে ভাক্লাভ হাভেল
আমাকেই শুরুটা করতে হবে। একবার শুরু হলে, একবার চেষ্টা করলে এইখানে আর এখন, ঠিক যেখানে আমি আছি, নিজের জন্য কোনো অজুহাত দেখাচ্ছি না নানা কিছু বলে হয়তো অন্য কোথাও আরো সহজ হতো সবকিছু, কোন বিরাট বক্তৃতা ছাড়া আর সাড়ম্বর ভাবভঙ্গি ছাড়া, কিন্তু আরো ক্রমাগত চালিয়া যাওয়া সম্প্রীতিতে বাঁচা ‘সত্তার কণ্ঠস্বর’-এর সাথে, যেমন আমি বুঝতে পারি এটা নিজের ভেতরে যে মুহূর্তে আমি সেটা শুরু করি, আমি আকস্মিক আবিষ্কার করি, আমার বিস্ময় নিয়ে, যে আমি তো একমাত্র একজন নই এমনকি প্রথমজনও নই এমনকি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনও নই যাত্রা শুরু করেছি এই পথের দিকে।
সত্যিই সবকিছু হারিয়ে গেছে কিনা কিংবা নির্ভরশীল কিনা একেবারে কিংবা আমি হারিয়ে যাই বা না যাই।