আমরা অনেক সময় বলি, এটা সিনেমা হয়নি, টিভি নাটক হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের এক পরিচালক ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের ছবি সম্পর্কে এমন কথা প্রচুর শোনা যায়। সে আলোচনায় না-গিয়ে বরং এই আলোচনা করা যাক- টিভি নাটক আর সিনেমার পার্থক্য কী?
আগের দিনে এই পার্থক্য করা খুব সহজ ছিল। মানে আকৃতিগত দিক থেকে দুটো মাধ্যমই আলাদা। প্রথমত টিভি হলো ছোটবাক্স আর সিনেমা হলো বড় পর্দা। পর্দার আকারের কারণেই টিভিতে ক্লোজআপের ব্যবহার বেশি। গল্প বলাই হয় ক্লোজআপ আর টু শট কেন্দ্রিক উপায়ে। অর্থাৎ একজনের মুখের অভিব্যক্তি, অন্যজনের প্রতিক্রিয়া, দুইজনের কথোপকথন এই ভঙ্গিতেই ক্যামেরা চালানো হয়। অর্থাৎ দৃশ্যটা ধরা পড়ে দুয়েকজনকে কেন্দ্র করেই।
আর সিনেমায় বিরাট ক্যানভাস নিয়ে দৃশ্য ধরা হয়। যাকে বলে লং শট; সেটা সিনেমাতে বেশি। দূরের দৃশ্য, প্রকৃতি, অনেক বড় ক্যানভাসে নদী, সমুদ্র, পাহাড়ের চিত্রায়ণ করা হয় সিনেমার ক্ষেত্রে। কিন্তু এই পার্থক্য এখন তো আর মানা যাচ্ছে না। কারণ টিভির পর্দাও এখন ৪০-৫০ ইঞ্চি ছাড়িয়ে গেছে। ১০/২০ স্কয়ার ফিটের ঘরের দেয়ালে এতো বড় স্ক্রিন সিনেমার প্রজেকশন পর্দার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আবার ঘরে ঘরে হোম থিয়েটার, সারাউন্ড সাউন্ড সিস্টেম এসে গেছে। ফলে ঘরের পাতলা টিভিতেই সিনেমার ডিটেইল দৃশ্যসমূহ দেখানো সম্ভব।
আগে সিনেমা শ্যুট করা হতো ফিল্মে। ১৬ বা ৩৫ মিমি ক্যামেরায় ধারণকৃত সিনেমার ছবির মান আর টিভি ক্যামেরার ছবির মানের বেশ-কম ছিল। এখন সেটাও নেই। একটু ভালো বাজেটের টিভি নাটক আর সিনেমা দেখা যায় একই মানের ক্যামেরায় ধারণ করা হচ্ছে। ইদানিং টিভি নাটকেও সিনেমার মতো শব্দ ধারণে যত্নবান, সিজিএফ (কম্পিউটার জেনারেটেড গ্রাফিক্স) ব্যবহার হচ্ছে। ফলে কারিগরি দিক দিয়ে টিভি আর সিনেমার পার্থক্য নিরূপণ করা খানিকটা জটিল হয়ে যাচ্ছে। এমনকি হালের দেশি-বিদেশি যে ওয়েব সিরিজগুলো বিশ্বব্যাপী মুক্তি পাচ্ছে কারিগরি মানের দিক থেকে সেগুলো সিনেমার চেয়ে মোটেও পিছিয়ে নেই।
একটা অর্থনৈতিক পার্থক্য তো আছেই। টিভি অনেক কম বাজেটের মিডিয়া, অন্যদিকে সিনেমা মানেই কোটি কোটি টাকার ব্যাপার। টিভির বাজার সিনেমার মতো অমন বিশ্বব্যাপীও নয়। কিন্তু এই পার্থক্যও এখন খুব সুচারু নয়। সিনেমার বড় বড় অভিনেতারা টিভিতে কাজ করছেন। টিভিতেও ব্যয়বহুল নাচ-গান, অ্যাকশন দৃশ্য চিত্রায়িত হচ্ছে। আবার কম বাজেটেও অনেক বিশ্বমানের সিনেমা তৈরি হয়েছে। কাজেই কারিগরির মতো অর্থনৈতিক পার্থক্য দিয়েও টিভি আর সিনেমাকে আলাদা করা যাবে না, যায় না প্রায়শই।
কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে প্রায়ই এই তর্ক বা আলোচনা ওঠে। কোনো কোনো সিনেমা দেখে আমরা বলি- ধুর, এটা টিভি নাটক। আবার কোনো কোনো টিভি নাটক দেখে বলে ফেলি- আরে এ তো সিনেমার মতো! এই বলে ফেলার নিহিতার্থ তো আছেই। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যদি বলি, তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, স্বাধীনতার পর একদল মঞ্চকর্মীরাই টিভি আর সিনেমাতে এসেছে। ফলে তাদের কারো কারো বা মৌল ধারণাতে মঞ্চ, টিভি কিংবা বেতার নাটকের বয়ান ভঙ্গি রয়ে যেতে পারে। মাধ্যমগত, ভাষাগত দ্বিধা তৈরি হতে পারে। আবার এ দেশের সাধারণ দর্শক তৈরি হয়েছে যাত্রা, থিয়েটার বা টিভি দেখেই। ফলে তাদের রুচি বা চিন্তাতেও একটা মাধ্যমগত জটিলতা হতেই পারে। বিশুদ্ধ সিনেমা থেকে আসা, সিনেমার ভাষা, ভঙ্গি, ইতিহাস, কারিগরি জানা নির্মাতা তো আমাদের কম, দর্শক তার চেয়েও কম। আরো কম রয়েছে যোগ্য সমালোচক। যে সমালোচক শিল্পকলার নানা মাধ্যমের বিভেদ ও মিলগুলোকে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারতেন।
এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা
টিভি নাটক, যাত্রা, মঞ্চ নাটক, বেতার নাটক ইত্যাদিতে অভ্যস্ত এই দর্শক এবং নির্মাতাদের অভিজ্ঞতায় ধারাবাহিকভাবে গল্প বলে যাওয়া এবং দেখে যাওয়াটাই হলো দৃশ্যমাধ্যমের মূল কথা। ফলে, ‘এক দেশে ছিল এক রাজা, আর তার ছিল... তারপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’ এই সরল সমীকরণে হাজার হাজার টিভি নাটক আর সিনেমা তৈরি হয়েছে এ দেশে। তাই আলাদা করে মাধ্যমগত চরিত্র ধরাও আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবুও এর মাঝে জহির রায়হান যখন ‘জীবন থেকে নেয়া’, আলমগীর কবির যখন ‘সীমানা পেরিয়ে’ বানিয়েছেন কিংবা সমকালের তারেক মাসুদ ‘মাটির ময়না’, হুমায়ূন আহমেদ ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ কিংবা অতি সাম্প্রতিককালে নাসির উদ্দীন ইউসুফ ‘আলফা’ বানিয়েছেন- এগুলোর মধ্যে আমরা টেলিভিশন নাটক নয়, সিনেমা দেখার স্বাদ খুঁজে পেয়েছি। এমন আরো গোটা বিশেক সিনেমার নাম বলা যাবে যা আদতে টিভি নাটকের বা মঞ্চ নাটকের বা যাত্রার আদলে তৈরি নয়। সেগুলো সিনেমার আদলেই তৈরি। তা এই টিভি নাটক আর সিনেমার আদলটা নিয়ে কথা বলা যাক। কিন্তু তারও আগে টিভি আর সিনেমা দেখার ধরন নিয়ে একটু বলি।
টিভি প্রথমতই একটি ঘরোয়া মাধ্যম, আরো ঠিক করে বললে, এটা পারিবারিক মাধ্যম। বসার ঘর, শোবার ঘর যে কোনোখানে একটা টিভি রাখা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে টিভি ঘরের ড্রয়িংরুমে অহেতুকও চলে। কেউ দেখছে না, টিভি চলছে আবার ঘরের সবাই মিলে কোনো জনপ্রিয় সিরিয়াল দেখছে এমন চিত্রও আছে। টিভি যেমন একদিকে ঘরের আসবাবের অংশ, তেমনি পরিবারের সবার বিনোদনও বটে। টিভি অনুষ্ঠানের (এমনকি নাটকের) ধরনেও তাই একটা সবজি-খিচুড়ির আমেজ আসে। মানে ডাল, চাল, সবজির বাহারি মিশ্রণের মতো টিভিতে একটু হাসি, একটু কান্না, একটু বিনোদন, একটু গাম্ভীর্য মিলে মিশে থাকে। আর পারিবারিক মাধ্যম হওয়াতেই টিভিতে যে কোনো ধরনের গল্প দেখানো যায় না।
সিনেমার ব্যাপারটা কিন্তু আলাদা। প্রথমতই আপনাকে সিনেমা দেখতে হলে প্রস্তুতি নিতে হবে। আগে থেকে দিন, তারিখ, সময় ঠিক করে, হলে টিকিট কেটে আপনাকে বসতে হবে নিজস্ব সিটে। বাকী অনেকের সঙ্গে এখানে আপনিও একজন সাধারণ ভোক্তা। এটা আপনার বাড়ি নয়, এমনও প্রয়োজন নেই যে বাপ-মা-চাচা-খালু-সন্তান-নাতি নিয়ে সিনেমা হলে যেতে হবে। সেটা বরং লোকে কম যায়। বন্ধু কিংবা প্রেমিক হলে সিনেমা দেখার একটা আলাদা আমেজও আসে। আর সিনেমার নির্দিষ্ট ঘরাণা আছে। আপনি আগে থেকেই জেনে যাচ্ছেন, ভূতের ছবি দেখছেন নাকি হাসির ছবি, প্রেমের ছবি নাকি মারামারির ছবি। এসব ঘরাণারও মিলমিশ হয়, সেটা বলিউডের ছবিতেই বেশি হয়। তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক হিন্দি ছবিকে ‘মসালা মুভি’ বলে। এসব মুভিতে একটু এলাচ, দারুচিনি, মরিচ, হলুদ, আদা, রসুনের মতো নাচ-গান-মারামারি-প্রেম সবই থাকে একাকার হয়ে। এই ছবির বাজারদরও ভালো। লোকে খুব খায়।
কিন্তু হলে আমরা এর বাইরের ছবিও দেখতে যাই। অস্কারে সেরা পুরস্কার পাওয়া ছবি, কানে সেরা পুরস্কার পাওয়া ছবি, কুরোশাওয়া, মৃণাল, ঋত্বিক, সত্যজিৎ, ফেলিনির মতো ধ্রুপদী পরিচালকের ছবি আমরা দেখতে যাই। অর্থাৎ সিনেমা, ফিল্ম ওরফে মুভির একটা বড় ঘরানা আছে আর সেই ঘরানা অনুযায়ী বাজার আছে। দালি, বুনুয়ুলের ১৭ মিনিটের চূড়ান্ত নীরিক্ষাপ্রবণ ‘উন শিউ আন্দালিউ’ (এন আন্দালুসিয়ান ডগ) নানা চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে দেখানো হলে এখনও অনেকেই দল বেঁধে দেখতে যায়। সেই ১৯২৯ সালে নির্মিত সিনেমা আমরা এখনও দেখছি। চ্যাপলিনের বানানো সিনেমাগুলো যুগের পর যুগ ধরে প্রদর্শিত হচ্ছে। ১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালি’ বানিয়েছিলেন যা এখনও অনেক উৎসবে প্রদর্শিত হয়। মোদ্দা কথায়, সিনেমার একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এর সরংক্ষণ যোগ্যতা আছে। সিনেমা টিকে থাকে যুগের পর যুগ, এমনকি শতাব্দী পেরিয়েও। টিভি নাটকের ভাগ্যের সে সুযোগ কম।
এখানে সিনেমার আরেকটি বড় দিক বলে রাখা জরুরি। সিনেমা একটা আন্দোলনও বটে। বিশ্বব্যাপী সিনেমা নিয়ে একাধিক আন্দোলন, মতবাদ, ঘরানা তৈরি হয়েছে। বহু দর্শকই সিনেমাকে নেহাত বিনোদন ভাবেন না। ঋত্বিক ঘটকের মতো বহু পরিচালক আছেন যারা বিনোদন দেয়ার জন্য সিনেমা বানান না। ‘দ্যা ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ কিংবা ‘ট্রায়াম্প অব উইল’-এর মতো প্রোপাগান্ডা সিনেমাও বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়। ‘দ্য বার্থ অব আ ন্যাশন’-এর মতো তীব্র বর্ণবাদী ছবি বানিয়েও গ্রিফিথ থাকেন চলচ্চিত্র ইতিহাস আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। অভিব্যক্তিবাদ, পরাবাস্তববাদ, নয়া বাস্তববাদ এমনি বহু শৈল্পিক মতবাদের আবির্ভাব হয়েছে সিনেমার সূত্র ধরেই।
তুলনায়, টিভি নাটক অনেক বেশি সমকালীন আবার ক্ষণস্থায়ী মাধ্যমও বটে। ইংরেজিতে টিভিকে বলাই হয় ‘ইরেজ মিডিয়া’, কেউ কেউ আরেক কাঠি এগিয়ে বলেন, ‘টয়লেট পেপার মিডিয়া’। মানে দেখা শেষ এবার ফ্ল্যাশ করে দাও। এদেশের বহু বিখ্যাত টিভি নাটক যা আমাদের মতো বয়স্ক চোখে এখনও স্মৃতির প্রলেপের মতো রয়ে গেছে। কিন্তু তার কোনো অস্তিত্ব আর নেই। মানে, টেলিভিশন প্রচারকারী কর্তৃপক্ষই সে সব মুছে ফেলেছেন। টিভি নাটক যে সংরক্ষণযোগ্য সেটা বিশ্বব্যাপী কম লোকই মেনেছেন, মানেন। কারণ টিভিটা দেখতে হয় অনেকটাই আরাম আয়েশে এবং সাময়িক বিনোদন হিসেবেই। অথচ সেই ১৯০২ সালে বানানো ‘আ ট্রিপ টু মুন’ কিংবা ১৯০৩ সালে ‘দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি’ আমরা আজও দেখতে পাই। শুধু দেখি না, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করি শতাধিক বছর পার করেও। মানে সিনেমার একটা স্থায়ীত্ব আছে। সিনেমার সেই শক্তি আছে যাকে আমরা অমরত্ব মনে করি। চ্যাপলিন মরে গেছেন, উত্তম কুমার স্বশরীরে নেই, কিন্তু তাদের সিনেমা, তাদের অভিনয় এখনও সমুজ্জ্বল। ধারণা করা যায়, এগুলো কোনদিন পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে না।
‘হাওয়া’ সম্প্রতি বাংলা চলচ্চিত্রে সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে
নাটক প্রসঙ্গে বলছিলাম, শুধু এ দেশেই নয়, বিদেশেও টিভি নাটকের সঙ্গে থিয়েটারের প্রভাব প্রকট। ক্ষেত্র বিশেষে রেডিও নাটকের প্রভাবও বেশি। মঞ্চ বা রেডিও নাটকের ক্ষেত্রে যেটা হয়, কাহিনী এগোয় সংলাপ ধরে। ফলে টিভি অনেক ক্ষেত্রেই একটা বাচাল মিডিয়া। বকবক করে এখানকার প্রায় সব চরিত্রই। নাট্যকার ভালো সংলাপ লিখতে জানলে তবে তো কথাই নেই, টিভি নাটকের সব চরিত্রই তখন হয়ে ওঠে চৌকস, বাকপটু। সিনেমা কিন্তু তা নয়। ভালো সিনেমা বকবক করার চেয়ে নিস্তব্ধতায় বেশি আস্থা রাখে। অবশ্য বাণিজ্যিক সিনেমার বড় একটা উপাদান হলো খুব চালবাজি সংলাপ। নায়ক কিংবা খলনায়ক এমন কিছু বলবে যা মানুষের মুখে মুখে ঘুরবে। কিন্তু বাজারি সিনেমার বাইরে বিশ্বব্যাপী শৈল্পিক সিনেমার যে বিশাল ইতিহাস আর ঐতিহ্য আছে সেখানে অন্তত সিনেমা সংলাপ প্রধান নয়। আদতে দৃশ্যময়তা সিনেমার সবচেয়ে বড় শক্তি। দৃশ্যময়তা, পরিমিত সংলাপ যদি সিনেমার শক্তি হয় রেডিও তার উল্টো। রেডিও নাটকে দৃশ্য নেই, আছে সংলাপ আর শব্দ নির্ভর কল্পনার জগত। মঞ্চও দৃশ্যসজ্জাটা টিভি বা সিনেমার মতো অনন্ত সম্ভাবনাময় নয়। নির্দিষ্ট ঘেরাটোপেই থাকে মঞ্চ। এবং অনেক ক্ষেত্রেই এখানকার অভিনয় হয় একটু উচ্চকিত। সংলাপ শেষ সারির দর্শকের কাছেও পৌঁছানোর দায় তার থাকে। প্রচুর কোরিওগ্রাফি আর সংলাপ, সঙ্গে লাইভ মিউজিক থাকে মঞ্চে। আর টিভি নাটক রেডিও, মঞ্চ’র সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারে মাধ্যমগত সুবিধার কারণেই। এখানে দৃশ্য, সংলাপ ইত্যাদি ইচ্ছা মতো ব্যবহার করা যায়, প্রয়োজনে সিনেমার মতো লং শট নেওয়া যায়। এখন তো টিভি নাটকেও ড্রোন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। তারপরও আমাদের টিভি নাটক এখনও মূলত সংলাপ নির্ভর। নৈঃশব্দের জাদুকরি ক্ষমতা টিভি নাটকে কমই ব্যবহৃত হয়।
মাধ্যমগত দিক থেকে তাই রেডিও বা মঞ্চের চেয়ে টিভি নাটক অনেক বেশি সিনেমার কাছাকাছি। এখানেই ঝামেলাটা হয়েছে। আমাদের দেশের অনেক চলচ্চিত্র পরিচালকই টিভি থেকে সিনেমায় এসেছেন। ফলে তাদের সিনেমা ক্ষেত্রবিশেষে টেলিভিশনের ফ্রেমে আটকে থাকে। এই আটকে থাকাটা আদতে কারিগরি সমস্যা নয়, এটা দর্শনগত সমস্যা। টিভি আর সিনেমার দর্শন আলাদা। এই উভয়ের মধ্যে আছে আচরণ ও মনোভাবের ফারাক।
টিভি আর সিনেমা দুটোকে আমরা দুইভাবে দেখি। মাধ্যমগত কারণেই টিভির দর্শকের চেয়ে সিনেমার দর্শক বেশি মনোযোগী। টিভি যদি হয় এলোপাথারি আড্ডা কিংবা ঘরোয়া গল্পগুজবের মতো, সিনেমা সেক্ষেত্রে দিন-তারিখ ঠিক করা মিটিং বা ডেটিংয়ের মতো। ফলে, সিনেমায় অতো ভেঙে বলতে হয় না। সিনেমার দর্শক কোলের শিশু না। তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয় না। সিনেমার দর্শক হলে ঢোকার আগে যেমন খোঁজ খবর নিয়ে আসেন, প্রয়োজনে রিসার্চ করেন, তেমনি হল থেকে বেরিয়ে গেলেও তার কাজ শেষ হয়ে যায় না। সিনেমা দর্শক অনেকটা রিলে রেসের দৌড়বিদের মতো, একজন কাঠি নিয়ে দৌড়ে আরেকজনের হাতে কাঠিটি অর্পণ করে। এভাবে একটা পুরো দৌড় শেষ হয়। সিনেমাও এক দশক থেকে আরেক দশক, যুগ থেকে যুগে, শতাব্দী থেকে শতাব্দী দৌড়ায়। সিনেমা, সোজা কথা লং রেসের ঘোড়া। আর টিভি? ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর।
এখানে এসে একটু বলে নেওয়া দরকার, এটুকু পড়ে যদি কারো মনে হয় যে নাটক আর সিনেমার আলোচনায় আমি পক্ষপাত করছি, একজনকে ছোট বা আরেকজনকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করছি, তাহলে বলে রাখা ভালো, সেটা আমার ইচ্ছা বা প্রবণতা নয়। কেউ কালো হলে সে কালোই, কেউ ফর্সা হলে সে ফর্সাই, কোনো ফল টক, কোনো ফল মিষ্টি, কোনো পোশাক আমরা কিনি দশ বছর চালানোর কথা ভেবে, কোনো পোশাক কিনি ছয়মাস পরার জন্য। কাজেই এটা ছোট-বড়’র কথা নয়। যে আমাকে সাময়িক আরাম দেয়, আনন্দ দেয়, তাকেও দরকার, আবার যে আমাকে দীর্ঘকালের সঙ্গ দেয় তাকেও তো দরকার। আরেকটা কথা বলে রাখা ভালো, টিভি, সিনেমার চেয়ে মঞ্চ নাটক অনেক অনেক বছরের পুরনো মাধ্যম। যে ধ্রুপদী গ্রীকনাটকগুলো আজও আমরা পড়ি, চর্চা করি তা আড়াই হাজার বছর আগের। এতো পুরনো এই নাটকগুলো থেকে আমরা এখনও সিনেমা বানাই, চৌদ্দ শতকের শেক্সপিয়রের মঞ্চ নাটক থেকে কুরোশাওয়া, গদার, বিশাল ভরদ্বাজ, সৃজিত মুখার্জিগণ সিনেমা বানান। কাজেই থিয়েটারের সঙ্গে টিভি, সিনেমার বিরোধ নেই, মিলই প্রচুর। তবে ভিন্নতার ব্যাপারটা পরিবেশনার ধরনেই আসে।
‘রক্তকরবী’। মঞ্চনাটক আলাদা এক শিল্পমাধ্যম
আদতে সিনেমা একটা রাক্ষস মিডিয়া। সে যাকে পায় তাকেই গ্রাস করে। নাটক, চিত্রকলা, সাহিত্য, নৃত্য, সঙ্গীত, স্থাপত্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সব কিছুকেই সে আয়ত্ব করে, নিজের করে নেয়। সিনেমা যৌগিক মাধ্যম, একাধিক মৌলিক মাধ্যমকে গলাধঃকরণ করার এবং হজম করার দানবীয় শক্তি তার আছে। কিন্তু এতো কিছু গ্রহণের পরও যে সিনেমা দেখে মনে হয় একটা সিনেমা দেখলাম সেই সিনেমাই তো স্বার্থক সিনেমা। মানে পোলাও আর খিচুরির চালটা এক হলেও স্বাদটা তো আলাদাই। একই মাছ ভাজা হয়, ঝোল হয়, ভূনা হয়, ভাপানো হয়, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই স্বাদ আলাদা। এই ঝালঝোল-ভূনা-ভাজা-সেদ্ধ করাই হলো একেকটা মাধ্যম। মাছটা যদি শিল্পকলা তবে এর নানান পরিবেশনা হলো শিল্পকলার নানান মাধ্যম। একটা মাছের আলোকচিত্র, চিত্রকলা আর চলিচ্চত্র রূপায়নে পার্থক্য তো থাকবেই। কাজেই মূল পার্থক্যটা এখানে বয়ানের ভঙ্গিতে (Narrative)। একই ইলিশ মাছ রান্না করা যায় কতো না পদ্ধতিতে!
ক্ষমা করবেন, আমি খুব সরলীকরণ করে ফেলছি। এটা অবশ্য ইচ্ছাকৃতই করছি। বড় বড় তত্ত্বজ্ঞান আমার নেই। সেটা দিয়েও কিছু বুঝতে চাই না, বোঝাতেও চাই না। ফিরে আসি মোদ্দা কথায়। ধারাবাহিক কাহিনী বলা, সংলাপ প্রক্ষেপণ, দৃশ্যায়নের নানা কৌশল টিভি ও সিনেমা উভয় মাধ্যমেই আছে। শট ডিভিশন, কথা, ছবি, সুরের মিশ্রণ এ সবের কমবেশিও আছে দুই মাধ্যমেই। তাই আমার বিবেচনায় এগুলো দিয়েও কোনটা সিনেমা, কোনটা নাটক তা সুর্নিষ্ট করা মুশকিল।
আমার বিবেচনায় নাটক আর সিনেমার সবচেয়ে বড় ফারাক হলো উপস্থাপন পন্থায় (approach)। দর্শককে আসলে আমি কী দেখাতে চাচ্ছি, কেন দেখাতে চাচ্ছি, কীভাবে দেখাতে চাচ্ছি তার উপরেই নির্ভর করে, একটা সিনেমা নাটক হয়ে যায়, নাকি একটা নাটক সিনেমা হয়ে যায়। নাটক ও সিনেমার দর্শক চরিত্র নিয়ে আগেই কথা বলেছি। সেদিক বিবেচনা করে বলা যায়, সিনেমা অনেক বেশি দর্শকের সম্পৃক্ততা আসা করে। সিনেমা অনেকটা দূরবীনের মতো, দূরের জিনিসকে কাছে টেনে আনে, জীবনকে আরো দূরের আকাশে নিয়ে যায়। সিনেমার পর্দাটাই শুধু বড় না, এখানে বলার বিষয়টিও বড় এবং বলার আয়োজনটিও বড় হতে হয়।
তুলনায় টিভি নাটক অনেক বেশি আনুবীক্ষণিক। সে ঘরের ভেতরে উঁকি মারে, ঘরোয়া গল্প বুনে যায়। চেনা মানুষ, চেনা আদল নিয়ে টিভির কাজ। টিভি কোনো আকস্মিক আক্রমণ, আঘাত করে না আমাদের চেতনায়। আমাদের ভাবনা, বোধ, চেতনায় তুলনায় সিনেমা অনেক বেশি আক্রমণ করে। টিভি বড় বিশ্বস্ত, অনেকটা নিজের পোষা কুকুর-বিড়ালের মতো, সিনেমার ভরসা কম, সে বাঘ-ভাল্লুক হয়ে উঠতে পারে যে কোনো সময়। দর্শক যা দেখে অভ্যস্ত, যুগ যুগ ধরে যা চলে আসছে তা দেখানোই টিভির কাজ। অন্যদিকে যে কোনো সিনেমা যে কোনো সময় একেবারেই নতুন কোনো বিষয়, অচেনা কোনো ভাবনাকে নিয়ে গড়ে উঠতে পারে। সিনেমার গল্প মহাশূন্য থেকে মহাসাগর পর্যন্ত সর্বত্রগামী। সিনেমার গল্প অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের মধ্যে অনায়াসে আসা-যাওয়া করতে পারে।
টেলিভিশন রাষ্ট্রীয় হয়, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়, ব্যক্তি মালিকানাতেও হয়। সিনেমার প্রযোজনাতেও অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান বা ধনাঢ্য ব্যক্তি থাকে। দুটোই বাণিজ্যিক মাধ্যম। কিন্তু টিভি নাটকের দায়টা আলাদা। সে দর্শককে খুশি করে একটা সরল গল্প দিয়ে, আরাম দিয়ে, বিপ্লব করে না। সিনেমা কিন্তু বিপ্লব করে, প্রতিবাদ করে, চ্যালেঞ্জ করে। সিনেমার জন্যও দেশে দেশে সেন্সর বোর্ড আছে, প্রযোজকের চাপ আছে, দর্শক চাহিদার বাঁধাধরা ফর্মুলা আছে; তবু সিনেমা ঝলসে ওঠে আপন শক্তিতে। স্ফুলিঙ্গ থেকে কখনো কখনো বিরাট বিস্ফোরণ হয়ে ওঠে সিনেমা। তুলনায় টিভি নাটক অনেক বেশি নিরীহ, আরামদায়ক মাধ্যম।
ওয়েব সিরিজ- এসেছে নতুন ট্রেন্ড
টিভি নাটকের দায়বদ্ধতার জায়গাটি কম। সত্যানুসন্ধান, প্রশ্ন করা এ সব টিভি নাটকের কাজ নয়। সে মূলত বিনোদন বিতরণ করবে। টিভি নাটক তার আয়টি মূলত তুলে নেয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। নাটকের ফাঁকে ফাঁকে সে বিজ্ঞাপন বিরতি নেয়। সত্যি কথা বলতে, বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্যই যেন টিভি নাটকের সৃষ্টি। টিভি নাটক অনেক বেশি বিজ্ঞাপন নির্ভর। পণ্য বিক্রি করা বা পণ্যের প্রচার করা টেলিভিশন প্রতিষ্ঠানের একটা বড় কাজ। এটিই তার আয়ের মূল উৎস। সিনেমার ক্ষেত্রে কিন্তু প্রযোজক পরিচালক অনেক বেশি স্বাধীন। কখনো সিনেমায় বিজ্ঞাপন থাকলে তা এমনভাবে রয়ে যায় যে দর্শক আলাদা করে ধরতেও পারেন না। সিনেমা সাধারণত আমরা টানা দেখি। মধ্যবর্তী একটি বিরতিতে সিনেমা দর্শক একটু হাত-পা নাড়ানো, হাল্কা নাস্তা করা কিংবা নিজেকে একটু হাল্কা করার সুযোগ পায়। সেই সুযোগটুকুও পূর্ব নির্ধারিত। টিভি নাটক বিজ্ঞাপন দাতাদের প্রতি বেশি দায়বদ্ধ। সচারাচর কাউকে রাগানো, ক্ষেপিয়ে তোলা, উত্তেজিত করে না টিভি নাটক। টিভিতে হাল্কা কমেডি, পারিবারিক গল্প, প্রেমময় আবেগই প্রাধান্য পায়। খুব অ্যাকশন, বড় বড় রাজনৈতিক বক্তব্য, ইতিহাস-ঐতিহ্যের চর্চার সুযোগ কম। টিভিতে বাজেটও যে কম থাকে। তবে ব্যতিক্রম তো আছেই।
আমার কাছে টিভি নাটক আর সিনেমার একটা বড় পার্থক্য মনে হয় এর দৈর্ঘ্য। মানে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা যতোক্ষণেরই হোক সোয়া ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা বা তিন ঘণ্টায় সে একটা পূর্ণাঙ্গ বিষয় নিয়ে কথা বলে, একটা পূর্ণ আনন্দ কিংবা বেদনার অনুভূতি সৃষ্টি করে। নির্দিষ্ট একটা প্লট বা ঘরানাকে কেন্দ্র করেই সিনেমা তৈরি হয়। তুলনায় টিভি নাটকে পূর্ণাঙ্গতার সুযোগ কম। সেখানে কাহিনী এগোয় মুক্ত চালে। গল্পের অনেক ডালপালা গজায়। আর টিভি নাটক যদি দীর্ঘ ধারাবাহিক হয়, তবে তো মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। অনেকগুলো এপিসোড, অনেকগুলো ঘটনা নিয়েই একটা টিভি সিরিজ বা নাটক। অন্যদিকে সিনেমা অনেক বেশি কাহিনীর স্বয়ংসম্পূর্ণতায় মনোযোগী।
দর্শক সংখ্যার দিক থেকে কিন্তু টিভি সিরিজ বা টিভি নাটক এগিয়ে থাকে। আজকে ঘরে ঘরে টিভি আছে, কোনো কোনো ঘরে একাধিক টিভি আছে। কাজেই একটা টিভি নাটক চাইলেই লাখ-কোটি দর্শকের ঘরে পৌঁছে যায় প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই। সিনেমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। সিনেমার কাছে মানুষকে যেতে হয়। কয়টা সিনেমা হলে মুক্তি দিয়েছে, কয়টা করে সিট আছে, কতোদিন ধরে সিনেমাটা চলছে এইসব হিসাব নিকাশ সিনেমার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। একটি খুব ভালো সিনেমাও হয়তো একটা খুব মাঝারি মানের টিভি নাটকের সমান দর্শক পায় না। আবার একটি সিনেমাকে বহু দর্শকের কাছে পৌঁছতে হলেও বহুদিন ধরে বহু হলে চালাতে হয়। তবে ইদানিং টিভিতে এমনকি অনলাইনেও সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে দর্শকের সংখ্যার হিসাবটি বদলে যেতে পারে।
বদলে যাচ্ছে দর্শকের চরিত্রও। আব্বাস কিয়ারোস্তামি থেকে নাসির উদ্দীন ইউসুফ সিনেমায় নতুন ভঙ্গি আনছেন, তারা টিভি নাটক, মঞ্চ নাটক, সিনেমার নির্দিষ্ট ঘরাণা ভেঙে দিচ্ছেন। নতুন দিনের দর্শককে নতুন ভাষা ও ভঙ্গিতে নিয়মিত চ্যালেঞ্জ করছেন আজকের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকারগণ। কল্পবিজ্ঞান, যাদুবাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, ভৌতিক, অতিপ্রাকৃত, উত্তর-আধুনিক, নিউ-নয়্যার, ব্ল্যাক-হিউমার কতো রকমের সিনেমাই না হচ্ছে আজকের দিনে এসে। লেখার শেষে একটা কথা বলতে চাই, সিনেমার যে অ্যাকশন, রোমান্স, বায়োগ্রাফি ইত্যাদি নানা শ্রেণীকরণ আছে, সেখানে কিন্তু ‘ড্রামা’ বলেও একটা শ্রেণীকরণ আছে। এখানে ‘ড্রামা বা নাটক’ বলতে সেই সিনেমাকেই বোঝানো হয়েছে যার গল্প অনেক বেশি নাটকীয়।
তবে নাটকই হোক, সিনেমাই হোক, একে অপরের থেকে বৈশিষ্ট্য ধারকর্জ করতে পারে, কে কার চেয়ে বড় সেই লড়াইয়ে না-গিয়ে প্রত্যেকে যার যার মতো করে শিল্পগুণ তৈরি করতে পারে। একটা শিল্পসম্মত টিভি নাটক আর একটা শিল্পসম্মত সিনেমার জন্য আমাদের চেষ্টাটা থাকতে হবে। আর সে চেষ্টার জন্য, প্রতিটি শিল্প মাধ্যমের বৈশিষ্ট্য চিনতে হবে। পেন্সিলে আঁকা রেখাচিত্রও যেমন চিত্রকলা তেমনি তৈলচিত্রও চিত্রকলা। একই ভাবে টিভি নাটকও শিল্প, সিনেমাও শিল্প।