কবি কামাল চৌধুরী, সমকালীন বাংলা কবিতার শক্তিমান কবি। তিনি এখনো, এ সময়েও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বাংলাদেশের কবিতাকে উচ্চ জায়গায় নিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার পর সত্তর দশকে বাংলা কবিতায় যে তরুণ তুর্কীদের কথা আমরা বলি, তাদেরই প্রধানতম কামাল চৌধুরী। তিনি তার কবিতার কথা, প্রকাশিত গ্রন্থ, কবিতার অনুবাদ এবং সমকালীন বাংলা কবিতার নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন কবি শিহাব শাহরিয়ারের সঙ্গে।
শিহাব শাহরিয়ার: ২০২২ সালে ভারতের কলকাতার দে’জ প্রকাশনা সংস্থা থেকে আপনার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে এবং আমরা জানি যে, হিন্দি, ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় আপনার কবিতা অনূদিত হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি আরবি ভাষায় আপনার নির্বাচিত কবিতার বই ‘কাসাইদ মুকতারা’ বেরিয়েছে মিশর থেকে। প্রথম বাঙালি কবি হিসেবে এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
কামাল চৌধুরী: এটা আমার জন্য আসলে খুবই গৌরবের। কারণ আমিও দেখেছি যে, খুব বেশি কিন্তু আমাদের কবিতা সেভাবে অনুবাদ হয়নি। আমার নির্বাচিত কবিতা যেটা ইংরেজিতে বেরিয়েছে, সেই ইংরেজি থেকে নিয়েই মূলত আরবিতে এই অনুবাদ গ্রন্থটি হয়েছে। প্যালেস্টাইনের একজন বিখ্যাত অনুবাদক সেটি করেছেন। আমি খুব সৌভাগ্যবান বলবো এই অর্থে যে, মিশরের একটি প্রকাশনা সংস্থা কায়ান পাবলিশিং হাউজ, তারা জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কায়রো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ারে আমার আরবি বইটি প্রকাশ করেছে ‘কাসাইদ মুকতারা’ অর্থাৎ কামাল চৌধুরীর নির্বাচিত কবিতা নামে। আপনি যেটা বললেন যে, আমাদের দেশের কবিতা ওভাবে অনুবাদ হয়নি। আর আরবি ভাষা আসলে তো একটা বিশাল জনগোষ্ঠী এবং এই ভাষাভাষীর অনেকগুলো রাষ্ট্র আছে। আরবি ভাষার প্রচুর পাঠক, আমার কবিতা যদি এভাবে তাদের কাছে পৌঁছায়, তাহলে তো আনন্দের বিষয় অবশ্যই। আমাকে অনেকে বলেছেন, অনুবাদ যদি ভালো হয় স্বাভাবিকভাবে সেটা পৌঁছাবে। অনেকেই বলেছেন, অনুবাদ যিনি করেছেন তিনি যেহেতু বিখ্যাত অনুবাদক, ভালো অনুবাদ করেছেন। আমি আশা করছি যে, আমার কবিতা আরবি ভাষাভাষী অঞ্চলে যারা কবিতা ভালোবাসেন সেই পাঠকদের কাছেও আদৃত হবে। এটা আমার প্রত্যাশা।
শিহাব শাহরিয়ার: আপনি ১৯৭৪ সাল থেকে লিখছেন। আপনার প্রথম গ্রন্থ বের হয় ১৯৮১ সালে ‘মিছিলের সমান বয়সী’। এই একটি কাব্যগ্রন্থ দিয়েই আপনি বাংলা কবিতায় আপনার আগমন বার্তা দিয়েছেন অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে।
কামাল চৌধুরী: কবিকে তো শেষ অব্দি সত্যিকার অর্থে আসলে তার দেশ, সমাজ এবং কালের কণ্ঠস্বরে উঠতে হয়। আমি আমার কবিতায় সেই চেষ্টা সবসময় করি। কতটা উঠতে পেরেছি, সেটা অবশ্যই পাঠক বিবেচনা করবে। আমার ‘মিছিলের সমান বয়সী’ যে গ্রন্থটা, সেটা এমন একটা সময়ে রচনা, আপনারা জানেন যে, আমরা আসলে যে সময়টায় কবিতা লিখতে শুরু করেছি, আমরা স্বাধীনতা-উত্তর কালের প্রথম যে প্রজন্ম অর্থাৎ সত্তরের কবি। তখন কিন্তু আমাদের বিশাল একটা অর্জন স্বাধীনতা পেয়েছি এবং পরবর্তীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরে আমাদের যে স্বপ্নভঙ্গ এবং স্বপ্নভঙ্গের পরের যে প্রতিবাদের একটা সময় সেই সময়ের কবি আমরা। অর্থাৎ সেই সময়ে আমাদের যে আন্দোলন, সংগ্রাম সব কিছুর ভেতরেই কিন্তু কবিতাকে তৈরি করতে হয়েছে। কবিতাকে শুধু কবিতা হিসেবে নয় কিংবা শুধু নির্জন কোনো কবিতা নয়, এই কবিতা হচ্ছে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সত্যিকারের অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আমাদের স্বাধীনতা সব কিছু এবং প্রতিবাদের একটা বিষয়, সব কিছু মিলে কবিতাকে তৈরি করতে হচ্ছে। তো এই সময়ে আসলে আমি যে নামটা দিয়েছিলাম ‘মিছিলের সমান বয়সী’, এই নামটা এই জন্যই দেওয়া যে, আমি নিজেকে তখন এভাবে ভেবেছি যে, আমি তো এই মিছিল, যেই মিছিলটা আসলে সংগ্রাম-আন্দোলন থেকে শুরু করে অর্থাৎ মানুষের যে অগ্রযাত্রার মিছিল, মানুষের যে প্রতিবাদের, দ্রোহের যে মিছিল, আমাদের যে অর্জন অর্থাৎ প্রেমের যে মিছিল বা মানুষের ভালোবাসার যে মিছিল, সব কিছু মিলেই কিন্তু এই মিছিলটা আমাদের। অর্থাৎ আমরা দেশটাকে ভালোবেসেছি সেই ভালোবাসার বিরুদ্ধে যখন একটা বিপ্রতীপ সময় এসেছে, বিপরীত সময় এসেছে, তার বিরুদ্ধে একটা লড়াই-ও কিন্তু কবিতার ভেতরে আছে। এই কবিতার মধ্যে আমি সেই জিনিসটাকে আনতে চেষ্টা করেছি বলেই ‘মিছিলের সমান বয়সী’ নামটা হয়েছে।
শিহাব শাহরিয়ার: আপনার ভেতরে প্রেম এবং দ্রোহ- এই দুটো একসঙ্গে কাজ করে। এটি আপনার কবিতার পাঠক ও সমালোচকদের কথা। একইসঙ্গে জানতে চাই- আপনার সতীর্থ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ; যিনি লিখলেন ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’। ঘটলো নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড! আপনারা কবিরা, বিশেষ করে লেখক-কবি-শিল্পীরা যারা এগিয়ে এলেন, সেই সময় বঙ্গবন্ধুর কবিতা নিয়েও আপনি প্রথম কবিতাযাত্রী এবং একটা প্রতি-বিপ্লবের অভিযাত্রী আপনারা।
কামাল চৌধুরী: সে সময় তো আসলে অনেকেই লিখেছেন। আমিও তাই। মানে বলবো যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কবিতার যেই প্রতিবাদী মিছিল বা কবিরা যে বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, সেই সময়ের আসলে কবিদের যে যাত্রা সেখানে আমি নিজেও শামিল ছিলাম এবং প্রতিবাদ করেছি, আমার কবিতাও ছাপা হয়েছে, আমরা অনেকেই লিখেছি। আসলে এটা তো তখন আমরা চেয়েছি যে কবিতার মাধ্যমে সেই ঘাতক শক্তির বিরুদ্ধে, সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে আঘাত করতে চেয়েছি। সেজন্যই কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা গেছে যে কবিতার মাধ্যমে যে প্রতিবাদটা হয়েছে, সেই প্রতিবাদটা একটা সময়ে সংঘবদ্ধ হয়েছে। আগে বিভিন্ন জন বিচ্ছিন্নভাবে লিখেছি। যেমন আমরা ‘সমকাল’ পত্রিকায় লিখছি কিংবা ‘জয়ধ্বনি’ পত্রিকায় লিখছি। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে জয়ধ্বনি পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপা হয়েছিল। সমকাল পত্রিকাতেও অনেক কবিতা ছাপা হয়েছে। এরকম বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু পরে একটা সময় ১৯৭৮ সালে এসে এই কবিতাগুলো অর্থাৎ যারা লিখছেন তাদেরকে নিয়ে সে সময়ে কয়েকজন তারা খুব সাহস করে আরেকটি সংকলন করেছিল ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’। এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরো অনেকগুলো প্রতিবাদী সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল সে সময়।
শিহাব শাহরিয়ার: প্রতিবাদের কথা বললেন, প্রতিবাদী কবিতাই কি কবিতা? আসলে কবিতা কী?
কামাল চৌধুরী: এটা খুব জটিল প্রশ্ন। আমার মনে হয় যে, সকল কবিকেই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় এবং কোনো কবিই ঠিকভাবে উত্তর দিতে পারেন না বলে আমার ধারণা। আসলে কবিতা এমন একটি জিনিস যার সংজ্ঞা করা কঠিন এবং কবিতা কাউকে সেভাবে শেখানো যায় না। কবিতা ভেতর থেকে আসে এবং এটাকে অনুভব করতে হয়। এটা উপলব্ধির একটা বিষয় অর্থাৎ অনেক কিছুর মধ্যে একটা ছাঁচ আছে। কবিতার ভেতরে একটা ছন্দ মাত্রার হিসেবের ছাঁচ আছে, গণিত আছে কিন্তু কবিতা গণিতেরও বাইরের কিছু একটা। এটা অনুভব করতে হবে, বুঝে নিতে হবে কোনটা কবিতা। সেজন্য যাদের বিষয়গুলো আমাদের হৃদয়ে খুব ভালোভাবে আকর্ষণ করে, সেটাকে আমরা উত্তম কবিতা বলি।
শিহাব শাহরিয়ার: প্রথম দিকে আপনার কবিতায় শামসুর রাহমানের প্রভাব ছিল? তিনি তো একটা নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি করেছিলেন, একইসঙ্গে আপনার ‘ভাড়ের গল্প’ কবিতাটি, পাঠক বলছে এটিতে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ দাশের যৌথ প্রভাব পরীলক্ষিত হয়েছে- স্বীকার করেন কি?
কামাল চৌধুরী: প্রভাব থাকা দোষের নয়, পূর্বসূরিদের প্রভাব থাকতেই পারে। কারণ তারা যে পথটা তৈরি করেছেন, সেই চমৎকার পথের উপর দাঁড়িয়ে আমরা আবার নতুন আরেকটা পথ তৈরি করার চেষ্টা করি। কবির কাজ হচ্ছে, নতুন পথ তৈরি করা। এই পথটা যদি কবি তৈরি করতে না পারেন, তাহলে কবি হিসেবে তিনি ব্যর্থ বলে মনে করি। যেমন জীবনানন্দ দাশ যদি নিজের পথ তৈরি করতে না পারতেন, তাহলে তিনি জীবনানন্দ দাশ হয়ে উঠতেন না। আর রবীন্দ্রনাথ তো সারা বাংলা সাহিত্যকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। আর ঠিকই বলেছেন, শামসুর রাহমান একটা কাব্যভাষা তৈরি করেছেন। কিন্তু আপনাকে দেখতে হবে যিনি প্রকৃত কবি তিনি কিন্তু অন্য সকলের কাব্যভাষা থেকে একটা আলাদা কাব্যভাষা নিয়ে যখন নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, তখনই তিনি প্রকৃত কবির একটা জায়গায় উপনীত হবেন। সেটা হচ্ছে সকল কবিরই আরাধ্য। সেজন্যই আসলে পূর্বসূরিদের প্রভাব, শামসুর রাহমানের ক্ষেত্রেও এই অভিযোগ ছিল, এটা সবার ক্ষেত্রেই থাকে। কারণ হচ্ছে যে, চর্চা করতে করতে অর্থাৎ একটা নিজস্ব ভাষা তৈরি করা, এটা যেহেতু হঠাৎ করে হয় না, স্বাভাবিকভাবেই কিন্তু পূর্বসূরিদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু গ্রহণ করতে হয় এবং এমনকি সমকালেরও প্রভাব অনেক সময় থাকে।
শিহাব শাহরিয়ার: আপনি একইসঙ্গে পেশায় বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদ- মুখ্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন, জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব এবং জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়কের। কিন্তু আমরা মনে করি, আপনি কবি হিসেবেই জনমানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। বলতে চাচ্ছি, ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর চেয়ে কবি কামাল চৌধুরী অনেক শক্তিশালী- কী বলবেন?
কামাল চৌধুরী: এই জীবনযাপনের কোলাহলের মধ্যে থেকেও কিছুটা সময় আলাদা করে ফেলতে হয়। তো সেটাতে কতটা সফল হতে পেরেছি সেটা জানি না। পাঠক আমাকে এবং সমকাল বা পরবর্তী সময় কীভাবে নেবে সেটা বলতে পারবো না। তবে আমি সরকারি চাকরির যে দায়িত্ব পালন করেছি, আমি চেষ্টা করেছি নিষ্ঠার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করতে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি এবং তারপর আমাকে যখন জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব এবং জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমি মনে করেছি এটা আমার জন্য খুবই গৌরবের। এটা অসাধারণ গৌরবের কারণ এরকম একটি মাহেন্দ্রক্ষণের আমি সার্বক্ষণিক একজন কর্মী হিসেবে কাজ করতে পারবো, সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করতে পারবো, এটা আসলে আমার কল্পনাতেও কখনো ছিল না। কারণ একটা সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছি আর আজকে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী পালনের সুযোগ হয়েছে। আমি মনে করি আমার জন্য অত্যন্ত গৌরবের একটা বিষয় হয়েছে।
শিহাব শাহরিয়ার: কবিতার মূলত তিনটি বিষয়: মানুষ-সমাজ, প্রেম-প্রকৃতি এবং ধর্ম বা আধ্যাত্মবাদ- তো এর বাইরে আসলে কী কবিরা লিখতে পারে? আপনার কী মনে হয়?
কামাল চৌধুরী: যে কোনো ভাষায় মৌলিক শব্দ খুব বেশি নেই। প্রেম, ভালোবাসা, যুদ্ধ, ক্ষুধা- আসলে এসবই আমার কাছে মৌলিক মনে হয়। কারণ এর উপরে ভিত্তি করে সবকিছু দাঁড়ায়। কিন্তু এই যে মৌলিক শব্দগুলো আছে, সেই শব্দগুলোকে ব্যবহার করেই কী করে একজন কবি আলাদা হয়ে যায়, সবাই কিন্তু এটা ব্যবহার করছে, সেখান থেকে অনেক শব্দ তো আছেই, শব্দ ভাণ্ডার তো অবশ্যই থাকে। কিন্তু আপনি যখন ভেতরের কবিতাকে সত্যিকারে আবিষ্কার করতে যাবেন, তখন শুধুমাত্র এই শব্দের উপরে নির্ভর করে হবে না, উপলব্ধিকে একটা আলাদা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে এবং এই জায়গাটা আসলে কে কীভাবে নেবে সেটা কবি বলতে পারবে। কিন্তু তার জন্য কিছু প্রকরণ আছে। যেমন ধরেন আমাকে ছন্দটা শিখতে হচ্ছে কিন্তু ছন্দটা শিখলেই কী আসলে আমার চলবে। মনে করুন যে, আমি একটা ভবন নির্মাণ করতে পারলাম অর্থাৎ ভবন নির্মাণের প্রকৌশলটা জানলাম কিন্তু সেটা কীভাবে সাজানো হবে, এটা কিন্তু আরেকটা কাজ। অর্থাৎ ছন্দ-মাত্রার হিসাবের বাইরেও একটা নান্দনিক বিষয় অর্থাৎ রক্ত-মাংস দেওয়া কবিতাকে, সেটা কিন্তু কবির কাজ। তো এটি শুধুমাত্র আসলে শব্দ দিয়ে হয় না। অনেকে বলেন কবিতা হচ্ছে শব্দের খেলা। শুধু শব্দ দিয়ে নয়, এটা আসলে শব্দ এবং উপলব্ধি, বাস্তবের সঙ্গে স্বপ্ন, সবকিছু মিলিয়ে ভিন্ন একটা জগৎ তৈরি করতে হয় কবিকে। এবং প্রতিনিয়ত সেই জগতে তাকে ঘুরপাক খেতে হয় কোনো কিছু অন্বেষণের জন্য, সেখান থেকে প্রকৃত কবিতাকে অন্বেষণ করে তার কবিতাকে সাজাতে হয়। সেটাই হচ্ছে খুব জরুরি। তো সেটা সব কিছুর একটা মিশেল।
শিহাব শাহরিয়ার: সর্বশেষ একুশে পদক পেলেন, পেলেন বাংলা একাডেমির পুরস্কার, সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার, আপনার বন্ধু রুদ্রর নামে যেটি পদক সেটি পেয়েছেন এবং জেমকন পুরস্কার- এই যে পুরস্কার এবং পদকগুলো পেলেন, তাতে কবির কতটা অনুপ্রেরণা বা কতটুকু আসলে পাওয়া হয়?
কামাল চৌধুরী: পুরস্কারটা একজন কবির জন্য এক ধরনের স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতিটা কবিকে প্রণোদনা দেয়, উৎসাহ দেয়। পুরস্কারের মূল্যকে অস্বীকার করা যাবে না তবে পুরস্কারটা তখনই সত্যিকার অর্থে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন একজন কবি বা একজন লেখক যিনি পুরস্কারটা পাচ্ছেন, তিনি যে কাজের জন্য পাচ্ছেন, সেই প্রেরণাকে ব্যবহার করে অর্থাৎ পুরস্কারের প্রেরণা কিংবা পাঠকের ভালোবাসা, সবকিছু ব্যবহার করে আরো অনেক ভালো কিছু উপহার দিতে পারেন। এটি কিন্তু খুবই গুরত্বপূর্ণ। সেজন্যে যদি এই কাজটা করতে না পারে তাহলে কিন্তু এই পুরস্কারও ওই যে প্রজাপতির যেটা পাবলো নেরুদা পুরস্কার সম্পর্কে বলেছিলেন যে- আমার পুরস্কার হচ্ছে প্রজাপতির ক্ষণস্থায়ী জীবনের মতো। অর্থাৎ পুরস্কারকে যদি ব্যবহার করা না যায়, যদি আগামী দিনের স্বপ্নযাত্রার জন্য, আগামী দিনের ভালো লেখার জন্য, সৃজনশীল কাজের জন্য, তাহলে কিন্তু পুরস্কার ওই প্রজাপতির ক্ষণস্থায়ী জীবনের মতো। অর্থাৎ সেটির কিন্তু খুব গুরত্ব থাকে না। সেজন্য পুরস্কারকে সবসময় নবায়ন করতে হয় লেখা দিয়ে, সৃজনশীল কাজ দিয়ে।
শিহাব শাহরিয়ার: বাংলা কবিতা বিশেষ করে বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে আপনার কী বক্তব্য?
কামাল চৌধুরী: বাংলাদেশে বিশ্বমানের কবিতা লেখা হচ্ছে। এটি আগেও লেখা হয়েছে, এখনো লেখা হচ্ছে। আসলে সমস্যাটা হচ্ছে যে, এখন যে পৃথিবী। যেমন একটা সময় কিন্তু আমরা শুধু বাংলা কবিতাই পড়তাম, কারণ আমাদের কাছে বাইরের লেখাগুলো সেভাবে সামনে আসতো না। এখন যে আসলে বিশ্বায়নের একটা যুগ, সারা বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ, আমরা যেকোনো সময়ই পৃথিবীর যেকোনো জায়গায়ই বিচরণ করতে পারছি, সেই সঙ্গে অনেক বিদেশি বই অর্থাৎ ভিন্ন ভাষার বই বিশেষ করে ইংরেজিতে, প্রচুর বই আসছে, এখন আমরা কিন্তু সব পাচ্ছি। আগে যেটা হতো যে, হয়তো বাইরের বই-ও আসতো তবে অনুবাদ হয়ে আসতো। কিন্তু এখন আমরা একেবারে অরিজনালও পাচ্ছি। অর্থাৎ তুলনা করার একটা জায়গা কিন্তু দাঁড়িয়ে গেছে। এই তুলনা করার জায়গাটা আমি মনে করি, আমরা কেমন লিখছি। কিন্তু আমাদের সমস্যাটা হচ্ছে যে জায়গায়, আমরা যেহেতু বাংলা ভাষায় লিখছি এবং বাংলা ভাষায় অনুবাদ যদি না হয় তাহলে কিন্তু আমরা বাইরে যেতে পারছি না, বাইরের বইগুলো যেভাবে আমাদের সামনে আসছে বা কবিতাগুলো যেভাবে আসছে। এই জায়গাটার দিকে একটু নজর দেওয়া দরকার। কারণ আমাদের কবিরা বা আমাদের লেখকরা ভালো লিখছেন কিন্তু এই ভালো লেখাটা যদি ভালোভাবে অনুবাদ করা না যায় তাহলে আমরা ভিন্ন ভাষাভাষী পাঠককে আমরা ধরতে পারছি না। যেমন রবীন্দ্রনাথ কিন্তু অনূদিত হয়ে সারা বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিলেন। আমরাও মনে করি, আমাদের ভাষায় এরকম কবি আছেন কিন্তু অনুবাদটা খুবই জরুরি। সেই কাজটা যদি করতে পারি তাহলে আমাদের বড় লেখক, বড় কবিদেরকেও আমি মনে করি যে বিশ্ব সভায় একটা আলাদা জায়গায় দেখতে পাবো।