ধ্রুব এষ প্রথিতযশা প্রচ্ছদশিল্পী এবং কথাসাহিত্যিক। শিশুসাহিত্যে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। লিখতে পছন্দ করেন রহস্য কাহিনি। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত চল্লিশের অধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। শৈশব কাটিয়েছেন সুরমা নদীর পাড়ের সুনামগঞ্জে। দেখেছেন পাহাড়ঘেরা সবুজ প্রকৃতি। তাঁর প্রিয় দৃশ্যের মধ্যে রয়েছে মেঘ। ভাবনার মৌলিকত্ব তাঁকে আলাদা বোধসম্পন্ন মানুষে পরিণত করেছে। ধ্রুব এষ নদীকে দেখেন মানবশিশুর মতো। পাহাড় তাঁর কাছে ম্যাজিক। এই শিল্পীর কথাও যেন শব্দের শরীরে রং ছিটিয়ে দেয়। চলতি বছর তিনি শিশুসাহিত্যে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি স্বরলিপি।
স্বরলিপি: বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করায় আপনাকে অভিনন্দন। এই প্রাপ্তিতে আপনার অনুভূতি কেমন?
ধ্রুব এষ: বিষয়টা ভালো লেগেছে। হা হা হা।
স্বরলিপি: শিশুসাহিত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ভাষা, ভাষা নির্মাণে আপনি কোন দিকটা প্রাধান্য দেন?
ধ্রুব এষ: শিশুদের চলাফেরা, কথাবার্তা এগুলো খেয়াল করি। তাই লিখি। এটা কঠিন কিছু না। আমার জীবনে আমি কঠিনকে প্রশ্রয় দেই না। যা কঠিন মনে হয়, তা ছেড়ে আসি। সহজ ও সাবলীল যা তাই আমার কাজের অংশ হয়ে ওঠে। শিশুসাহিত্যও তাই।
স্বরলিপি: ছোটদের বইয়ের অলঙ্করণ কম করতে দেখা যায়, কেন?
ধ্রুব এষ: ছোটদের বইয়ের অলঙ্করণ আমি একেবারেই পারি না। হাতে গোনা দুই-একটি বইয়ের প্রচ্ছদ করেছি।
স্বরলিপি: আপনার লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ আপনি করেন না। বা আপনার লেখা শিশুতোষ বইয়ের অলঙ্করণ অন্য শিল্পীরা করেন, এর কারণ কী?
ধ্রুব এষ: আমার বইয়ের প্রচ্ছদ আমি করবো! সব্যসাচী হাজরা, রজত এরা বইয়ের প্রচ্ছদ করে। এদের সঙ্গে কথা থাকে, বইয়ের ডিজাইন আমি দেখবো না। দেখিও না। তার কারণ, আমি নিশ্চিত তারা আমার বইয়ের প্রচ্ছদ ভালো করবে। এবং আমার বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে আমি প্রচ- খুশি। এরা প্রত্যেকে ভালো কাজ করে।
স্বরলিপি: শৈশবে দেখা সবথেকে সুন্দর দৃশ্য কী?
ধ্রুব এষ: শৈশব কেটেছে সুনামগঞ্জে। ওখানে পাহাড় আছে। বাড়ি থেকে দূরে, নীল পাহাড় দেখা যায়। ঐ পাহাড়ের কাছে রিকশায় যাওয়া যায়, বা হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া যায়। হাঁটতে হাঁটতে বা রিকশায় যেতে যেতে দেখা যায়, হঠাৎ নীল পাহাড়টা সবুজ হয়ে ওঠে। এটা আমার কাছে সব সময় ম্যাজিক বলে মনে হয়। নিশ্চয়ই এর পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। ফলে আমরা দেখি নীল পাহাড়টা সবুজ হয়ে যায়। ছোট বেলায় এই দৃশ্য দেখেছি তা শুধু নয়, বড় হয়েও এই পাহাড়ের কাছে যেতে যেতে দেখেছি এই দৃশ্য। কিন্তু কোনদিন ধরতে পারিনি ঠিক কোন মূহূর্তে এই রং বদলে যায়।
স্বরলিপি: আর নদী?
ধ্রুব এষ: আর নদী...। নদীকে আমার কাছে মানবশিশু মনে হয়। মনে হয় যে নদীকেও কোলে নেওয়া যাবে, আদর করা যাবে। মোট কথা, নদীকে আমার মানুষ বলে মনে হয়। তাও বার শিশু, খুব বড় কোনো মানুষ না। কয়েকদিন আগে বাড়ি গিয়েছিলাম। আমার এক ভাতিজি আছে ওর নাম ‘অরণী’। বয়স ছয় বছর। এই ছয় বছর বয়সে সে আমাকে প্রথম দেখলো। এবার বাড়িতে গিয়ে সুরমা নদীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি যে, কপালগুণে সেখানে একটা নৌকাও নেই। অরণীকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, হঠাৎ করে মনে হলো নদীটাও যেন অরণীর মতো কেউ। যে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে!
স্বরলিপি: এভাবে ভাবার জন্য মনে অনেক মায়া থাকতে হয়।
ধ্রুব এষ: আহারে, আদর, মায়া এসব তো পৃথিবীতে নাই! অল্পস্বল্প যাও আছে, তার দেখা সবাই পায় না। যে আসলে মায়া দেখে নাই, তার মানুষ হওয়ারও কোনো কারণ নাই। এই যে সাত বছর পর বাড়িতে গেলাম, অনেক কাকা, দাদা, পিসিরা এসে আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। কেউ কেউ গালে হাত দিয়ে দেখল। এই মায়া তো এই শহরে নাই। আমি বড় হয়েছি পিসিদের কোলে কোলে। বড় হয়েছি সুরমা নদীর কাছে, আর রং বদলে চমকে দিতে পারে এমন পাহাড়ঘেরা গ্রামে।
স্বরলিপি: যেখানে এতো মায়া, সেখানে সাত বছর কেন যান নাই?
ধ্রুব এষ: অরণীই আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। ও ছয় বছরের একটা শিশু, আমাকে শাসন করে বলে দিলো- বাড়িতে এবার যেতেই হবে। উপেক্ষা করতে পারলাম না। অরণীকে দেখার পর শৈশবের প্রতি, শিশুদের প্রতি আলাদা মায়া জন্ম নিয়েছে আবার। ও আমাকে ‘বড় বাবা’ ডাকে। শেষ বার বললো, বড় বাবা বাড়ি আসো, না আসলে মাইর খাবা। আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি গেলাম। সেই সব মুখ, মানুষ, নদী, পাহাড় দেখে এলাম। যদিও আমি কোনো কিছু বিশেষ নজর দিয়ে দেখি না, সবই আমার কাছে সমান। কিন্তু এগুলোই আমার চিন্তা-চেতনার জগত দখল করে আছে।
স্বরলিপি: প্রকৃতির আর কী ভালো লাগে?
ধ্রুব এষ: মেঘ।
স্বরলিপি: কেন লেখেন?
ধ্রুব এষ: ভালো লাগে তাই লিখি। এই কাজটা আমার জন্য সহজ। যা কঠিন আমি তার ধারে-কাছে যাই না।
স্বরলিপি: ‘অ্যাই ছেলে তোর নাম কিরে? মহা একটা চিন্তায় পরে যায় বেচারি। কি যেন নাম? কি যেন নাম তার? ও, স্যার আইজ্যাক নিউটন। না, না হোর্হে লুই বোর্হেস। এমন অবস্থা! ‘ভুতু আর টুতু’তে এই বর্ণনা আছে। দাদা, এই যে গল্পের ছলে বড় বড় নামের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া, এই চরিত্র কী সচেতন নির্মাণ?
ধ্রুব এষ: লেখার ক্ষেত্রে অবলীলায় যা লিখতে পারি, তাই লিখি।