রোদেলা এক বিকেল। কৈশোরে ওয়ারির আকাশে ভোঁকাট্টা ঘুড়ির পেছনে ছুটতে গিয়ে সুদর্শন মধ্যবয়স্ক একজন খপ করে হাত ধরে থামিয়েছিলেন। লোকটি রোকনুজ্জামান খান। সেদিন তিনিই জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে লুৎফর রহমান রিটনের প্রায় ৫০ বছরের ছড়াযাত্রা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডির নির্বাহী সম্পাদক তাপস রায়।
তাপস রায়: আপনি এ সময়ের অন্যতম প্রধান ছড়াকার। এই ছড়াযাত্রার সূচনা-কথা জানতে চাই।
লুৎফর রহমান রিটন: আমার ছড়াযাত্রার সূচনার কথা বলতে গেলে, প্রথম লেখার স্মৃতি হাতড়ালে আমাকে ফিরে যেতে হবে ১৯৭২ সালে। ১৯৭২ সালের রোদেলা এক বিকেল। এইমাত্র একটা ঘুড়ি ভোঁকাট্টা হলো ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত ওয়ারির আকাশে। ছাদ থেকে সেই দৃশ্য দেখামাত্র দ্রুত পায়ে আমার সিঁড়িভাঙা শুরু। পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট। পায়ে স্যান্ডেল নেই। সেই অবস্থায়ই দে ছুট ঘুড়ির পেছনে। ওটাকে ধরতেই হবে। ছুটে যাচ্ছি আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে। র্যাংকিন স্ট্রিট সিলভারডেল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সামনে এক লোক খপ করে ধরে ফেললো আমার হাত- এই ছেলে ওরকম ছুটছো যে, এক্সিডেন্ট করবে তো! মহাবিরক্ত আমি লোকটার দিকে না-তাকিয়ে তাকিয়ে আছি ঘুড়িটার দিকে। ঘুড়িটা তার সাপের মতো লেজ দোলাতে দোলাতে আমার মন খারাপ করে দিয়ে ধরা দিলো একটা ছেলের হাতে।
লোকটার হাত আমার কবজি ধরে আছে তো আছেই। ছাড়েই না। খানিকটা তোতলানো উচ্চারণে লোকটা বললো, তোমাদের বাসা কোনটা? আমি ঘাড় বাঁকিয়ে খুব বিরক্ত ভঙ্গিতে বললাম, অই যে, ছাড়ুন! আমার হাত না ছেড়ে লোকটা বললো, তুমি ছবি আঁকতে পারো? হ্যাঁ পারি। ফুল আঁকতে পারি, পাখি আঁকতে পারি। নৌকা মানুষ টেলিভিশন সব আঁকতে পারি। ছাড়ুন তো! লোকটা বললো, এই সিলভারডেল স্কুলের ভেতরে সপ্তাহে দুদিন ছবি আঁকার ক্লাস হয়। তোমার বয়েসী অনেক ছেলেমেয়ে আছে ওখানে, ওই যে দেখো। ইচ্ছে হলে তুমি এখানে ছবি আঁকা শিখতে পারো। তুমি শুধু রাবার আর পেন্সিল আনবে। রঙ-তুলি কাগজ সব কিছু আমরাই দেবো। কি? শিখবে ছবি আঁকা?
ঘুড়িটুড়ির কথা ভুলে আমি তো অবাক! এই লোক বলে কী! রঙ-তুলি কাগজ সব সব দেবে! এতোক্ষণ পর ঘাড় উঁচু করে আমি তাকালাম লোকটার দিকে, খুদে বালক আমার তুলনায় বিশালদেহী লম্বা, কালো স্যুট আর টাই পরা সুদর্শন মধ্যবয়স্ক একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা লোকটার চোখে। জানতে চাইলাম, কত টাকা লাগবে? লোকটা বললো, টাকা-পয়সা লাগবে না। তুমি ছবি আঁকতে এলেই আমরা খুশি হবো। আমাদের গানেরও ক্লাস আছে। তুমি ওখানেও আসতে পারো। কি, আসবে? খুশিতে টইটুম্বুর আমি পিংপং বলের মতো লাফিয়ে উঠলাম, হ্যাঁ আসবো। আমি ছবি আঁকা শিখবো। লোকটা বললো, তাহলে যাও গায়ে একটা শার্ট চড়িয়ে জুতো অথবা স্যান্ডেল পরে চলে এসো। একটা পেন্সিল আর রাবারও এনো কিন্তু। আমি এক ছুটে বাড়ি। আরেক ছুটে সিলভারডেল কিন্ডারগার্টেন। পরম আদরে লোকটা আমাকে বসিয়ে দিলো ছবি আঁকার ক্লাসে।
এভাবেই আমার জীবন-পথের মোড়ে একজন দক্ষ ট্রাফিক সার্জেন্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা পরিবর্তন করে দিলো আমার গতিপথ। লোকটার নাম রোকনুজ্জামান খান। তবে ‘দাদাভাই’ নামেই পরিচিত তিনি সারাদেশে। ছড়াকার হিসেবেও খুব বিখ্যাত এবং শ্রদ্ধেয় তিনি; বাংলাদেশে।
শুরু হলো আমার ছবি আঁকা। টপাটপ কয়েকটা পুরস্কারও পেয়ে গেলাম জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক। দাদাভাই ‘ইত্তেফাক’র ছোটদের পাতা কচি-কাঁচার আসরে আমার আঁকা ছবি ছাপালেন অনেকগুলো। ‘ইত্তেফাক’র সেই ছোটদের পাতায় আমার আঁকা ছবির পাশে ছাপা হতো অনেকের ছড়া কবিতা গল্প। সেগুলো পড়ে পড়ে একদিন মনে হলো- আমি কেনো লিখি না ওদের মতো। যদি আমিও ওরকম মিলিয়ে মিলিয়ে ছড়া বানাতে পারি তাহলে দাদাভাই নিশ্চয়ই সেটাও ছাপাবেন। তারপর, ১৯৭২ সালের স্বর্ণালি এক সন্ধ্যায় জয়কালী মন্দির রোডের কচি-কাঁচা ভবনে দাদাভাইয়ের হাতে লজ্জা আর দ্বিধায় জড়সড় হয়ে গুঁজে দিলাম একটা ছড়া- পুতুলের বিয়ে। আমাকে অবাক করে দিয়ে পরের সপ্তাহেই ছাপা হলো ছড়াটা, কচি-কাঁচার আসরে। দাদাভাই ছড়াটা ছাপলেন এভাবে: পুতুলের বিয়ে, রিটন (বয়স ৯)।
সেই থেকে শুরু। সেদিন দাদাভাই ৯ বছর বয়েসী এক শিশুর অতিশয় দুর্বল সেই ছড়াটা ছেপে না দিলে বাংলাদেশে ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের জন্ম হতো না। সেই যে লেখালেখির শুরু হলো আমার, আর থামাথামি নেই। সেটা চলছে আজও। বছর গুনলে টানা পঞ্চাশ বছর ধরে চলছে আমার ছড়া লেখার পাগলামিটা।
তারা: আপনি অনেক জটিল বিষয়ও সাবলীলভাবে ছন্দে বাঁধেন। এই ক্ষমতা কি টানা পঞ্চাশ বছরের চর্চার ফসল নাকি ঈশ্বর প্রদত্ত? আপনার কি মনে হয়?
রিটন: প্রকৃতি বা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতাকে আমরা বলি গড গিফটেড। প্রতিটি মানুষই গিফটেড কোনো না কোনো ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়। কিন্তু সিংহভাগ মানুষই তাকে প্রদত্ত ক্ষমতার ক্ষেত্রটি আবিষ্কার বা শনাক্ত করতে ভুল করে। যে কারণে বহু মানুষ ভুল ক্ষেত্রটিকে আকড়ে ধরে মগ্ন হয় চর্চায়। ফলে যার গলায় গান নেই সে একটা জীবন কাটিয়ে দেয় গায়ক-গায়িকা হবার চেষ্টায়। ফলাফল অতি সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থতা বরণ।
ছেলেবালায় আমি আসলে হতে চেয়েছিলাম শিল্পী। আর্টিস্ট। প্রচুর ছবি আঁকতাম। খারাপ ছিলো না কিন্তু আমার ছবি আঁকার হাত। শঙ্কর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কয়েকটা আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছিলাম পিচ্চিকালে। ছড়াকার হবো ভাবি নি। কিন্তু নিয়তি আমাকে আঁকিয়ে হতে দেয়নি।
আর্ট কলেজে ভর্তি হবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আর্ট কলেজ বা চারুকলা আমাকে নিতে চায়নি। ভর্তি পরীক্ষায় রিটেনে আমাকে ফেল করাতে না পারলেও ভাইবায় আমাকে ফেল করানো হয়েছিলো। সেই ছোটবেলা থেকেই বাকপটু হিসেবে পরিচিত ছিলাম। অথচ আমাকে ফেল করানো হয়েছিলো ভাইবায়। হাহ হাহ হাহ। হতে চাইলাম আর্টিস্ট, আর হলাম কি না ছড়াকার! কোনো মানে হয়? আসলে, একেকটা মানুষ একেকটা দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে আসে। আমার মনে হয় আমার ওপর অর্পিত ছিলো ছড়ার দায়িত্ব। ওটা আমি নিতে চাইনি কিন্তু নিয়তি আমার কাঁধে ছড়ার বোঝাটা ঠিক ঠিক চাপিয়ে দিয়েছে। ও থেকে আমার আর নিস্তার নেই। এইটা বুঝে গিয়েছিলাম বলেই আর গাঁইগুঁই করিনি। শেষমেশ মেনেই নিয়েছি প্রকৃতির বিধান।
দীর্ঘদিনের বিরতিহীন সাধনা আর একাগ্রতায় ছড়া এবং ছন্দ আমার বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে কিংবা বলা যায় আমিও বশ্যতা মেনে নিয়েছি ছড়ার। আর তাই যে কোনো জটিল বিষয়ও ছড়ার ছন্দে বাঁধতে পারি আমি।
তারা: প্রেমে এবং প্রতিবাদে ছড়া সমান সচল। ছড়ার পাঠকপ্রিয়তার কি এটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন?
রিটন: আমাদের চারপাশ ছন্দময় এবং ছড়াময়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রেমে-বিচ্ছেদে-আনন্দে-বিষাদে-হতাশায়-বেদনায় কোথায় নেই ছড়া? শুধু শিশুরাই নয়, ছড়ায় মন্ত্রমুগ্ধ প্রাপ্তবয়স্করাও। এমনকি প্রবীণরাও। দেয়াল লিখনে, মিছিলের শ্লোগানে, রাজনৈতিক সমাবেশে, সামাজিক-রাজনৈতিক অসঙ্গতি-অনাচার-অবিচার-শোষণ-বঞ্চনা প্রতিরোধে, প্রতিবাদে কোথায় নেই ছড়া? সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মুখে মুখে রচিত হয়ে ছড়া ফিরেছে মানুষের মুখে মুখে। এখনো ফেরে। ছড়া এমনই। রাজনৈতিক কোনো বক্তব্য ছড়ার ছন্দে গাঁথা হলে সেটা আলাদা শক্তিতে দীপ্র ও ক্ষীপ্র হয়ে ওঠে। তারপর তা মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। ছন্দ ও মিলের অপূর্ব ম্যাজিকের কারণে ছড়া খুব সহজেই আলোড়িত করে মানুষকে। ছড়ার এরকম শক্তির কারণেই আন্দোলনে অভ্যুত্থানে, প্রতিবাদী মানুষের প্রধান অবলম্বন ‘শ্লোগান’ হয়ে ওঠে ছড়া। সময়ের প্রয়োজনে তখন, ছড়া হয়ে ওঠে গণ-মানুষের দাবির ভাষা। সহস্র মানুষের অপ্রতিরোদ্ধ মিছিলের শ্লোগান হয়ে ওঠা ছড়াকে, ছড়ার ভাষাকে তখন বসাতেই হয় আলাদা মর্যাদার উচ্চতর আসনে। গৌরবের আসনে। স্বাধীনতা-পূর্বকালে আমাদের সহযোদ্ধাদের কেউ একজন রচনা করেছিলেন অমর পঙ্ক্তি: ‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা।’
কী বিপুল শক্তি ধারণ করেছিলো শ্লোগানরূপী ছড়াটি। একটি জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়কে, তার অস্তিত্বের শেকড়কে, তার স্বপ্ন-আকাঙ্খাকে প্রবলভাবে চিত্রিত ও চিহ্নিত করেছিলো মাত্র ছয়টি শব্দের একটি ছড়া। স্বাধীনতা উত্তরকালে ‘খুন হয়েছে আমার ভাই/ খুনি তোমার রক্ষা নাই’ অথবা ‘এক দফা এক দাবি/ এরশাদ তুই কবে যাবি?’ এরকম বহু ছড়া শ্লোগানে রূপান্তরিত হয়ে উদ্দীপ্ত করেছে মুক্তিকামী গণ-মানুষকে। ছড়ার ভাষা মানুষকে উদ্দীপ্ত করে, উত্তেজিত করে, প্রশান্ত করে, আনন্দিত করে। ভয় দেখায় আবার অভয়বাণীও শোনায়। স্বপ্ন দেখায়, এবং সাহসে বুক বাঁধতে প্রেরণা যোগায় ছড়া।
ছড়া ছোট, কিন্তু লক্ষ্যভেদী। আপাত নিরীহ, কিন্তু অভ্রভেদী। ছড়া হচ্ছে খুবই কম্যুনিকেটিভ ছন্দোময় একটা মাধ্যম। সাত পৃষ্ঠা লিখে যা বোঝানো হয় ছড়ায় সেটা সাত লাইনেই সম্ভব।
ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে ‘গোস্পদে আকাশ দেখা’। ছড়ার ক্ষেত্রে ছোটগল্পের এই ক্ষমতাটির পাশাপাশি উল্টোটাও অর্থাৎ কিনা আকাশে গোস্পদের চিহ্নও অবলোকন করা সম্ভব। অর্থাৎ ছড়ার রয়েছে বহু দূর থেকে দেখা কিংবা একেবারে কাছে থেকে দেখার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা। ছড়ার আছে খুবই পাওয়ারফুল একটা লেন্স। যা দিয়ে জুম ইন, জুম আউট করে আপনি অতীত বর্তমান এবং কখনো কখনো ভবিষ্যৎ দৃশ্যমান করে তুলতে পারেন। ২০০৭ সালে আমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাবার পর অভিনেতা আফজাল হোসেন আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে ডান হাতের দুই আঙুলে ছোট্ট একটা স্পেস নির্দেশ করে বলেছিলেন, ‘তুমি হচ্ছো সেই খেলোয়াড় যাকে খেলতে হয় এই এতোটুকুন একটা মাঠে। এবং এইটুকুন স্পেসেই তোমাকে তোমার যাবতীয় ক্ষমতা আর দক্ষতাকে প্রকাশ করতে হয়। খেলাটা সহজ নয়। সামান্য স্পেসে বড় খেলা দেখাতে হলে মারাত্মক স্কিল্ড হতে হয়। সেই কারণেই তুমি সবার থেকে আলাদা।’ আফজাল হোসেনের কথাটা আমার পছন্দ হয়েছিলো।
তারা: তারপরও কিন্তু আমাদের সাহিত্যপাতায় ছড়া অনুপস্থিত। শিশুসাহিত্যের বাইরে বড় কোনো সাহিত্য আয়োজনে ছড়া চোখে পড়ে না। এর কারণ কি বলে মনে করেন?
রিটন: এটা আমাদের সাহিত্য পাতার দায়িত্বপ্রাপ্তদের অজ্ঞানতা বা অক্ষমতা। ভুল শিক্ষার কারণে তাঁরা জেনেছেন- ছড়া হচ্ছে ছোটদের পাতার বিষয়। এই বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করে আমি ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’র কলাম ভিত্তিক পাতা চতুরঙ্গে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীদের কলামের পাশাপাশি লিখে গেছি ছড়া, একের পর এক। সম্পাদক তোয়াব খান সমান গুরুত্ব দিয়ে বড়দের কলামের পাশাপাশি দিনের পর দিন ছেপেছেন আমার ছড়া। এজন্যে অবশ্য তোয়াব খানের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বহু তর্ক-বিতর্ক করতে হয়েছিলো আমাকে। তোয়াব ভাইকে ধন্যবাদ, তিনি মেনে নিয়েছিলেন আমার যুক্তি।
‘আজকের কাগজ’র বার্তা সম্পাদক আবু বকর চৌধুরী পত্রিকাটির প্রথম পাতায় আমার ছড়া ছেপেছেন। সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান তাঁর সম্পাদিত ‘আমাদের সময়’ পত্রিকার প্রথম পাতায় আমার বেশ কিছু ছড়া ছেপেছেন। আমার হাতের লেখাটিই তিনি নান্দনিক সৌন্দর্যে চিত্রিত করে ছেপে দিতেন। এছাড়া পাক্ষিক ‘আনন্দ বিচিত্রা’ এবং সাপ্তাহিক ‘২০০০’ পত্রিকায় সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীও ছেপেছেন আমার বহু ছড়া।
তারা: ছড়ার অনেক পাঠক মনে করেন, ছড়াকার ফারুক নওয়াজের অনেক আগেই বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাচ্ছি।
রিটন: সেটা আমিও মনে করি। ফারুক নওয়াজের চাইতে কম যোগ্যতাসম্পন্ন অনেকেই বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। হয়তো আগামীতেও পাবেন কেউ কেউ। কিন্তু তাতে খুব বড় রকমের কোনো অভিঘাত তৈরি হবে না আমাদের ছড়াসাহিত্যে। হয়ওনি। পুরস্কার অর্জনের চাইতে পাঠকের ভালোবাসা অর্জনই একজন লেখকের জন্যে বড় প্রাপ্তি। ফারুক সেটা অর্জন করেছেন।
তারা: ছন্দ ছড়ার প্রাণ। এর বাইরে ছড়াকার হতে হলে কোন বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে?
রিটন: শুধু ছন্দ জানলেই ছড়াকার হওয়া যায় না। ছন্দ জানার পাশাপাশি তাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে ইতিহাস-ঐতিহ্য-বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজ ও সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন-রাজনীতি-অর্থনীতি। সভ্যতার ইতিহাসের পাশাপাশি তাকে জানতে হবে প্রাণ-প্রকৃতির যাবতীয় অনুষঙ্গ। এজন্যে পড়তে হবে প্রচুর। বিপুল পঠন-পাঠন না থাকলে সে পিছিয়ে পড়বে ছড়াকার হিসেবে। বিষয়বস্তু নির্বাচনেও তাকে হতে হবে আধুনিকমনস্ক। বাংলা ছড়াসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো তাকে পড়ে আসতে হবে। লোকছড়া থেকে আজকের আধুনিক কালের ছড়া- সবই থাকতে হবে তার নখ-দর্পণে।
তারা: ‘লুৎফর রহমান রিটন ছাড়া বাংলা একাডেমির বইমেলার আড্ডা জমে না’- আপনার সমসাময়িক অনেকেই একথা বলেন। আপনি বইমেলার শুরুটা দেখেছেন। এ সময়ের বইমেলার সঙ্গে তুলনা করলে কোন পার্থক্যটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে?
রিটন: বাংলা একাডেমির বইমেলা শুরুতে অনেক ছোট পরিসরের ছিলো। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ পর্যন্তই ছিলো এর সীমানা। ক্রমে সেটা বাংলা একাডেমি থেকে একদিকে টিএসসি মোড় এবং অন্যদিকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। তারপর একদিন বাংলা একাডেমির বিপরীত দিকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও সম্প্রসারিত হয়েছে বইমেলা। বইমেলার একেবারে সূচনাকাল থেকে আজকের বিশাল বইমেলা পর্যন্ত আমি এর সঙ্গে ছিলাম। আশির দশক থেকে বাংলা একাডেমির বইমেলাটি বিকশিত হতে হতে আজকের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বইমেলার সঙ্গে এককালের নবীন লেখক আমিও বিকশিত হতে হতে আজকের ষাটোর্ধ প্রবীণ পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছি। সেই বিবেচনায় লেখক-ছড়াকার হিসেবে আমার বিকাশ বাংলা একাডেমির বইমেলার বিকাশকালের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গীভাবে।
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রখ্যাত ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান একবার লিখেছিলেন: ‘রিটনকে ছাড়া বাংলা একাডেমির বইমেলাকে অসম্পূর্ণ মনে হয়।’ আমার বিকাশকালটা, আমার সেই কৈশোর থেকেই, খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ্য করেছেন তিনি। হ্যাঁ, প্রচ- আড্ডামুখর হিসেবে বাড়তি একটা পরিচয় আছে আমার। আড্ডা একটি খুব প্রিয় আর জরুরি অনুষঙ্গ আমার জীবনে। দেখুন, বাঙালির জীবনে আড্ডা চিরকালই ছিলো। আছে এবং আড্ডা থাকবে। আড্ডার জায়গাটাও থাকবে। শুধু বদলে যাবে আড্ডার মানুষগুলো। চেহারাগুলো। এটাই নিয়ম প্রকৃতির। এ বিষয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে মান্নাদের গাওয়া বিখ্যাত ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানের কয়েকটি পঙক্তির শরণ নেয়া যাক: ‘সেই সাত জন নেই আজ, টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি শুধু সেই সেদিনের মালী নেই... কতো স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউসে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায় কত জন এলো-গেলো, কতজনই আসবে কফি হাউসটা শুধু থেকে যায়’
আহা, আড্ডায় আজ রিটন নেই, সে থাকে দূর দেশে! তাতে কী! আড্ডাটা ঠিকই আছে। রিটনের জায়গায় সেই আড্ডাটা আজ জমিয়ে দিচ্ছে অন্য কেউ...।