হাসিনা এই মাত্র বেরিয়ে গেল। ডান হাত আলগোছে বুকের ওর রেখে আনিস ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো। হাসিনা বেরিয়ে গেছে। দুপুর থেকেই আকাশে মেঘ করে আছে। বিকেল অবধি থমথমেই রইল। এখুনি হয়ত অঝোরধারে ওটা ভেঙে পড়বে। কদিন থেকেই বেশ জ্বর জ্বর ছিল ওর শরীর। যেতে পারেনি অফিসে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় ও। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। দুর্বল শরীরে কোনো রকমে উঠে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। জলের ছাঁট।
হাসিনা বেরিয়েছে ওর বড় বোনের কাছে। কোনোদিনই আনিস ওকে দুর্যোগ মাথায় করে যেতে দেয়নি ওখানে। কিন্ত আজ ও কোনো কথাই শুনতে রাজী হয়নি। তার বুক অবধি চাদরখানা টেনে দিয়ে সাধারণ একটা শাড়ী পরে বেরিয়ে গেছে। অনেক শখ করে, এগারো টাকা বারো আনায় সদরঘাট থেকে কিনেছিল দেড় বছর আগে। দেড়টি বছর পুরোনো হয়ে গেছে। তারপর থেকে হাসিনা। তেষ্টা পেল তার। একহাতে টুলের ওপর গ্লাস থেকে জল খেয়ে নেয়। পাশেই বেতের চেয়ারটা খাঁ খাঁ করছে। হাসিনা তো একটু আগেও ওখানটায় বসে ছিল। এখনও তো আবহাওয়ায় ভরে রয়েছে ওর গায়ের সুবাস।
আনিস কাত হয়ে শোয়। চেয়ারটাকে পেছনে করে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। নির্জন পথ।
কিযে হয় এই বিছানায় শুয়ে থেকে ধুঁকতে, তা কি আনিসের চেয়ে আর কেউ ভালো বোঝে? আকাশ পৃথিবী এক হয়ে আসে। তরল হয়ে ঝরে পড়তে থাকে যেন হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে। কোথায় সে আছে? আকাশে, না মাটিতে, না সমুদ্রে, না অনন্ত মহাশূন্যে? ঝিম ঝিম করে ওঠে মাথা। কান ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। টলমল করে বিছানা। কি যে হয় এই বিছানায় শুয়ে ধুঁকতে তাকি আনিসের চেয়ে আর কেউ ভালো বোঝে। হাসিনা হয়তো এতক্ষণে গিয়ে নবাবপুরে উঠেছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি এবার নেমে এলো অঝোর ধারায়। আকাশ উজাড় করে। আনিস আলতো করে চোখ বুজলো।
বৃষ্টির এই গান বড় ভালো লাগে তার। মায়ের কোল থেকে আজ অবধি সেই একই অনুভূতির অনুরণন। বড় ভাল লাগে তার এই রুম রুমানি গান। বৃষ্টি বৃষ্টি। সে তখন নিতান্তই ছোট। তবুও আজ স্পষ্ট মনে পড়লো মায়ের সেই বাদলা দিনের গান। বাদলের মতোই গাঢ়। আর কি অদ্ভুত মাদকতা ছিল সে গানের সুরে। তার ছোট ভাইটিকে কোলে করে মা গাইাতো। হয়ত অমনি তাকেও কবে শুনিয়েছিল, মনে নেই তার। বাম ঝাম বৃষ্টির সাথে পাক খেয়ে সে গান তার হৃদয়ে ঝংকৃত হয়ে উঠল- ঝম ঝমা ঝম, ঝম ঝমা ঝম, বৃষ্টি আয় গো।
দুষ্টু খোকন টোপর মাথায় বিলের ধারে গো।। বিলের বারে যাসনে খোকা বৃষ্টি এলো ঐ। মায়ের হাতে মিষ্টি লাগে শুকনো কলা খৈ॥
স্পষ্ট দেখতে পেল সে মাকে। চোখ বুঁজে। তেমনি স্নিগ্ধ আর হাসিধোয়া। তেমনি সুন্দর। সহসা ছোট ভাই আশরাফের কণ্ঠস্বরে ওর ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায়। ভেতরের বারান্দা থেকে আশরাফ কথা বলছিল- : রোজ রোজ এই ঘ্যানঘ্যান আমি সহ্য করতে পারবো না বলে দিচ্ছি মা, হুঁ। শোনা গেল মা বল্লেন- তাইতো। : তাইতো আবার কি? মাস শেষে আমি কাঁচা টাকাগুলো গুনে গুনে দোব আর উনি ‘ইয়ে’ করবেন, ভারী বয়ে গেছে আমার। নাইট ডিউটি দিয়ে দিয়ে এদিকে যে আমার হাড়মাস এক হয়ে এল, সেদিকে যেন কারুর ভ্রুক্ষেপ নেই!
মা কি যেন বল্লেন চাপা গলায়, ভাল করে শোনা গেল না। আর শোনা না গেলেও কি যে বলেছেন মা, তা আনিস ভালো করেই জানে। আশরাফ এক দৈনিকে শিফট ইনচার্জ। মাসে পৌনে দু’শ করে পায়। আর আনিস? লেখাপড়া ওর চেয়ে বেশী শিখেও সোয়াশ’র ওপরে আজ অবধি যেতে পারেনি। কাজেই মায়ের কাছে আশরাফের প্রতিপত্তি বেশী। একথা আনিস ভালো করে জানে। আর এও জানে আশরাফ না থাকলে এই দু’কামরার বাসাও জুটতো কিনা সন্দেহ। ওর আয়েই খানিকটা বাঁচোয়া। আনিসের হাসি পেল মায়ের কথা মনে করে। মা। হ্যাঁ মা-তো বটেই। কিন্তু এমন প্রহসন কেউ কোনো কালে দেখেনি। ওদিকে ওদের কথাবার্তার এখনও ছেদ পড়েনি।
আশরাফ মাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে চায়? তা আলাদা হবার অধিকার ওর রয়েছে বৈকি? আনিস সেখানে বলবার কে? কিন্তু…। আর একগ্লাস জল খেয়ে নিল সে। একটু আগেও চোখ বুজে সে বৃষ্টির টুপ টাপের ভেতর শিশুকালে শোনা মায়ের গান শুনতে পেয়েছে। প্রাণভরে হাসতে ইচ্ছে হলো তার। আস্তে আস্তে বৃষ্টি এল কমে। আকাশে কালো মেঘের চাদর এবারে মাঝে মাঝে ছিঁড়েখুঁড়ে গেল। এক-দুই-তিন সময় বয়েই যাচ্ছে। আনিস আবার জানালার দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। ভিজে পথে রিক্সা চলেছে। দু’ হাতে কাপড় টেনে তুলে চলছে পথচারী। আর কেমন এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে, হয়ত-বা জলের। অনেক অ-নেকক্ষণ তাকিয়ে রইল আনিস আনমনে পথের দিকে। কার যেন পায়ের শব্দ। মুখ ফেরাল। মা। হাতে তার লেবুর রস। আনিস খানিকক্ষণ নির্জিব পড়ে রইল। তারপর চোখ তুলে দেখলে মা শিয়রে বসে রয়েছেন। : মা। : শরীরটা এখন কেমন লাগছে আনু। : ভালই। : নে এই রসটুকু খেয়ে ফেল দিকিনি। নাহলে এই দুর্বল শরীর নিয়ে যুঝবি কি করে? নে। একচুমুকে রসটুকু খেয়ে নিয়ে আনিস শুয়ে পড়ল পাশ ফিরে, বালিসে মুখ গুঁজে। মা আবার বললেন-: সন্ধ্যেত হয়েই এল। এখন আর শুয়ে থাকিস নে। উঠে বোস খানিক। : ভাল লাগছে না। : সে কিরে? সন্ধ্যে বেলায় শুয়ে থাকলে খোদার লানৎ পড়বে। আনিস হাসলো। বললে- : তাহলে বাইরে বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে দাও।
চাদরখানা গায়ে ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে চেয়ারে কাত হয়ে বসে রইল সে বড়রাস্তার দিকে মুখ করে। হাসিনার তো এতক্ষণে ফিরে আসার কথা। কিন্তু এখনও তো এলোনা। কতবার করে বারণ করা হোল হাসিকে, কিছুতেই ও শুনলো না। আনিসের হাতে টাকা নেই বলেই কি সে অমনি করে তার বোনের দুয়ারে হাত পেতে দাঁড়াবে? হাসিনা ভারী একগুঁয়ে। আনিস বিছানায় পড়ে না থাকলে হাসিনাকে ও যে-করেই হোক ধরে রাখতোই। কিন্তু, হাসিনা এতো দেরী করছে কেন? আনিস আকুলি বিকুলি বলতে লাগল নিজের মনেই। হাসিনা তুমি এসো। তুমি এসো। মা বাতি জ্বেলে দিয়ে গেলেন। সন্ধ্যার অন্ধকারে যে চোখ সহজ হয়ে উঠেছিল এখন আলোর ছোঁয়া পেয়ে তা জ্বালা করে উঠলো। আনিস বাতিটাকে পেছন করে করে বসলো।
সারাটা বাড়ীতে রয়েছে মা, আশরাফ, সে নিজে, হাসিনা আর তাদের ছোট খোকা শাহ্জাদা। এখন শুধু হাসিনাই নেই, আরতো সবাই রয়েছে। তবু বড় নিঃসঙ্গ ঠেকল আনিসের এই মুহূর্তে। মনে হোল তার যেন, সে একটা হানা বাড়ী রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। এ রাত আর ফুরুবে না। শাহ্জাদা এসে গাল ফুলিয়ে বলল (বয়সতো মোটে পাঁচ, গাল ফোলানোর সময় এখনও যায়নি) : দেখেছ আব্বা। চাচা আর পড়াবে না আমাকে। মারবে বলল। হ্যাঁ, তুমি চল না, চাচা আমাকে বকল। চল না।
আনিস কোনো কথা বললে না অনেকক্ষণ। পেছনে তাকিয়ে দেখলে আশরাফ পাশের ঘরে এলোমেলো আঁতিপাতি কি খুঁজছে। ওর স্বভাবই ওই। মিছামিছি ঘর আগোছাল করে রাখবে আর বিড় বিড় করবে। কি ও খুঁজছে? একসময়ে ধুপ করে চৌকির ওপর বসে পড়ল। আনিস মুখ ফিরিয়ে দেখলে শাহ্জাদা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছে। অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না শাহ্জাদার। আহা, বোধ হয় কাঁদছে। আনিসের মন বিষিয়ে উঠল।
হাসিনা এখনো এলো না। মা এসে মাঝে বলে গেছেন ভেতরে এসে বসতে, বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস বুকে লাগলেওতো লাগতে পারে। আনিস তবু বাইরেই বসে রইল। এতক্ষণে শাহ্জাদা পড়তে বসেছে। ‘চারের পিঠে পাঁচ পয়তাল্লিশ। চারের পিঠে ছয় ছচল্লিশ। চারের পিঠে সাত সাতচল্লিশ।’ সুর করে করে পড়ছে, দুলে দুলে- ‘চারের পিঠে আট চুরাশি।’ আটচল্লিশ বলতে ভুল করে চুরাশি বলছে। একবার দুবার। আনিসের ইচ্ছে হোল উঠে গিয়ে বলে দেয়, কিন্তু শরীর সায় দিলে না। আর আশরাফইবা কি করছে? চৌকির উপরেইতো শুয়ে রয়েছে, একটু বলে দিলে কিইবা হয়? শাহ্জাদা ভুল পড়েই চলল। ও ভুল আর শোধরাবে না। সহসা অনেক্ষণ পর আশরাফ তড়াক করে উঠে এসে শাহ্জাদার পিঠে কিল বসিয়ে দিল- ‘বাঁদর ছেলে, কেবল হৈ হুল্লোড়। বুদ্ধি শুদ্ধি মোটে নেই। কতবার বলে দিতে হয় একপড়া।’
আঃ অমন করে ছেলোটাকে মারে কেউ। আনিসকে ওরা কেউ ভালবাসে না। তাইতো আনিস ছেলেমানুষের মতো আবোল তাবোল ভাবতে শুরু করে। এক সময়ে মাথা ধরে আসে। দুহাতে কপালের রগ টিপে ধরে চোখ বুজে পড়ে থাকে। কাউকে ডাকবে না সে। কাউকে না। কিইবা প্রয়োজন? হাসিনা এসে একটু বিস্মিতই হলো। এই গা’ ভরা জ্বর নিয়ে আনিস কি করছে এখানে। মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো। : আনিস। কোনো উত্তর নেই। আনিস… : উ। চোখ খুললো ও। হাসিনা? সচকিত হয়ে সিধে হয়ে বসলো সে। : হাসিনা, এসেছো। এতো দেরী করে মানুষে? হাসিনা হাসলো- : এত দেরী কোথায়? ও তোমার মনের ভুল। চকিতে ঘরের ভেতরে টেবিল ঘড়ি দেখল। : কিন্তু কেন তুমি আমায় একলা ফেলে গেলে আজকে হাসি। : পাগল আর কি? মা রয়েছেন কেন? শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখ মুছলো… : তুমি ঠিকই বলেছিলে, না যাওয়াই উচিৎ ছিল আমার। কেন জানো? : থাক, আমি শুনতে চাইনে। : আমি জানতুম না দুটা পয়সা হাতে এলে মানুষ কি করে এত… : জেনে প্রয়োজনও নেই আমার। … হাসি, আমাকে নিয়ে ঘরে চল। হঠাৎ মাথাটা বড় ধরেছে। উদ্বেগের ছায়া পড়ল হাসিনার মুখে- : জ্বর বেড়েছে কি? : কি জানি। উদাস কণ্ঠে আনিস বল্লে। বিছানায় শুয়ে আনিস বল্লে- : তুমি আমার কাছে এসে বসো হাসি। এমন সময় আশরাফের গলা শোনা গেল- : এইযে ভাবী এসে গেছ দেখছি। জলদি জলদি ভাত দাও দিকিনি, অপিসে যেতে হবে। মা কি দিয়ে কি যে করছেন খোদাই জানেন।
হাসিনা চলে গেল। আর আনিসের মন আবার ফাঁকা হয়ে এল। এই নির্মম নিঃসঙ্গতা! হাসিনা তুমি কাছে এসো। আনিস শুকনো ঢোঁক গিলে চোখ বুজলো। আশরাফ বলছেঃ ভাবী আমার নতুন সিগারেট লাইটারটা দেখেছ? পরশু দিন কিনেছি, আজকেই উধাও। আশ্চর্য। দেখেছ নাকি? : দাঁড়াও। হাসিনা ঘরের ভেতরে এসে বালিশের পাশ থেকে ঝকঝকে লাইটারটি বের করে নিয়ে গেল। হয়ত আশরাফ এতক্ষণ ওটাই খুঁজছিল- আনিস ভাবলে। : এঃ স্ক্র্যাচড হয়ে গেছে দেখছি এটা। আশরাফ অনুযোগ করলো। একটা কিছু যদি বহাল তবিয়তে থাকে এ বাড়ীতে। কোথায় পেলে তুমি এটা? : মেঝেতে পড়েছিল। হয়ত শার্ট খুলতে পড়ে গিয়েছিল। আমি তুলে রেখেছিলাম। : নগদ সাড়ে সাতটাকা দিয়ে সায়েব কোম্পানী থেকে কেনা। তুমি কি বুঝবে?
ঠিকইতো হাসিনা কি বুঝবে। সাড়ে সাত টাকার লাইটার আর কোথায় এক আনার ম্যাচ। আনিসের হাসি পেল। আশরাফ এখনো ছেলে মানুষ। আবার ভাবলে, না! আশরাফ কি দোষ করেছে লাইটার কিনে। তারই বোঝবার ভুল। আশরাফ ঘরে ঢুকলো- : কেমন আছ ভাই, এখন? : ভাল নয়। : ও। আচ্ছা। সংক্ষেপে আরো দু একটা কথার উত্তর দিয়ে আনিস বল্লে- : আফিস থেকে আসবার সময় একবার ডাক্তারখানা হয়ে আসিস। আসতে আসতে তোরতো ভোর হয়ে যাবে, না? : হুঁ। আচ্ছা।
বেরিয়ে গেল আশরাফ শাহজাদার পিঠে একবার হাত ঝুলিয়ে। : দূর বোকা এখনও কাঁদছিস। অমন ভুল করলে কার না মারতে ইচ্ছে করে বল? আচ্ছা, আচ্ছা, তোর জন্য এক বাক্স লজেন্স আনব’খন। হোলতো। হাসিনাকে বাইরে ডেকে নিয়ে বলল- : ভাইয়ের আবার ফলমূল ইত্যাদি ইত্যাদি কিছু আনতে বলবে নাকি? সে আমি পারব না। পকেট শ্রেফ গড়ের মাঠ। হাসলো আশরাফ। আনিস চোখ বুজেই বুঝতে পারলে। কিন্তু সেতো জানে আশরাফ ভোর সকালেই এক ঠোঙ্গা দামী ফলমূল নিয়ে হাজির হবে। আশরাফ চিরকালই ওই রকম। হাসিনা এসে পাশে বসলো। আনিস বললো- : আমার কপালে একটু হাত বুলিয়ে দাও না লক্ষ্মী। : খুব কি শরীর খারাপ করেছে তোমার? : না, তেমন কিছু নয়। ভাবছি, এতো চিরদিন টিকে থাকতে পারে না। হোতেই হবে, নিশ্চয়ই। : কি? শঙ্কায় গলা বুজে এল হাসিনার। : কিছু না। হাসিনা ভাবলে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে আনিস। কিন্ত আনিসের চেয়ে আর কে ভাল জানে, সে প্রলাপ মোটেই বকছে না। আশরাফ?
এতক্ষণে মোড় থেকে রিক্সা করেছে নিশ্চয়ই। সহসা মনে হোল আশরাফ তার সম্পূর্ণ অপরিচিত। অতিথি ছিল যে। কাল ভোরে হয়ত সে নাও ফিরতে পারে। কাল ভোরে না হোক একদিন সেতো আর ফিরবে না… আনিস ভালো করেই জানে। হাসিনা বল্লে- : চুপ করে আছ কেন তুমি? : শাহ্জাদা কোথায়? : আম্মার কোলে। এখুনি আবার আমায় যেতে হবে ওকে বিছানার দিতে। : এখুনি? : কি হয়েছে তোমার? : হাসি, বৃষ্টির গান জানো? গাও না তুমি, আমি শুনবো। : ছেলেমানুষী করো না। হাসলো ও: ‘কন্যা কোথায় কন্যা কোথায় ধুধু ডাঙ্গার চর।’ মনে নেই তোমার। : ও গান শুনে তোমার কাজ নেই। নাও আর কথা বলো না। কথা বললেই মাথা ব্যথা আবার বেড়ে যাবে। ঘুমোও তো।
‘কাত্’ করে নিঃশ্বাস ফেলে আনিস হাসিনার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। বাইরে আবার মেঘ করে আসছে। আশরাফের অফিসে টেলিপ্রিণ্টারে দুনিয়ার খবর এসে মুখ থুবড়ে পড়ছে। হাসিনা গুন গুন করে উঠল… ‘কন্যা কোথায় কন্যা কোথায় ধুধু ডাঙ্গার চর। খোকন আমার চলছে তবু নেইকো কোন ডর।।’ ক্লান্ত ও ভারাক্রান্ত আনিস ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। হাসিনা ধীরে ধীরে ওর মাথাটা বালিশে নাবিয়ে দিল।
ভূমিকা: সৈয়দ শামসুল হক (২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫-১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) ৬ দশকের অধিককাল ধরে লিখেছেন বিচিত্র বিষয়ে নানান রচনা। কবিতা, কথাকাব্য, কাব্যনাটক, গল্প, উপন্যাস, শিশুতোষ রচনা, চলচ্চিত্রের কাহিনি, গান, আত্মজৈবনিক রচনা, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ মিলিয়ে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের লেখালেখির পরিমাণ বিপুল। তাঁর রচিত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২ শতাধিক।
কবিতা দিয়ে লেখালেখির সূচনা হলেও প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘উদয়ান্ত’ শীর্ষক একটি গল্প। ফজলে লোহানী (১৯২৮-১৯৮৫) সম্পাদিত ‘অগত্য’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে গল্পটি প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে আমৃত্যু তিনি বিরামহীন লিখে গেছেন।
প্রথম গল্প প্রকাশের তিন বছর পর ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘তাস’ প্রকাশিত হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে তাঁর শ্রেষ্ঠগল্প, গল্পসমগ্র, প্রেমের গল্প, সেরা দশ গল্প, গল্পগাথা ইত্যাদি শিরোনামে গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। সৈয়দ শামসুল হকের সমুদয় গল্প নিয়ে তিন খণ্ড প্রকাশিত গল্পসংগ্রহ শীর্ষক সংকলনে মোট ১০৫টি গল্প মুদ্রিত হয়েছে। সম্প্রতি ৩৫ খণ্ডে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও অনুসন্ধানে সৈয়দ শামসুল হকের অগ্রন্থিত গল্পের সন্ধান মিলছে। তেমনই এক অগ্রন্থিত গল্প হলো ‘রোগ’। এটি প্রকাশিত হয়েছিল মহিউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ‘স্পন্দন’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ : পঞ্চম সংখ্যা; ভাদ্র ১৩৬০ বঙ্গাব্দে। প্রায় সাত দশক পূর্বে প্রকাশিত এ গল্পে সে সময়ের বাস্তবতায় যে সমাজচিত্র লেখক অঙ্কন করেছেন দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তার কি খুব বেশি পরিবর্তন ঘটেছে? গল্পটি পড়ে পাঠক নিশ্চয়ই তা অনুধাবন করবেন।
সৈয়দ শামসুল হকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ‘রোগ’ গল্পটি প্রকাশের সময় লেখকের বানান রীতি অনুসরণ করা হয়েছে।