শিল্প ও সাহিত্য

হ‌ুমায়ূন আহমেদ কেন ‘অনন্য’ লেখক?

আমার বিবেচনায় হ‌ুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের অনন্য লেখক। আমি এখানে ‘অনন্য’ শব্দটা নেহাত বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করছি না। তিনি অনন্য, কারণ তিনি কাউকে অনুসরণ করেননি। তিনি অনন্য কারণ তিনি নিজেই নিজের পথ তৈরি করে নিয়েছেন। কাউকে অনুকরণ, অনুসরণ করার পথে হ‌ুমায়ূন আহমেদ চলেননি। শিল্প-সাহিত্যের কোনো চেনা পথে, গৎ-বাঁধা সূত্রে তিনি হাঁটেননি। তিনি কখনো কোনো সাহিত্যতত্ত্বের ধার ধরেননি। 

ব্যাপারটা একটু খোলাসা করা যাক। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিংবা শহীদুল জহির বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ দুজন লেখক। কিন্তু সমস্যাটা হলো তারা যতো বড় লেখকই হোন না কেন, তাদের আমরা বিবিধ পাশ্চাত্য মতবাদ দ্বারা বিচার করতে বসি। যাদুবাস্তবতাবাদ, অস্তিত্ববাদ বিশ্বসাহিত্যের এ সব বড় বড় মতবাদ দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়েছেন। প্রভাবিত হওয়া যে দোষের তা বলছি না। সমকালীন বা ধ্রুপদী যে কোনো মতবাদ, তত্ত্ব লেখককে আলোড়িত করতে পারে। যেমন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মহীরূহ লেখকও একটা সময় মার্ক্স এবং ফ্রয়েড দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বাংলা ভাষার এক অমিত শক্তিময় গল্পকার জগদীশ গুপ্ত আগাগোড়া ফ্রয়েডীয় যৌন সমীক্ষা দ্বারা তাড়িত ছিলেন। কিন্তু আমাদের হ‌ুমায়ূন আহমেদ সে অর্থে কারো দ্বারা আলোড়িত, প্রভাবিত হননি, অন্তত ভিনদেশি কোনো মতবাদের বলয়ে ঘোরেননি। নারীবাদ কিংবা অন্য কোনো মতবাদ দিয়ে তার লেখা চিহ্নিত করা যায় না। এই কারণেই তিনি অনন্য। 

আমার বিবেচনায়, একজন সত্যিকারের সৃজনশীল লেখক বিশেষ কোনো মতবাদ, পূর্ব নির্ধারিত কোনো বলয় দ্বারা পরিবেষ্টিত হন না। তিনি তার একান্ত নিজস্ব পথে চলেন। এই নিজস্বতা লেখককে অনন্য করে। তীব্র সমাজবাদের বলয় থেকে বেরিয়ে নিজের লেখা, ভাবনা আলাদা করতে পারেন বলেই তলস্তয়, দস্তয়ভস্কির মতো লেখকরা লাল ঝাণ্ডার সীমানা ভেঙে বৈশ্বিক হয়ে ওঠেন। পূঁজিবাদী দেশ থেকে তৃতীয় বিশ্ব সবখানেই তারা আদরণীয়, তাদের একান্ত নিজস্বতার জন্যই।

বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, পূর্বসূরীদের কোনো রকম প্রভাব ছাড়াই একজন তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, বোর্হেস, কাফকা, ক্যামু, বেকেট তাদের নিজের মত ও পথ তৈরি করেন। বোর্হেস কিংবা কাফকার পথ ধরে একজন মার্কেজ কিংবা মুরাকামিও এগিয়ে আসেন। তবে আমার শ্লাঘার বিষয়টি হলো হ‌ুমায়ূন আহমেদ কোনো বিদেশি সাহিত্য মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য রচনার চেষ্টাও করেননি। তাতে যা হয়েছে, ভালো-মন্দ যাই হয়েছে ‘হ‌ুমায়ূনীয় লেখনি’র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আজ আমরা অনেক উত্তরসূরীর মধ্যে এই হ‌ুমায়ূনীয় প্রভাব লক্ষ্য করি। মনে রাখতে হবে, একজন মাত্র লেখকের স্বনামেই বিশ্বসাহিত্যে একটি রচনাশৈলী প্রতিষ্ঠিত, সেটি হলো ‘কাফকায়েস্কো’। আমার বিবেচনায় ‘কাফকায়েস্কো’র মতো ‘হ‌ুমায়ূনীয়’ ভঙ্গিরও নিজস্বতা বিদ্যমান। সেই নিজস্বতা কি তা আমরা একটু আবিষ্কারের বা অনুসন্ধানের চেষ্টা করতেই পারি।

শুরুতেই যে বিষয়টি আমার নজর কাড়ে তা হলো হ‌ুমায়ূন আহমেদ একাই ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’ তৈরি করেছেন। ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’ বলতে আমি স্বাধীন বাংলাদেশের কথা বলছি, একাত্তরের পরের বাংলাদেশের কথা বলছি। বাংলাদেশের সাহিত্য বলতে আমি সেই সাহিত্যের কথা বলছি যা স্বাধীন বাংলাদেশ এবং এই ভূ-খণ্ডের বাঙালির স্বপ্ন-আশা-ব্যর্থতার কথা বলে।

সুষ্পষ্ট এবং বিস্তৃত করে বললে এটা বলতেই হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য অধিক জনপ্রিয় ছিল। একজন সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, বুদ্ধদেব বাংলাদেশের বইয়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সেই বাজারটাকে হ‌ুমায়ূন আহমেদ একা তার দিকে ঘুরিয়ে এনেছেন। এর ফলাফল শুধু অর্থনৈতিক জায়গা থেকে দেখলে চলবে না। কেননা, সাহিত্য কেবল বাজারকেন্দ্রিক নয়, সেটি ভূ-খণ্ড এবং স্থানীয় সংস্কৃতিকেন্দ্রিক। একজন জয়েস যেমন তার সমগ্র সাহিত্যে ডাবলিন আর আয়ারল্যান্ডকে তুলে ধরেন, জীবনানন্দ যখন বরিশালকেই বিশ্ব দরবারে নিয়ে যান তখন সাহিত্যের আঞ্চলিকতা বৈশ্বিক দিগন্ত পায়।

হুয়ান র‌্যামেন হিমেনেথ যেমন একবার বলেছিলেন ‘শেকড়ের ডানা হোক, ডানার শেকড়’। এই শেকড় আর ডানাকে সহজে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সঙ্গে মেলানো গিয়েছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে হিমেনেথের এই ডানা ও শেকড়কে আমরা আরও বিস্তৃত করে ভাবতে পারি। বিশ্বগ্রামের ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে টোকিও আর লন্ডনের মেলবন্ধন হবে, আর কলকাতা ও ঢাকার মেলবন্ধন হওয়া আরো জরুরি। কিন্তু শেকড়টা তো থাকতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের রচনায় যে কলেজ স্ট্রিট পাই আমাদের রচনায় সেই নীলক্ষেত অনুসন্ধান করাই যেতে পারে।

ঢাকা ও কলকাতা, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মিল যেমন অনেক, ফারাক তেমনি কম নয়। একই বাংলা ভাষা হলেও তার কথ্যরূপ যেমন আলাদা তেমনি লেখ্যরূপও আলাদা। শুধু ক্রিয়াপদের পার্থক্য জীবনানন্দের কবিতায় একটা আলাদা দোলা ও প্রলম্বিত শ্বাসাঘাত তৈরি করে, ‘ঘুমিয়ে থাকবো আমি’ আর ‘ঘুমায়ে রহিবো আমি’ এক অর্থ তৈরি করলেও অভিঘাত সম্পূর্ণই আলাদা। সেই আলাদা অভিঘাত বাংলাদেশের গদ্য সাহিত্যের জন্যে তৈরি করেছেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। ঢাকার মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর মুখের মান ভাষাকে তিনি গদ্যে এনেছেন অকাতরে, অন্যদিকে বৃহত্তম ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষাকেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সাবলীল আত্মবিশ্বাসে। ‘গিয়েছিলুম, দেখেছিলুম, করেছিলুম, বুঝলি দাদা’ ইত্যকার ভাষার প্রভাব বলয় থেকে তিনি আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্যের একটা নিজস্ব ভাষা তৈরি করেছেন। মাসী, পিসি, দাদা, দিদি, মেসো, ঠাকুরপো থেকে খালা, মামা, চাচা, দুলাভাই, শালা ইত্যাদিতে ফিরে আসা নেহাতই ধর্মীয় নয়। কারণ এ দেশে এখনও অনেক মুসলমান পরিবারে ভাইকে ‘দাদা’ বলা হয়। সে বলাতে কোনো আপত্তি নেই। সাহিত্যের কোনো কূপমুণ্ডকতা নেই। কিন্তু নিজের দেশকে, নিজের মানুষকে সাহিত্যে তুলে আনা কম কথা নয়। এই বিরাট কাজটিই করেছিলেন জয়েস, কাফকা, মার্কেজ, বোর্হেস, আচেবে’র মতো মহান লেখকগণ।

আমরা আজ আর্জেন্টিনা, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি কিংবা কলোম্বিয়া কিংবা নাইজেরিয়াকে পাই তাদের গ্রন্থ পাঠ করে। সেই বিবেচনায় হ‌ুমায়ূন পাঠে আমরা নিবিড় করে বাংলাদেশকে পাবো। গৌরীপুর থেকে মহম্মদপুর, বাসাবো থেকে সেন্টমার্টিন-  হ‌ুমায়ূন রচনায় বাংলাদেশের ভূগোল আর ইতিহাস পাই। বাঙালির জাগরণের গণঅভুত্থান, গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর হত্যার গ্লানি, সামরিক স্বৈরশাসন, বিচার বহির্ভূত হত্যা, গণমাধ্যমের দায়িত্বহীনতা এ সবই ঠাঁই পেয়েছে তার গল্প-উপন্যাসে। ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’র যে আলাদা একটা জাত আছে সেই জাতটা তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের জীবন, আমাদের শ্রেণীসত্তা, আমাদের চরিত্র প্রবণতা এ সবই তার সাহিত্যের বড় অংশ। বাংলাদেশের বাস্তবতা তিনি এমন করে তুলে ধরেছেন যে তাকে আমরা বাংলাদেশের নিজস্ব কণ্ঠস্বর মনে করি।

সবচেয়ে বড় কথা হ‌ুমায়ূন আহমেদ এ কারণেই আমাদের কালে এতো গুরুত্বপূর্ণ যে তার সমকক্ষ তো দূরের কথা, তার ধারে-কাছে আজও কেউ আসতে পারেনি। আমার জন্ম ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের জন্মও তাই। আমি তাই আমাদের কাল বলতে আমার নিজের জীবনের কালটাই বলতে চাই। আর এই কালটা ইতিহাসের খুব গুরুত্বপূর্ণ কাল। কারণ এ কালে আমরা একটা নতুন দেশের জন্ম দেখেছি, দেশের বিকাশ, বিস্তার, দুর্দশা, লড়াই, বেদনাও দেখেছি। আমার দেশ আমার মতোই। বহু বাধা বিপত্তি অন্যায়, অপশক্তিতে জর্জরিত কিন্তু প্রতি মুহূর্তে সে এগিয়ে যায়। হ‌ুমায়ূন আহমেদ এ কারণেই অনন্য যে তিনি আমাদের কালের লেখক। তাই তার গল্পে, উপন্যাসে আমরা নিজেদের মুখ খুঁজে পাই।

আমাদের কালে হ‌ুমায়ূন আহমেদ একইসঙ্গে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, সর্বাধিক পঠিত এবং সর্বাধিক অবহেলিতও বটে। এটাও আমাদের কালের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। আমরা গুরুত্বপূর্ণকে অবহেলা দেখানোর শ্লাঘাতেই ভুগি, আমরা পাঠ করি কিন্তু পাঠাভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করি না, আর অবহেলা করি কিন্তু ভবিষ্যতের কাছে তার দায় স্বীকার করি না।

নিজের কালকে ধরতে পারা মহৎ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। এই কাল চেতনা হুমায়ূন আহমেদে আমরা পাই। প্রসঙ্গত ডিকেন্সের ‘আ টেল অব টু সিটিজ’ এর সূচনা অংশটির কথা খেয়াল করাতে চাই : ‘It was the best of times, it was the worst of times, it was the age of wisdom, it was the age of foolishness, it was the epoch of belief, it was the epoch of incredulity, it was the season of Light, it was the season of Darkness, it was the spring of hope, it was the winter of despair, we had everything before us, we had nothing before us, we were all going direct to Heaven, we were all going direct the other way...’