শিল্প ও সাহিত্য

অনুবাদ গল্প || ঝাঁপ

ক্লিফের চূড়ায় বসে আছে একটি মেয়ে। একা।

নিচে, বহু নিচে তীরের শিলাখণ্ডগুলোর গায়ে অবিরাম গর্জন তুলে আছড়ে পড়ছে সাগরের নোনাজল। একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। অস্তমান সূর্যের শেষ গোলাপী আভা কুণ্ডলী পাকিয়ে-চলা ঢেউগুলোর ওপর খেলা করছে- মায়াভরা মনোরম এক দৃশ্য। কিন্তু মেয়েটির চোখ সমুদ্রশোভা নিরীক্ষণ করছে না। যেন কিছুই দেখছে না। দৃষ্টিতে বোবা শূন্যতা। শৈলচূড়া থেকে একেবারে খাড়া নিচের সমুদ্রজল ও শিলারাশির ভয়ানক দূরত্ব যখন লক্ষ্য করল, ভয়ে শিরশিরিয়ে ওঠল ওর শিরদাঁড়া। ‘ভয় করছে আমার,’ ঢেউগুলোর দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে স্বগতোক্তির মতো করে বলল। ফেনিল জলের গর্জনের নিচে চাপা পড়ে গেল ওর কণ্ঠস্বর।

অনেকক্ষণ ধরে ও বসে রইল একঠায়। সন্ধ্যা হবার সঙ্গে সঙ্গে দূর কোথাও থেকে ভেসে এলো তীক্ষ্ম হুইসেলের আওয়াজ। আর তখনই মাথা সোজা করে বসল মেয়েটি। হেসে ওঠল অপ্রস্তুত। আনন্দের হাসি নয়। মনের কোনও গোপন আর্তনাদ চাপা দেবার জন্য মানুষ যেরকম হাসে, ঠিক সেরকম। সেইসঙ্গে ওর মগজের অবয়বহীন এলোমেলো ভাবনাগুলি হঠাৎ একটা বিষয়ের ওপর এসে স্থির হলো।

‘কারখানার হুইসেল। শীঘ্রই ঘরে ফিরবে জিম। আর আমাকে না দেখে ভীষণ খেপে যাবে।...এখন ঘরে থাকতাম যদি, নির্ঘাৎ মারত... নাহ্! আমি কিছুতেই যাব না... ওহ্ গড! আমাকে সাহস দাও!’

সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টায় প্রার্থনার ভঙ্গিতে দু’হাত জড়ো করল মেয়েটি। কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াতে যাবে; হঠাৎ পিছলে গেল ডান পা। সেইসাথে পায়ের স্লিপারটাও খসে গিয়ে পড়ল নিচে। অন্ধকারে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল ও। কিছুই দেখা গেল না। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল। কিন্তু তীরের কাছে পাথরের গায়ে আছড়ে-পড়া ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পেল না।

‘স্লিপারটা গেছে; এবার আমিও যাব,’ মনে মনে বলল। তবে দুরু দুরু বুকে আবার এও ভাবল, পড়ে গিয়ে কোথাও ব্যথা পাবে কিনা। কল্পনায় দেখতে পেল, ওর দেহটা পড়ে আছে। দুমড়ানো। ভয়ানক আহত। কিন্তু জীবিত। অমনি শিউরে উঠল আতঙ্কে। নাহ্! জিমের কাছেই ফিরে যাবে ও। সেটা খুব খারাপ হবে যদিও, তবু তো ওর জানা আছে, সেই অভিজ্ঞতাটা কেমন।

‘যদি খানিকটা সাহসী হতাম,’ ভাবল আবার, ‘কিছুতেই ফিরে যেতাম না।’

ফিরে যাবার কোনও চেষ্টা অবশ্য ও করল না। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে শুরু করল। হঠাৎ মনে হলো, কাছে-ধারে কেউ একজন আছে। তাকিয়ে দেখল, এক আগন্তুক দাঁড়িয়ে ওর পাশে।

‘কী ব্যাপার?’ কোমল গলায় জিজ্ঞেস করল আগন্তুক। কিন্তু অন্ধকারে লোকটার মুখ দেখতে পেল না ও। লোকটির কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যা ওর মনের ভয় দূর করে দিল। বলল, ‘আমি মরতে চাই।’ নিচের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে দেখালো।

‘কিন্তু কেমন ভয় লাগছে।’ ‘আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।’ লোকটির কণ্ঠে গভীর সহানুভূতির ছোঁয়া। ‘তবে আগে তোমাকে অবশ্যই বলতে হবে কেন মরতে চাও।’

লোকটি ওকে ওর আত্মহননের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার কোনো উপদেশ বা পরামর্শ দিচ্ছে না দেখে মোটেও অবাক হলো না মেয়েটি। বরং তাকে যথেষ্ট সহমর্মী বলে মনে হচ্ছে ওর। লোকটির কাছে মনের সব কথা খুলে বলার তাগিদ বোধ করল ও। কাঁপা কাঁপা গলায় হোঁচট খেতে খেতে বলতে লাগল ওর কাহিনি।

‘আমি ববকে ভালোবাসতাম। আর বাবা-মা আমাকে বিয়ে দিল জিমের সাথে। কারণ, জিমের ছিল টাকা আর বাড়ি। কিন্তু ও আমাকে ভালবাসত না। তাই আমিও ওকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। চোখে-মুখে তিক্ত ঘৃণার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে ডানহাতের আঙুলের নখগুলো ওর বামহাতের তালুর উল্টাপিঠের মাংসে সজোরে গেঁথে দিতে লাগল মেয়েটি। বেরিয়ে এলো ফোঁটা ফোঁটা তাজা রক্ত।

‘হ্যাঁ। তারপর?’ জিজ্ঞেস করল আগন্তুক, আরও কিছু শোনার আশায় উদগ্রীব। ‘ওকে ভালবাসতে চেয়েছিলাম। পারি নি। ও ছিল একটা বদ্ধ মাতাল। পশু। বব কিন্তু ছিল বরাবরই কোমল। জিম ঘরে না থাকলে আমাকে দরকারি টুকিটাকি জিনিস এনে দিত। একদিন জিম আমাকে খুব মারল। ঘরে বসে কাঁদছিলাম। বব এসে দেখল, আমি কাঁদছি। দেখল, আমার দু’হাতে অনেক দাগ। ও তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক সান্ত্বনা দিল।’

এ পর্যন্ত বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ রইল মেয়েটি। যেন এ ঘটনার স্মৃতির মধ্যে যে আনন্দ আছে, তার স্বাদ পুরোপুরি উপভোগ করে নিতে চায়। এরপর আবার বলতে শুরু করল: ‘সিদ্ধান্ত নিলাম, বব যখন যথেষ্ট টাকা জোগাড় করতে পারবে, আমরা দু’জন একসাথে দূরে কোথাও চলে যাব।’ স্মৃতির পাক-লাগা সুতাগুলো একে একে খুলে ধরতে লাগল মেয়েটি: ‘জিম সেদিন কিছু আগেভাগেই ফিরে এসেছিল। আমি ববকে লুকিয়ে রাখলাম। ঘরে ঢুকে মাতাল অবস্থায় জিম আমাকে মারতে শুরু করল। চেষ্টা করলাম শক্ত থাকতে। পারলাম না। কান্না জুড়ে দিলাম। আমাকে সাহায্য করার জন্য লুকানোর জায়গা থেকে বেরিয়ে এলো বব। এবং জিম ওকে হত্যা করল।’

আগন্তুক নিশ্চুপ।

মেয়েটি বলে যেতে লাগল, ‘বিচারকরা জিমের পক্ষে রায় দিল। স্বামীর ন্যায্য পাওনাটা স্ত্রীর কাছ থেকে যথাযথ পায় নি, এই যুক্তি দেখিয়ে খালাস দিল ওকে। ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে এলো যখন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলো।’

এই পর্যন্ত বলে থামল মেয়েটি। একটু পর যোগ করল, ‘আমি ববের কাছে চলে যেতে চাই। কিন্তু সাহস পাচ্ছি না।’

মেয়েটির আরও কাছে সরে এলো আগন্তুক। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এক সেকেন্ড মাত্র। সবকিছুর সমাপ্তি ঘটবে মাত্র এক সেকেন্ডে।’

অন্ধকারে দুলে উঠল মেয়েটির পলকা দেহ। ‘না, আমি পারব না,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। আরও এক পা এগিয়ে এলো আগন্তুক। ধীর প্রশান্ত গলায় বলল, ‘তুমি একা নও। আমিও যাবো সঙ্গে।’ ‘কিন্তু কেন?’ বলল মেয়েটি। তারপর হঠাৎ মন্ত্রপুতের মতো লোকটির দিকে বাড়িয়ে দিল হাত। কিন্তু সে হাত না ধরে একাই পাহাড়ের কিনারে এগিয়ে গেল আগন্তুক। অদ্ভুত কোমল স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এসো।’ এগিয়ে গেল মেয়েটি। কিন্তু নিচে পাথরের গায়ে ঢেউয়ের শব্দ কানে আসা মাত্র থমকে দাঁড়ালো। ধারালো খাঁজকাটা পাথরগুলোর কথা মনে হতেই পিছিয়ে এলো এক পা। ‘আমার ভয় করছে।’ ‘ঠিক আছে, তাহলে ফিরে যাও জিমের কাছে।’ কথাগুলি যেন ছুঁড়ে দিল আগন্তুক। ‘না! না!’ চিৎকার করে ওঠল মেয়েটি। ‘জিম ও ববের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে তোমার। সময় বেশি নেই হাতে।’ ‘হ্যাঁ, আমি ববের কাছে যেতে চাই। কিন্তু...’ ফুঁপিয়ে ওঠল ও। ‘এক সেকেন্ড মাত্র।’ আগন্তুকের কণ্ঠে ব্যগ্র আহ্বান। ‘এবং তারপরেই অনন্ত মুক্তি।’

মেয়েটি আবার ভয়ে কেঁপে ওঠল- ‘এতো অন্ধকার!’

‘নিচে আছে আলো।’ ‘কিন্তু ওখানে যে খুব ঠাণ্ডা!’ ‘আমার দু’হাতে আছে উষ্ণতা,’ মৃদু হেসে বলল আগন্তুক। কণ্ঠে পরম মমতা ঢেলে যোগ করল, ‘এসো।’ বাড়িয়ে দিল হাত। মেয়েটি হাত ধরতে চাইল। পারল না। কারণ, ইতোমধ্যে আগন্তুকের দেহটা নিচে নেমে যেতে শুরু করেছে। অন্ধকারে। তার দেহের চারপাশে একটা অদ্ভুত আলো। এখন আর তেমন অন্ধকার দেখাচ্ছে না। হঠাৎ সাহস অনুভব করল মেয়েটি। ‘দাঁড়াও,’ চিৎকার করে বলল, ‘আমিও আসছি।’

ধীরে, খুব ধীরে নিচে নেমে যেতে যেতে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে আগন্তুক। হাসিটা অবিকল ববের মতো। দু’হাত বাড়িয়ে আছে ওর উদ্দেশে। মুখটা এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে- আরে! এ যে সত্যি বব! এতোক্ষণ যাকে ও চিনতে পারে নি। মুহূর্তের দ্বিধা মুছে দিয়ে অমনি ববের প্রসারিত দু’হাতের ভেতর ঝাঁপ দিল ও।

এবং ওদের যুগল আলিঙ্গনাবদ্ধ দেহ নিচে, আরও নিচে নেমে যেতে লাগল। ববের উষ্ণ ঠোঁটজোড়া চেপে আছে ওর ঠোঁটের ওপর। ও টেরই পেল না, চারপাশ থেকে বিপুল অতল অদ্ভুত প্রশান্তির ঢেউ এসে কখন পুরোপুরি ঢেকে দিয়েছে ওর ছোট্ট পলকা শরীরখানা।

মার্কিন ঔপন্যাসিক ও কবি ডরোথি কুইকের জন্ম ১৮৯৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর; ব্রুকলিনে। একদম শৈশবেই মার্ক টোয়েনের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। নিবিড় বন্ধুত্বের এই সম্পর্ক অটুট ছিল টোয়েনের মৃত্যু অব্দি। টোয়েন শিশুদের খুব ভালোবাসতেন এবং ডরোথিকে ভালোবাসতেন নিজ কন্যাসন্তানের মতো। ডরোথি গারট্রুড কুইক ছয়টি উপন্যাস ও নয়খানা কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। Strange Awakening তাঁর নামকরা উপন্যাস। নানা ঘরানার বেশ কিছু ছোটগল্পও আছে তাঁর। ডরোথি মারা যান ১৫ মার্চ, ১৯৬২।  তাঁর এই গল্পটি Edge of the Cliff নামক ছোটগল্পের অনুবাদ।