পাঠকপ্রিয় কার্টুন ক্যারেক্টার ‘বেসিক আলী’র স্রষ্টা শাহরিয়ার খান। সাংবাদিকতা করলেও কমিকস আঁকিয়ে হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত এবং জনপ্রিয়। গ্রাফিক নভেল ‘লাইলী’ তার অনবদ্য সৃষ্টি। তার কমিক কার্টুন সিরিজ ‘বাবু’ দেশের কিশোর-তরুণ পাঠক লুফে নিয়েছে। ছেলেবেলা থেকেই কমিকস আঁকছেন তিনি। এই সাক্ষাৎকারে বলেছেন কমিকস নিয়ে তার ভাবনার কথা, সম্ভাবনার কথা। পাঠকের কাছে কমিকস আরো ছড়িয়ে দিতে প্রকাশকদেরকেই যে এগিয়ে আসতে হবে অকপটে বলেছেন সে কথাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুজাহিদ বিল্লাহ
‘বেসিক আলী’কে কিশোর, তরুণ-পাঠক লুফে নিয়েছে। আপনি কখন এমন একটি চরিত্র তৈরির কথা ভাবতে শুরু করলেন?
আমি ছোট থেকে কমিকস পড়তাম। খুব ছোট থাকতে আমি নিজেই কমিকস আঁকার চেষ্টা করতাম। নিজেই ম্যাগাজিন বের করেছিলাম ৮০ সালের দিকে; ‘বাবু’ নামে। অনেক সময় বন্ধুবান্ধব মিলে একটা কার্টুন ম্যাগাজিন বের করতে চেয়েছি। কারণ আমি কমিকস পছন্দ করি। সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ‘ডেইলি স্টার’র বিভিন্ন পাতায় রিউমার কার্টুন দিতাম। ‘প্রথম আলো’ একবার সিদ্ধান্ত নিলো যে, তারা একটি স্ট্রিপ (এক লাইনের কার্টুন) কার্টুন চালু করবে বাংলাদেশে। তখন আমার নিজস্ব একটা প্রজেক্ট ছিল- লাইলী। তো লাইলীকে আমি ‘প্রথম আলো’তে অফার করলাম। কিন্তু তারা না করল। আমার আসলে এ ধরনের প্রচুর কাজের প্রজেক্ট ছিল। তবে এগুলো পাবলিশ করব এমন চিন্তা করিনি; মন চেয়েছে করেছি। তারা চেয়েছিল এমন একটা ক্যারেক্টার যেটা ফ্যামেলি ক্যারেক্টার হবে, ক্লিন ইমেজের হিউম্যান হবে। মার্জিত থাকবে, স্মোক করবে না- এসব এড়িয়ে থাকতে হবে। সেখান থেকেই মূলত বেসিক আলীর শুরু। তবে এর আগেও আমি স্ট্রিপ কার্টুন এঁকেছি।
বুঝতে পারছি, ছেলেবেলা থেকে কমিকস-এর প্রতি আপনার তীব্র আকর্ষণ রয়েছে। তো কখনও কি ভেবেছেন কমিকস নিয়েই ভবিষ্যতে কাজ করবেন?
এটা আমার কাছে একটা খেলার মতো। বাচ্চারা যেমন ছোটবেলা খেলতে পছন্দ করে, ওই বয়সে আমি কার্টুন-কমিকস পছন্দ করতাম। ছোট থেকে আমি প্রচুর কমিকস-এর বই পড়েছি। আমার বাসায় প্রচুর বই ছিল। আমরা সে সময় বেড়ে উঠেছি আসলে মুক্তভাবে। এখন বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যেটা চাইলেও সম্ভব না। সে সময় বিকেলবেলা খেলতে না গিয়ে বাসায় থাকা ছিল অস্বাভাবিক। অনেকের ক্ষেত্রে যেটা হয়- বাসা থেকে বলে, দ্রুত বাসায় ফিরবি, সন্ধ্যার আগে ফিরবি। আমাকে বাসা থেকে বের করে দিত যেন বিকেলে খেলতে যাই। কার্টুন-বই নিয়ে বসলে আমি প্রচুর ঘরকুনো হয়ে যেতাম। তো আমি যখন কমিকস-এ ডুবে গেছি, মা তখন আমাকে রীতিমতো মারধর করে বাসার বাইরে বের করে দিতো খেলতে যাওয়ার জন্য। কমিকস নিয়ে ডুবে থাকার কারণে আমার কিছু কমিকস ক্লাস সেভেনে থাকতে মা পুড়িয়ে দিয়েছে।
আপনি যে সময়ে শুরু করলেন, সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কমিকস কীভাবে বদলে যেতে দেখেছেন?
যেটা ভেবেছিলাম যে, আরও তৈরি হবে কিন্তু হয়নি। বইমেলা হচ্ছে, মেলার প্রসার ঘটছে, কিন্তু আসলে যেটা ভেবেছি সেটা হয়নি। অনেক কমিকস ক্রিয়েটর আসেনি। গত ১০-১৫ বছরে অনেক কমিকস পাবলিকেশন্স হয়েছে যেটা আগে ছিল না। ঢাকা কমিকস তাদের একটি। আমার প্রথম কমিকস-এর বই ‘লাইলি’ ২০০৭ এর দিকে প্রকাশ পেল। এরপর পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে তারা প্রতি বছরই কমিকস বের করেছে। এখন অনেক আর্টিস্ট তৈরি হয়েছে, কাজের জায়গা বেড়েছে, কিন্তু আমি এখনো বলবো না যে- এটা মেইনস্ট্রিম প্ল্যাটফর্ম হওয়ার মতো হয়েছে।
কমিকস-এর মূল পাঠক কারা বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের দেশে কমিকস-এর বড় পাঠক তরুণরা। যদিও বাইরের দেশে সব বয়সের লোকেরাই পড়ে, বুড়োরাও কমিকস পড়ে। কিন্তু আমাদের দেশে কমিকসগুলো বানানো হয় তরুণদের জন্য।
অন্য দেশের কমিকস-এর সঙ্গে আমাদের দেশের কমিকস-এর পার্থক্য কতটা বলে মনে করেন?
কমিকস আসলে একটা কালচার তুলে ধরে। আমাদের দেশে তো রেস্ট্রিক্টেড কালচার। আনন্দ করা যাবে না, কথায় কথায় ছবি আঁকা যাবে না- অনেক নিষেধ রয়েছে। এ ধরনের নানা ফ্যাক্টর আছে সেটাই রিফ্লেক্টেড হয়। আমি মনে করি যে, কমিকস-এর এখনো বাংলাদেশে মুক্তভাবে রিফ্লেক্স করা হয় নাই। যদি জাপানের সাথে তুলনা করেন, জাপানে কমিকস হচ্ছে বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রি। জাপানে যারা কমিকস আঁকে এবং সাকসেসফুল হয় তাহলে তারা ধনী হয়ে যায়। এটা আজকের কালচার না, জাপানে ৭০-এর দিক থেকে এটা হয়ে আসছে। প্রতিবছর এই শিল্প বিস্তৃত হচ্ছে। শুধু জাপান নয়, কোরিয়া, চায়না সব জায়গাতেই কমিকস খুব জনপ্রিয়। আমেরিকা তো আছেই। ইউরোপে একটু কম, তবুও আছে।
কমিকস আঁকার সময় আগে থেকেই কি প্লট ঠিক করে নেন? নাকি আঁকতে আঁকতে একটা গল্প দাঁড়িয়ে যায়?
অবশ্যই ভাবনাটা আগে আসে, ভাবনা থেকে ছবি। ছবি আঁকলে তো সেটা আর্ট হবে, কমিকস হবে না। আগে আমরা আসলে ভাবি যে কোন বিষয়ের উপর কন্টেন্ট করব, এরপর সে ভাবে কাজটা করা হয়।
যখন ভাবছেন তখন পাঠকের বয়সের কথা মাথায় রেখে গল্প বেছে নেন কি না?
আমি বয়স ভেবে কাজ করি না। আমার যেটা ভালো লাগে সেটা করি। তবে এটুকু আমার মাথায় থাকে যে, তরুণরা পড়ে, ফলে যতটুকু ক্লিন ইমেজে করা যায়। আমরা যদি ভাবি যে, বাচ্চাদের দিয়ে আমরা বাচ্চাদের বই লেখাবো বা কিছু করাবো তবে সেটা ঠিক নয়। বিশ্বের যত বড় বড় শিশুসাহিত্যিক রয়েছেন তারা অনেকেই বয়স্ক ছিলেন। আমাদের দেশে আসলে এটা একটা বিরাট গ্যাপ। এখানে যেসব বই হয় খুব বোরিং! আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ মিডিওকার। ভালো ভালো পজিশন হোল্ড করে, তাদের কোনো ক্রিয়েটিভিটি নাই। তারা খুব টিপিক্যাল চিন্তাভাবনার বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করতে পারে না। তারা যে সেখানে একটা নতুন কিছু স্মার্টলি ঢোকাবে; আমি পারি বা না পারি, আমার ছেলে বা মেয়েরা বা অন্যরা সেই জিনিস পারবে, তারা এ সবের পৃষ্ঠপোষকতা করে না।
কমিকস খুব বেশি হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা কোথায়? আর্টিস্ট সংকট নাকি প্রকাশকরা এখনো গল্প-কবিতার মতো কমিকস-এ অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি?
এটা আসলে প্রকাশকদের সমস্যা। আমাকে যখন ‘পাঞ্জেরী’ অফার করে তখন আমি ধরে নিয়েছিলাম যে, এর বাজার নাই। আমার ‘লাইলী’ কনসেপ্ট তখন ছিল রেডি। আমি ভেবেছি ধীরে ধীরে পত্রিকায় ছাপবো। কিন্তু বই আকারে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি দেখলাম, এটার বাজার আছে। আমি একজন রাইটার। আমার স্কিল হচ্ছে কনটেন্ট আঁকায়। আমার স্কিল তো মার্কেটিং না কিংবা বই বিক্রি করায় না। আমাদের দেশের প্রকাশকরাও মিডিওকার। তাদের রিস্ক নেওয়ার সাহস নাই। তারা যে জিনিস বেশি চলে সেই জিনিসটাই করতে চায়। তারা নতুন কিছু তৈরি করবে এই সাহস রাখে না, এই বুদ্ধিও তাদের নাই। কমিকস আর্টিস্টদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পত্রিকার যেমন একটা রোল আছে। প্রকাশকদেরও এই রোল প্লে করা উচিত। ঢাকা কমিকস আর পাঞ্জেরী ছাড়া হয়তো দু’ একটা প্রকাশনা কমিকস নিয়ে কাজ করে; কিন্তু সিংহভাগই করে না। প্রকাশক যদি আরো না আসে এবং পৃষ্ঠপোষকতা না থাকে তাহলে কিছুই হবে না।
এ ক্ষেত্রে কিছু প্রকাশক বলেন যে, আর্টিস্টদের সম্মানী বেশি হওয়ায় তারা দিতে পারেন না। বুক ইলাস্ট্রেশনের ক্ষেত্রেও তারা এ কথা বলেন। আপনার কি মনে হয়- কমিকস আঁকিয়েদের পর্যাপ্ত সম্মানী দেওয়া হয়?
আমাদের দেশে আসলে এখনো জিনিসটা পরিপক্ব হয় নাই- তাই এখানে আর্টের মূল্য পাওয়া যায় না। ধরেন সেবা প্রকাশনী একসময় মাসুদ রানার হয়তো একটি বই ৪০ হাজার কপি বিক্রি করেছে এক মাসে। তারা এর রিপ্রিন্ট করতে করতে ক্লান্ত। এটা সেই সময় যখন ইন্টারনেট ছিল না, লিমিটেড এন্টারটেনমেন্ট, পড়ার কালচার ছিল। এখান এটা চেঞ্জ হয়ে গেছে। তবে মানুষ কম পড়ে এমন না, মানুষের স্বভাব চেঞ্জ হয়ে গেছে। মানুষ হয়তো এখন আগের চেয়ে আরো বেশি এক্সপোজার, কিন্তু তাদের অ্যাটেনশন কম। এখন এটা ম্যাটার আপ টু দ্যা পাবলিশার্স। তারা নতুন এই বিষয়টিকে কীভাবে গ্রহণ করবে এটা তাদের ব্যাপার। কমিকস নিয়ে তারা (প্রকাশক) কীভাবে ব্যবসা করবে তাদেরকেই ভাবতে হবে।
কমিকসে যারা নতুন এসেছে, সেই তরুণদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?
তাদের জন্য একটা পরামর্শ প্রচুর কমিকস দেখা, জানা। যত বিখ্যাত কমিকস আর্টিস্ট আছে তাদের কাজ দেখা। প্রচুর নিজে নিজে চেষ্টা করা। কমিকস আর্টিস্টদের নিজস্ব কনভেনশনাল ট্রেনিং নেই। আর্ট কলেজ থেকে বের হয়ে কীভাবে গল্প করবেন সেটা আপনাকে শেখাবে না। বিদেশে অবশ্যই এটা আছে, শেখানো হয়। বাংলাদেশে এটা আসলে অনেকটা সাঁতারের মতো, আপনাকে যতই থিওরি দিক, পানিতে নেমে নিজে সাঁতার না দেওয়া পর্যন্ত আপনি বুঝতে পারবেন না কীভাবে সাঁতার কাটতে হয়। কমিকস আর্টিস্ট যারা আছে তাদের ক্ষেত্রেও সেইম।