পান্তা রাঁধতে হবে? কেমন করে পান্তা রাঁধব! আমি ঢাকায় থাকি, একটা করপোরেটে চাকরি করি। বউ গেছেন বিদেশে, বেড়াতে। বাসায় আছি দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে। তারা জেদ ধরেছে, বাবা, এইবার পহেলা বৈশাখে পান্তা খাব! এই রে কি মুশকিল! আমি আবার নিজের রান্না নিজে করতে পছন্দ করি। এখন পান্তা রাঁধতে হয় কী করে! প্রথমে ইউটিউবে ভিডিও দেখলাম। প্রথমে ভাত রাঁধতে হবে। তারপর ভাতের মধ্যে পানি ঢেলে দিতে হবে। ভাত যে রাঁধব, চাল কোন ধরনের নেব? সেদ্ধ চাল, নাকি আতপ চাল। বাসমতী, নাকি নাজিরশাইল। লাল চাল, নাকি সাদা চাল। পোলাওয়ের চাল নাকি বিরিয়ানির চাল। প্যাকেটের চাল, নাকি খোলা চাল। ভাত যে রাঁধব, তা কি চুলায় নাকি ওভেনে।
ইউটিউবে রুমানার রান্নাঘরে পান্তা বানানোর রেসিপি দেখে দেখে পান্তা বানানোর কাজ শুরু করলাম। মোটা সাদা চাল। সেদ্ধ না আতপ চাল, জানি না। আমি সেদ্ধ চালই নিলাম। বলা হলো, ভাত রেঁধে নিতে হবে। রাঁধলাম। তারপর বলল, ভাত ঠান্ডা করতে হবে। তাই ফ্রিজে ঢোকালাম। তারপর বের করে নিয়ে পানি দিয়ে রেখে দিলাম। এসি রুমে রাখলাম। পরের দিন সকালে পান্তা বের করে দেখি, ভাত আর পানি আলাদা আলাদা। চাল ফুলে ওঠার কথা। শক্ত শক্ত রয়ে গেছে।
প্রথম দিনের চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তখন শুনলাম, পান্তার জন্য ফ্রিজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ভাত ঠান্ডা করতে হবে বাইরে। তারপর পানি দিতে হবে। তারপর পানিওয়ালা ভাত রাখতে হবে গরমের মধ্যে। এসি ঘরে রাখলে হবেই না। আর বেশিক্ষণ রাখতে হবে। বুঝেছি কী করতে হবে। আগের রাতে ভাত রেঁধে ঠান্ডা করলাম। তারপর পানি দিয়ে একটা টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিতে মুখবন্ধ করে পুরোটা চালান করে দিলাম কম্বলের ভেতরে। পরের দিন দুপুরবেলা বের করে মুখে দিলাম। বেশ হয়েছে খেতে। আরো ভালো হোক। রাতের বেলা দেব ছেলেমেয়েদের। বিকালে চুপি চুপি নিজেই লবণ পেঁয়াজ বাসি ডাল দিয়ে এক থালা সুরুৎ সুরুৎ করে খেয়ে ফেললাম। সন্ধ্যা নাগাদ আইসিসিডিআরবিতে। আমাকে এখন স্যালাইন দেয়া হচ্ছে।
আপনি যদি আমাকে বলেন, সবচেয়ে কঠিন রান্না কী? আমি বলব, পান্তা! ভাগ্য ভালো, বাচ্চারা আমার বানানো পান্তা খায়নি। তাহলে সবাই মিলেই এখন হাসপাতালে থাকতে হতো। এরপর থেকে পান্তা রাঁধার কথা কেউ বললেই আমি আঁতকে উঠি। বউ তো হেসেই গড়াগড়ি খাচ্ছে ভিডিও কলে। একটু পান্তা বানাবে, পুরা হাসপাতাল মাথায় তুললে। আমার অফিসের একজন করিৎকর্মা লোক আছে। হাওর এলাকায় বাড়ি। সুন্দর গান গায়, সকি গো, আমি পুল বন্দু পুলের ইশারা। সেদিন আমাকে বলল, স্যার, যা গরম পড়ছে, পানটা খাইলে বালো হয়। আমি বলি, পানতা, না না। ও বড় ঝামেলা! আরে স্যার, জামেলা কী? বোতলে পানটা পাওয়া যায়। কয়ডা বোতল কিনিয়া আনি। বোতলে পান্তা পাওয়া যায়? যাহ্। সে কিনে আনল। কয়েকটা বোতল। আনার পর দেখলাম, ফান্টা। আমার এই সহকর্মী ‘ফ’ কে ‘প’ বলে। ফান্টাকে পানটা বলেছে। আমি শুনেছি পান্তা।
যেমন সেদিন এক বিয়ে বাড়িতে গল্প হচ্ছে। ওই ওদিকে আছে পান। তা চলো ওই দিকে যাই। আমি শুনেছি, ওই ওদিকে আছে পানতা, চলো, ওই দিকে যাই। ভয়ে ভয়ে এগুলাম। গিয়ে দেখি, পান্তা নয়, পান। তা থাকতেই পারে। বিয়েবাড়িতে পান দেয়া এখনকার রীতি। অবস্থা এমন হয়েছে যে, সব কিছুতেই আমি পান্তা দেখি। পান্তা শুনি। আমার দুই বাচ্চা আমাকে বলছে, বাবা, পান্তাবুড়ির গল্প শুনবে। আমি বলি, কিসের গল্প? পান্তাবুড়ি। সে আবার কী? এক ছিল বুড়ি। সে রোজ পান্তা বানিয়ে হাঁড়িতে রাখত। চোর এসে পান্তা খেয়ে যেত। একদিন সে করল কী, হাঁড়িতে রেখে দিলো শিংমাছ। যেই না চোর এসে হাঁড়িতে হাত দিয়েছে, অমনি শিংমাছের কাঁটা বিঁধল তার হাতে। শিংমাছের কাঁটায় থাকে বিষ। চোর ব্যথায় কেঁদে উঠল।
বাবারে! এখন কি শয়নে স্বপনে আমি পান্তা দেখব!
ওই দিন অফিসে দুপুরে সবাই খাবার এনেছে ফুডফান্ডা করে। আমাকে বলল, আমি কি খাব? আমি বললাম, কী এনেছ? ওরা কী বলল ওরা জানে। আমি শুনলাম, পান্তা। আমি না না করে উঠলাম। একটু পওে দেখি, ওরা পাস্তা খাচ্ছে। ওরা বলেছে পাস্তা, আমি শুনেছি পান্তা। কোনো মানে হয়! সেদিন একজন এসেছেন। আমার অফিসের বাইরে বসে আছেন। স্যার, আপনার কাছে একজন ভিজিটর এসেছেন। কে? নাম বললেন স্যার কান্তা। কী? পান্তা। না না হবে না। আমি বলে দিলাম।
একটু পরে দেখি, তিনি আমার আরেক সহকর্মী খালেদের ঘরে বসে আছেন। একটা অফার দিতে। পুরো পরিবার মালদ্বীপে সাতদিনের ভ্রমণ। এটা তাদের প্রমোশন। ওখানে গিয়ে কয়েকটা রিল বানিয়ে প্রচার করতে হবে। আমার যেহেতু কিছু ফলোয়ার আছে, একটা ভালো ডেজিগনেশন আছে, আমাকেই প্রথম অফারটা দিতে এসেছিলেন মিজ কান্তা। আমাকে না পেয়ে তারা সেকেন্ড চয়েসে গেছেন। আমার বন্ধু খালেদ। আমার অফার চলে গেছে খালেদের কাছে। খালেদ বিনাপয়সায় মালদ্বীপ যাচ্ছে। একটা বিমান কোম্পানির প্রমোশনে। না। আমি আর পান্তাকে অপছন্দ করব না। সেদিন যখন বলল, স্যার, পান্তা খাবেন? আমি রাজি হলাম। এলো একটা মিষ্টি। এটা কী? পানতোয়া স্যার। তোমরা না বললে, পান্তা। না স্যার। আমরা বলেছি পানতোয়া। আপনি তো স্যার পান্তাই শুনবেন। না রে। সুগার লেভেল ঠিক নেই। পানতোয়া খাব না।
এই চলছে। যা চাই তা ভুল করে চাই, যা পাই তা চাই না।