ফারহানা সুনীলের ফ্ল্যাটে উঠে গেছে। খবরটা আমাকে ফারহানাই জানিয়েছে। কথাটা বলার সময় ফারহানার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, আমার একবার মনে হয়েছিল, ও কাঁদছে। হয়তো ভুল ভেবেছি। প্রত্যাশাটা অমূলক ছিল, তবু মোবাইলে দুজনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরপরই আমি আশা করেছিলাম, এক সেকেন্ডের মধ্যে ফারহানার আরেকটা কল আসবে। ও বলবে, ‘আমি মজা করছিলাম দীপু।’ নাহ্ ফারহানার কাছ থেকে এমন কোনো কল আসেনি। আসার কথাও না, ফারহানা অনেক হিসাব-নিকাশ করেই নিশ্চয়ই আমাদের এগারো বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি টেনেছে।
এগারো বছর। কম সময় না। এগারো বছর একটা স্থির আর শক্তপোক্ত সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলাম আমি আর ফারহানা। তবু সেই সম্পর্ক ছিন্ন করে ফারহানা এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। ফারহানা চলে যাওয়ার পর কিছুদিন নিজেকে অক্ষম, রিক্ত মনে হতে হতে একটা সময় আমার মনে হয়েছে, আমি ভীষণভাবে প্রতারিত হয়েছি। আমার সংসারে আমার আলিঙ্গনে থেকেও দিনের পর দিন সুনীলের সঙ্গে মুহূর্তযাপন করেছে ফারহানা। আমি এসব দেখেও না দেখার ভান করেছি, উপেক্ষা করেছি ফারহানার আরক্ত মুখ, নিজেকে উদার প্রমাণ করার চেষ্টা করে গেছি। কিন্তু আমি উদার হতে পেরেছি কি? উদার হয়েই বা কী লাভ হয়েছে আমার? আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মুহুর্মুহু কানাঘুঁষা করেছে, ‘দীপু আর ফারহানার কোল শূন্য এখনও, কখন যে কী হয়ে যায়! দেখেছো তো আজকাল ফারহানা সুনীলের সঙ্গে কেমন বাড়াবাড়ি শুরু করেছে? অফিস কলিগ না ছাই! দুজনে চুটিয়ে মজা লুটছে দ্যাখো গিয়ে। গতকালও তো দুজনকে একটা রেস্তোরাঁতে একসঙ্গে খেতে দেখেছি। চুল কী আর এমনি এমনি পেকেছে। ওসব এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়। দীপুই শুধু কিছু দেখে না।’
ফারহানা চলে যাওয়ার দশম দিনের দিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নতুন এক দীপুকে দেখতে পাই। চড়চড়ে গাল, আধফাটা ঠোঁট, উসকো-খুসকো চুল, বেদনার্ত চোখের দীপু। ফারহানা চলে যাওয়ার দিন থেকেই সবসময়ের পরিপাটি আমি নিজেকে বদলে ফেলেছি। এই দশদিন অফিসে যাইনি, ঘরের বাইরে পর্যন্ত পা দিইনি, ঘরের ভেতরেও কাউকে ঢুকতে দিইনি। বসকে ফোন করে বলেছি, বছরের পাওনা ছুটিগুলো এখনই কাটিয়ে ফেলব, উইদআইট পে হলেও ছুটি চাই আমার। নাহ্ ফারহানার সঙ্গে বিচ্ছেদের কারণে এমন বিবাগী হয়েছি বিষয়টা ঠিক তা না। এই কদিন দিন-রাত শুধু ভেবেছি, কী করে মানুষের মুখোমুখি হবো? ভাবনার যন্ত্রণা আমাকে নিজের কাছেই বারবার অপদস্থ করেছে। আতঙ্কে থেকেছি, মরমে মরেছি। মুখোমুখি হলে যদি লোকে উপহাস করে! যদি বৃন্তচ্যুত ফুলের মতো মাটিতে পড়ে গিয়ে কারও পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে যাই! কী করে বাইরে বের হবো!
দিন যায়। আমি ক্রমশ ফারহানার অনুপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকি। আমার বিক্ষুব্ধ জীবন সহজ হয়ে আসে। মানুষের কৌতূহল, কটাক্ষ দুমড়ে-মুচড়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসতেও শিখে যাই। বিপত্তি বাধে শুধু একটা জায়গায়।
ফারহানা চলে যাওয়ার পর থেকে রোজ রাতে, এই মাঝরাত হবে, একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় আমার। আমি দেখি একটা ডানা কাটা পরি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এমন ডানাকাটা পরি স্বপ্ন ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। আমি দেখিওনি। এ কিন্তু ডানাকাটা রূপসী না, একেবারে পরি, যার ডানা দুটো পিঠের দিক থেকে কাটা। কাটা জায়গার রক্তাভাও চোখে পড়ে। পরিটা ফিনফিনে সাদা পর্দা জড়িয়ে আকাশি ঢেউয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি চোখ খুলতে না খুলতেই দেখি পরিটা নেই।
আজ রাতেও ডানা কাটা পরিটাকে দেখেছি। পরিটা কী করে উড়ে গেল, ভাবতে ভাবতে নাস্তার টেবিলে জিহ্বাতে কামড় লেগে অনেকটা রক্ত বেরিয়ে এসেছে। ফারহানা বলতো, জিহ্বা কাটলে মুখে চিনি দিতে হয়- রক্ত পড়া বন্ধ করার জাদু এটা। আমি মুখ ভর্তি করে চিনি নিয়ে জাদু দেখার অপেক্ষায় অনেকক্ষণ বসে থাকি। মিষ্টি লালায় মুখ ভর্তি হয়ে গেলে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে থু করতেই মুখ থেকে একগাদা রক্তাক্ত লালা বেরিয়ে আসে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিহ্বাটা একবার পরখ করে বাইরে বেরিয়ে পড়ি। বের হওয়ার আগে কুরুশকাঁটা জোড়া পকেটে ঢোকাতে ভুলি না।
ফারহানার সঙ্গে দেখা হবে আজ, ঠিক একবছর তেরো দিন পর। গত বছর পয়লা জানুয়ারি চলে গিয়েছিল ফারহানা, আজ জানুয়ারির তেরো তারিখ। একই শহরে থেকে আমরা দুজন অপরিচিতের মতোই ছিলাম এতদিন। আমি নিজে থেকে ওর কোনো খবর নেওয়ার চেষ্টা করিনি। আসলে খবর জানার রুচি হয়নি। ফেইসবুকে, মেসেঞ্জারে ফারহানাকে ব্লক করেছি অনেক আগেই। কেউ ইনিয়েবিনিয়ে কানের কাছে ফারহানার কথা বলতে গেলে এড়িয়ে গেছি। ও সচরাচর যে পথ দিয়ে অফিসে যায় সেই পথেও সচেতনভাবে পা রাখিনি। ফারহানা আর সুনীল কেমন আছে তা জানার কৌতূহল যে হয়নি সে কথা বলব না, নিজেকে শাসন করেছি, আদেখলাপনা দমন করেছি। আজ অবশ্য ফারহানাই উপযাজক হয়ে আমাকে ডেকেছে। গতকাল রাতে ফোন করেছিল ফারহানা। প্রায় মিনতি করে বলেছে, ‘দীপু আমি জানি তুমি আমাকে ক্ষমা করোনি। তবু একবার দেখা করো প্লিজ। জিনিসটা আমার খুব দরকার। এমন না যে আমি মার্কেটে গেলে অমন কুরুশকাঁটা জোড়া পাবো না। কিন্তু ওটা আমার মায়ের স্মৃতি, মায়ের কাছ থেকেই তো এই কাজ শিখেছি। মা মারা গেল ক’দিন আগে। ওই কাঁটা জোড়া এখন যদি পেতাম...’
ফোনের এপাশ থেকে ফারহানার ভেজা ভেজা কণ্ঠ শুনে ভেতরে ভেতরে একটা পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করছিলাম। নিশ্চয়ই ভালো নেই ফারহানা, থাকবে কী করে! নিঃশ্বাসের একটা শাপ আছে তো! ওর জন্য কম দীর্ঘশ্বাস পড়েছে আমার! পরক্ষণেই অবাক হয়েছি- শুধু এক জোড়া কুরুশকাঁটার জন্য এত দিন পর আমার খোঁজ করছে ফারহানা!
মনে পড়ে আমার, কাজের অবসরে বা ছুটির দিনে খাটের ওপরে ছোট ক্রিমরঙা বক্সটা নিয়ে বসতো ফারহানা। সুচারু হাতে তৈরি করতো ঘরের টুকিটাকি জিনিস- সেন্টার টেবিলের ম্যাট, কুশন কভার, ওভেনের কভার ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি আমার জন্য স্যান্ডো গেঞ্জি, টুপি আর একেবারে জিরো সাইজের মেয়ে বাচ্চার ফ্রক আর পা মোজাও বানিয়েছিল ফারহানা। ফারহানা চলে যাওয়ার পর ওসব ছুঁয়েও দেখিনি। ও চলে যাওয়ার পর তো আজই প্রথম ওর মিনি ওয়্যারড্রবে হাত দিলাম। তিন নম্বর ড্রয়ারের বামদিকের পেছনে একদম কোণায় ছিল বক্সটা। ফারহানাই ফোনে জায়গাটা চিনিয়েছে। সবই মুখস্থ আছে দেখি ফারহানার। এই লা ভিস্তা রেস্তোরাঁর কথাও, বিয়ের আগে আমরা তো এখানেই বসতাম। এলোমেলো সব কথোপকথনের ভিড়ে তখন দুজন দুজনের পছন্দের বিষয়ে আশ্চর্যরকম মিল খুঁজে পেতাম! প্রিয় রং, প্রিয় লেখক, প্রিয় গায়ক, প্রিয় মুহূর্ত এমনকি প্রিয় শখটা পর্যন্ত মিলে যেত আমাদের। মনে পড়ে বিয়ের আগে আমরা দুজন একই জিনিস ভালোবাসতাম, একই সঙ্গে ভালোবাসতাম। একেবারে সমুদ্র জলে মাখামাখি হয়ে থাকতাম দুজনে। আমার জানা মতে বিয়ের পরেও আমাদের পছন্দের বিষয়গুলোর মধ্যে তেমন কোনো ফারাক তৈরি হয়নি।
বিয়ের পর আমরা বেশ কয়েকবার সমুদ্র দেখতে গিয়েছি। আমাদের দুজনেরই সমুদ্র প্রিয়। আমরা ঠিক করেছিলাম, টাকাপয়সা গুছিয়ে নিয়ে সিডনির লা পেরুজের সুন্দরতম সমুদ্র সৈকত দেখতে যাব। সমুদ্রের কাছে গেলে ছেলেমানুষ হয়ে উঠতো ফারহানা। সমুদ্রতটে বালুর বিশাল বিশাল ঘর বানাতো, সেই ঘর ভেঙে গেলে ছলছল চোখে তাকাতো। ফারহানার ভেজা ভেজা মুখ দেখে আমি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতাম। হোটেলে ফিরে ওর অভিমানটুকু ভুলিয়ে দিতাম। সমুদ্রমন্থনে তৃপ্ত ফারহানা কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলতো, ‘জতেম, জতেম, জতেম।’
কে যেন আচমকা পুরো শরীরে নুন ছিটিয়ে দেয়। দগদগে ক্ষতে পড়া নুনের ছিটা আমাকে আপাদমস্তক জ্বালায়, পোড়ায়। এখন নিশ্চয়ই সুনীলের গলা জড়িয়ে ধরে আশ্লেষে ‘জতেম’ বলে ফারহানা। কিন্তু কেন আমাকে ছেড়ে সুনীলের কাছে ফারহানা? ফারহানার কি ক্লান্তি এসে গিয়েছিল? সম্পর্কের ডালে ডালে ছড়ানো সবুজ তুলতে তুলতে কি একঘেয়ে লাগছিল ওর? কেন আমার ঘর ভেঙেছে ফারহানা? আবার আজ ঠিক কী উদ্দেশ্য নিয়েই বা ফারহানা আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে? ও কি সুখে নেই? সুনীলের সঙ্গে কি ওর বনিবনা হচ্ছে না? ফারহানা কি আমার কাছে ফিরে আসতে চাইবে?
প্রশ্নগুলো বুকের ভেতরে তোলপাড় তুলে আমাকে উত্তাল এক সমুদ্রের মাঝে আছড়ে ফেলে। সম্বিত ফিরলে বুঝি এসব নির্লজ্জ ভাবনা দূরে রাখতে পারি না বলেই আজ আমার এই দুর্দশা। কিন্তু ফারহানাও কি দুর্দশার মধ্যে পড়েছে?
কথা ছিল, দুজনের প্রিয় বিষয়গুলো পাল্টে গেলেও, দুজনের মনে অমিল হলেও, দুজন দুজনকে কোনোদিনও ছেড়ে যাব না। কিন্তু আমি না ছাড়লেও ফারহানা আমাকে ছেড়েছে। আমার এগারোশ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট ছেড়ে সুনীলের আঠারোশ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছে। আমার ভাবতে ভালো লাগছে, আজ ফারহানাকে একেবারে নতজানু অবস্থায় দেখব। আমার মুখোমুখি হয়ে চোখের নিচের কালো দাগ, গালে-চিবুকে ফুটে ওঠা নির্ঘুম রাতের চিহ্ন লুকাতে লুকাতে ও অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলবে, ‘আমি ভালো নেই দীপু, একদম ভালো নেই। সুনীল তোমার মতো নয় দীপু। ও প্রতারক, লম্পট। ও আমাকে ঠকিয়েছে। আমি ভুল করেছি, অনেক বড় ভুল করেছি। তারই প্রায়শ্চিত করতে চাই আজ।’
না, ফারহানাকে ক্ষমা করব না আমি, ওর মতো মেয়েকে ক্ষমা করা যায় না। ওর প্রতি কথার বিপরীতে আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসব। তারপর নাটকীয় ভঙিতে বলব, ‘এখন তার আর কোনো সুযোগ নেই।’ হ্যাঁ, শোধ নেওয়ার মোক্ষম সময় এসেছে আজ।
গোপন আনন্দে আমার ভেতরটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। হঠাৎ কী জানি কী হয়, জিহ্বার কামড় লাগা জায়গায় ফের কামড় লাগে। সহ্যাতীত যন্ত্রণায় কুঁকিয়ে উঠি। এখন চিনি কোথায় পাই! উফ, চলে গিয়েও কেন ফারহানা মাথা থেকে বের হচ্ছে না! সারাক্ষণ করোটির ভেতরে ওর নামটা কেনই বা ঘুণপোকার মতো কাটছে। আমাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল ফারহানা, তবু আমি কেন ওর কথাই ভাবছি! ফারহানা কাতর কণ্ঠে একবার ডাকতেই কেন হাভাতে কুকুরের মতো এমন ল্যা ল্যা করে ছুটছি!
আমাকে দেখে যদি কটাক্ষ করে ফারহানা, ঠোঁট বাঁকা করে বিদ্রূপের হাসি হাসে? নাহ্ ওর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভুল হয়েছে আমার। এখনও তো সময় আছে, চাইলেই তো আমি ফিরে যেতে পারি। ফারহানাকে ঘণ্টা দুই অপেক্ষায় রেখে ফোন করে জানিয়ে দিতে পারি, ‘হঠাৎ কাজ পড়ে গেল, আসতে পারলাম না। সরি। তুমি বরং ঠিকানা দাও, তোমার শখের কুরুশকাঁটা কুরিয়ার করে দিই।’
মামুলি সব ভাবনায় ডুবে যেতে যেতে কখন যে লা ভিস্তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, টেরও পাইনি। এখন ফিরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? রোদে চোখ আটকে যায়। দুদিনের বৃষ্টির পর রোদ উঠেছে। উজ্জ্বল আলোতে আমার অনুজ্জ্বল মুখের দিকে নিশ্চয়ই সরাসরি তাকাতে পারবে না ফারহানা। চোখে চোখ রেখে কথা বলার সক্ষমতা ও তো কবেই হারিয়েছে। আচ্ছা ফারহানা যদি সুনীলকে সঙ্গে নিয়ে আসে! এবার যথাযথই পা লেগে আসতে চায়। নাহ্, ফারহানার ডাকে চলে আসা উচিত হয়নি আমার। সিঁড়ির ধাপ বেয়ে লিফটের সামনে আসতে আসতে টের পাই ঘৃণার স্রোত আমার কণ্ঠনালী, জিহ্বা, ঠোঁট পর্যন্ত তিতা করে দিয়েছে। একবার লিফট ছেড়ে দিই। লিফটের সামনে অপেক্ষমাণ লোকজন হুড়মুড় করে ভেতরে ঢোকে। আমি সরে দাঁড়াই। একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিজেকে ধাতস্থ করি। ভেতরের এত উত্থান-পতনের পরেও কেন যেন মনে হচ্ছে, আজ আমি ভেঙে পড়া ফারহানাকেই দেখতে পাব। ভালো লাগার বুদবুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি ওপরে উঠতে থাকি।
লা ভিস্তার রুফ টপের দক্ষিণ দিকের একদম কোণার টেবিলের কাছে গিয়ে দেখি ফারহানা বসে আছে। যেই নিভু নিভু প্রত্যাশা নিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়েছি তা যেন হাওয়ার ঝটকায় মুহূর্তের মধ্যে নিভে যায়। প্রচ- অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখি, শ্যামলা বরণ, ভারি দেহের অধিকারিণী ফারহানাকে অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে। পালক নরম ত্বক, ভরাট গাল, উজ্জ্বল চোখ- সব মিলিয়ে পল্লবিত কিশলয় যেন! আমি এক পলক দেখেই বুঝে যাই, ফারহানাই স্বপ্নে দেখা সেই পরিটা, শুধু ওর ডানা জোড়া কাটার কোনো দাগ নেই।
ফারহানা লঘু হাসিতে আমাকে অভ্যর্থনা জানায়। আমি চেয়ারে বসতে না বসতেই ও অসংকোচ দৃষ্টি মেলে জানতে চায়, ‘কুরুশকাঁটা জোড়া এনেছো?’ আমি হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে নির্লজ্জের মতো ওকে দেখতে থাকি। ফারহানাও কি আমাকে দেখছে? আমি ওর স্পৃহাহীন চোখে আগ্রহের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাই না। একবার নড়েচড়ে ফের স্থির হয়ে বসে ও। আমিও স্থির হই। অচঞ্চল চোখে আমার প্রাক্তনকে দেখতে থাকি।
ফারহানা সাদা শাড়ির আঁচল পিঠ ঘুরিয়ে পেটের সামনে রাখলেও ওর শরীরের স্ফীতি জানান দিচ্ছে, বড় সুসময় পার করছে ফারহানা। অচিরেই ও কোনো পরির দেখাও পাবে। ওই পরির ফ্রক, জামা, মোজা বোনার জন্যই কি ওর কুরুশকাঁটা জোড়া দরকার? আমি প্রশ্ন করি না। শুধু প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ফারহানার সুখসর্বস্ব মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।