বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় সমর সেনের কবিতা প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে বুদ্ধদেবকে একটি চিঠিতে জানান, তাঁর (সমর সেনের) কবিতা ‘ট্যাঁকসই’ হবে বলে মনে হয়। সমর সেনের ভাগ্যে এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য বলেই প্রতীয়মান ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। জন্মশতবর্ষ পেরিয়েও তাঁর কবিতার পাঠকপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বেড়েছে বৈ কমেনি। কবি সমর সেনকে নিয়ে লেখালেখি, মূল্যায়ন, প্রতিতুলনা এখনও চলমান। যার মধ্যে দিয়ে তাঁকে পাঠ ও চর্চার একটা ধারাবাহিকতা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি একাডেমিক, নন-একাডেমিক দ্বিবিধা স্তরে অধ্যায়ন, আলোচনার একটা শক্তিশালী ভরকেন্দ্র সক্রিয় রয়েছে। আবু হেনা মোস্তফা কামালের মৃত্যুর পর (২৩ সেপ্টম্বর ১৯৮৯) বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর সাহিত্য সংকলন।
আনিসুজ্জামান ও বিশ্বজিৎ ঘোষ সম্পাদিত ‘আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী’র (প্রথম খণ্ড) ভূমিকা লিখেছেন আনিসুজ্জামান। তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন, আবু হেনা মোস্তফা কামাল বাংলা কবিতায় স্থায়ী আসন পাবেন। বেশ কিছু কবিতাকে তিনি কালোত্তীর্ণের তালিকায় রেখেছেন। এই পরিসরে আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করতে পারি, ‘ছবি’ শীর্ষক কবিতার কথা। কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি এরকম: ‘খাঁটি আর্যবংশসম্ভূত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর দীর্ঘ ন’টি মাস দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই ছবি। এখনো অনেক জায়গায় রং কাঁচা-কিন্তু কী আশ্চর্য গাঢ় দেখেছেন? ভ্যান গগ্- যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে সোনালি তুলে এনে ব্যবহার করতেন-কখনো, শপথ করে বলতে পারি, এমন গাঢ়তা দ্যাখেননি! আর দেখুন, এই যে নরমুণ্ডের ক্রমাগত ব্যবহার-ওর ভেতরেও একটা গভীর সাজেশন আছে- আসলে ওটাই এই ছবির- অর্থাৎ এই ছবির মতো দেশের থিম!’
এরকম কালজয়ী কবিতার স্রষ্টা হয়েও আবু হেনা মোস্তফা কামাল বাংলা সাহিত্যে যেভাবে স্মরিত হওয়ার কথা ,অজ্ঞাত কারণে সেভাবে স্মরিত হননি। অথচ আনিসুজ্জামানের মতো ধীমান মনীষাসহ অনেকেই তাঁর কবিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। আমাদের এই কূপমণ্ডুকতায়, কপটতায়, কৃপণতায় বাংলা সাহিত্য বঞ্চিত হচ্ছে আবু হেনার মতো সাহসী-প্রজ্ঞাসম্পন্ন কবির কাব্যপ্রতিভা থেকে। সমর সেনের মতো ভিন্নমাত্রিক কবি প্রতিভাকে সাহিত্যসেবীরা যে পাঠচর্চায়, শ্রদ্ধা ও প্রীতিতে মনে রেখেছে, আবু হেনাকেও সেভাবে মনে রাখা যুক্তিযুক্ত ছিল। এই লেখায় আমরা সেই যুক্তিকে হাজির করার চেষ্টা করব আবু হেনা মোস্তফা কামালের সাধনা অন্বেষণের মধ্যে দিয়ে। আবু হেনা ছিলেন আপাদমস্তক কবি। বিবিধ পরিচয় ও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী হয়েও প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত উচ্চকিত ছিল তাঁর কবি প্রতিভা। কোনোভাবেই তিনি কবিতার সঙ্গে আপস করেননি। যদিও তাঁর কবিতার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে স্বল্প, তিনি কবিতায় অতিপ্রজ হওয়ায় বিশ্বাসীও ছিলেন না। ১৯৫২ সালে তাঁর কবিতাচর্চা শুরু এবং জারি থাকে মৃত্যুর পূর্ব পযন্ত। এই সময় কবিতার বই করেছেন মাত্র তিনটি। এক. আপন যৌবন বৈরী, দুই. যেহেতু জন্মান্ধ, তিন. আক্রান্ত গজল।
তিনি মূলত পঞ্চাশের দশকের কবি, যদিও প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে, সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে। এই তিনটি বইয়ের বাইরে তাঁর কিছুসংখ্যক অপ্রকাশিত কবিতা রয়েছে। যা মৃত্যুর পর আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত আবু হেনা মোস্তফা কামাল কাব্যসমগ্রতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত-অপ্রকাশিত মিলিয়ে তাঁর কবিতা বেশি না হলেও, কবি প্রতিভার যে বিচ্ছুরণ মঞ্জুরিত হয়েছে তা শুধু ঈর্ষণীয় নয়, স্মরণীয়-বরণীয়ও।
আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি সবার মাঝে থেকেও স্বতন্ত্র এক অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর সময় থেকে তিনি ভিন্নতা নির্মাণ করেছেন। ভাষাভঙ্গি, শব্দচয়ন, উপমা, উৎপ্রেক্ষায় তিনি শুধু ব্যতিক্রম নন, সৃজনমুখরও। বলা হয়, ভালো কবিতা, মন্দ কবিতা বলে কিছু নেই, কবিতা পাঠকের কাছে ধরা দেয়ার মধ্য দিয়েই তার তকমা নিশ্চিত হয়ে যায়। পাঠকের মেজাজ-রুচি-অভিজ্ঞান-অভিজ্ঞতার আলোকে কবিতার ভাগ্য নির্ধারিত হয়।
কবিতার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সময় কখনো কখনো বড় বিচারকের ভূমিকায়ও হাজির হয়। কবিতার ভালো-মন্দের বিচার এ কারণে আপেক্ষিক ও যুক্তিসাপেক্ষ। আবু হেনার কবিতার ক্ষেত্রেও এসব আলোচনা প্রাসঙ্গিক। কিন্তু তার যে বিশিষ্টতা ও বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে, তিনি কবিতা নির্মাণে, শব্দশাসনে বিশেষ পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন, স্বকীয়পন্থা জারি রেখে। যেমন– ‘ঈশ্বর আপনিও কবি, কবিদের অনেকেই এরকম বলে। কেননা আপনার হাত পাহাড়ে সূযাস্ত আঁকে আকাশের বিস্তৃত পাতায় পাখিদের চোখের পাতায় নক্ষত্রেরা স্বপ্ন লিখে রাখে এবং আপনার স্বরলিপি মেঘের অর্গানে বাজে প্রথম বাদলে’ [কবি]
অন্যত্র তিনি লিখেছেন: ‘আমি কী কী হতে চাই না, এমনকি স্বপ্নেও, তার সহজ তালিকা লিখে রাখি, হতে চাই না এসবের কিছুই ঈশ্বর- অন্তত অন্তিম শ্লোকে হতে পারি যদি অস্থির কবির কণ্ঠস্বর! [বিকল্প]
আবু হেনার সাধনায় কোনো গুপ্তরহস্য ছিল না। তিনি সরাসরি বক্তব্য তুলে ধরতেন। কিন্তু তাঁর কবিতা বক্তব্যধর্মী ছিল না। তিনি শিল্পীত ভঙ্গিতে বক্তব্য তুলে ধরতেন এবং বক্তব্যে গল্পের মিশেল থাকার গৎবাঁধা ও প্রচলিত যে রেওয়াজ বহমান ছিল সেখানেও তিনি ছিলেন ভিন্ন এক সত্তা, যা একান্তই আবু হেনা মোস্তফা কামালের। যেমন ‘আমি নির্বিরোধ দিন চাই নিঃশঙ্ক নারীকে চাই, রাত্রি চাই দুঃস্বপ্নবিহীন আর প্রতিদিন চিরদিন সূর্যের মোড়কে চাই একটি দীপ্ত নতুন কবিতা [স্বপ্নের জলসায় একদিন]
নির্মেদ শব্দ ব্যবহারেই শুধু নন, তিনি কবিতা সৃজনে সার্জিক্যাল পোয়েটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সার্জারি করার ক্ষেত্রে একজন ডাক্তার যেমন অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে কোনোরকম বিরক্ত ছাড়াই প্রয়োজনীয় চিকিৎসাকর্ম সম্পাদন করেন, আবু হেনাও কবিতা নির্মাণে সেই কাজটিই সম্পাদন করেছেন।
বাংলা কবিতায় এরকম শব্দ শাসন, শব্দ ব্যবহার, শব্দ নির্মাণের উদাহরণ সমর সেন ছাড়া দ্বিতীয় কেউ তুলনারহিত। সমর সেন লিখেছেন : এক: ‘যৌবনের প্রেম শেষ প্রবীণের কামে। বছর দশেক পরে যাব কাশীধামে।’ [জন্মদিন]
দুই: ‘কেতকীর গন্ধে দুরন্ত, এই অন্ধকার আমাকে কী করে ছোঁবে? পাহাড়ের স্তব্ধতায় শান্ত আমি আমার অন্ধকারে আমি নির্জন দ্বীপের মতো সুদূর, নিঃসঙ্গ।’ [মুক্তি]
তিন. ‘আর শহরের রাস্তায় কখনো প্রাণপণে দেখি ফিরিঙ্গি মেয়ের উদ্ধত নরম বুক। আর মদির মধ্য রাত্রে মাঝে মাঝে বলি মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও, পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনো হানো ইস্পাতের মতো উদ্যত দিন। কলতলায় ক্লান্ত কোলাহলে সকালে ঘুম ভাঙে আর সমস্তক্ষণ রক্ত জ্বলে বণিক সভ্যতার শূন্য মরুভূমি। [একটি বেকার প্রেমিক]
আবু হেনার কবিতা শুধু সার্জিক্যাল গুণাবলীর কারণেই বিশেষ মনোযোগ ও স্মরণীয় হওয়ার দাবি যেমন জারি রাখে, তেমনি তাঁর কবি হওয়ার যে সাধনা, কবিতা নির্মাণের মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে তাও বিশেষ মূল্যায়নের দাবি রাখে। একজন প্রকৃত কবিই কেবল কবিতার জন্য এমন সাধনা করতে পারে। শব্দের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে কবিতার মোড়কে দিগন্তবিস্তারী করে তুলতে পারে। আবু হেনা লিখেছেন: ‘বাঘ মানেই অরণ্যের অজেয় অধিকার তাজা, টাটকা ডোরা, সমস্ত শরীরে উচ্চারিত শক্তি সাহস সৌন্দর্য হয় বাঘ কিংবা বাঘ নয় শৌখিন বাঘ বলে কিছু নেই কখনো থাকে না তেমনি কবি‘ [কবি]
কবিতা লেখায় তাঁর সাধনা কতটা প্রবল ও প্রতিকূলপ্লাবিত তার উদাহরণ মেলে নিম্নোক্ত তিনটি কবিতার অংশবিশেষে- এক: ‘একটি কবিতা লিখতে না পারার অসহায়তা এই মুহূর্তে আমার সকল গন্তব্যের একমাত্র অন্তরায়; কিন্তু অনেকদিন ধরে সেই প্রার্থিত পঙ্ক্তির অন্য ধরনের ভালোবাসায় আর অহঙ্কারে আমি কি তবে অশুদ্ধ হয়ে গেছি? হারিয়ে ফেলেছি সেই মোহন মদির চাবি যার স্পর্শে খুলে যায় মৌন গম্ভীর সিংহ দরজা? গণিকা হয়ে ওঠে দেবী এবং’ [ঐকতানের অপেক্ষায়]
দুই: ‘তৃতীয় বিশ্বে কবির ফলন এমনিতেই অঢেল, প্রায় রপ্তানিযোগ্য পণ্য বটে এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভেবে দেখতে পারে।… আমার তৃতীয় বিশ্বে আপনার যাবতীয় সাধনা পণ্ডশ্রম বলেই মনে করি, রাসেল সুখ কোনো দার্শনিক ব্যাপার নয়, শুধু চাই নির্ভরযোগ্য নিরোধ এবং সুযোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ।’ [সুখ সম্পর্কিত সমাচার]
তিন: ‘অথচ, খোদর কসম, শব্দের সঙ্গ অনেক যুবতী নারীর চেয়েও বেশি কাঙ্ক্ষিত আমার। … বিমূঢ় বৈয়াকরণ নয় একজন কবিকে, একজন সুন্দরের স্থপতিকে খুঁজি প্রাণপণ’ [সুন্দরের স্থপতিকে চাই]
আবু হেনার কবি হয়ে ওঠার সাধনা তাঁকে ব্যতিক্রমিতা যেমন দিয়েছে, তেমনি তাঁর কাব্য সৃজন করেছে চিরস্মরণীয়। আবু হেনার কবি সত্তার স্বার্থকতা এবং বৈয়াকরণ অন্বেষিত হলে বাংলা কবিতায় অমেয় সুধা মিলবে।