শিল্প ও সাহিত্য

অন্তিম সেবা 

ভুলে যাচ্ছি বিগত সময়। কিছুতেই মনে করতে পারি না কৃত কার্যক্রম ও দৃশ্যাবলী। লোকে বলে, লিখে রাখ। লিখে রাখি কাগজে বা মোবাইলের নোটবুকে। পরে ভুলে যাই, কোথায় লিখে রেখেছি! তবু লিখে রাখার জন্য ছোট ছোট স্টিকার পেপার আর মোবাইল নোটবুক হাতে রাখি। মনে না থাকলেও আপনা আপনি চোখে পড়ে এসব বস্তু, এবং চোখের আড়ালে যাতে না যায় সেজন্য হাতেই রাখি জিনিসগুলো। প্রতি মুহূর্তে চিরকুট আর মোবাইল নোটবুক দেখার অদৃশ্য বাধ্যতা আমাকে রুদ্ধ করে রেখেছে। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। ডাক্তারের কাছে যাবার সাধ্য নাই আমার। এসব বিষয়ে ডাক্তারি সেবা নিতে গেলে মোটা টাকা খরচ হয়। আমি বরং নিজের ভবিষ্যৎ বদলে দেওয়ার প্রতি মনোযোগী হই। আমি জানি যে শেষ একাডেমিক পরীক্ষার পর আমি আমার মুক্তি নিশ্চিত করব। জোর দিয়েই কথাটা বলছি; কারণ, বিগত সময় ভুলে গেলেও আসন্ন সময়ের ছবি আমি দেখতে পাই। যদিও লোকে এ কথা বিশ্বাস করে না। বিস্মরণে আক্রান্ত আমি যে ভবিষ্যতের ছবি দেখতে পাই তা নিয়ে পরিচিতরা আমাকে ঠাট্টা করে। ওরা বলে, ‘বুদ্ধের চায়া বড় অবতার হইছস নাকি?’ তারা আমাকে বুদ্ধের বাণী শোনায়। বারবার শোনায়। শুনতে শুনতে একটা দুইটা কথার অংশবিশেষ মনে করতে পারি। তারা সম্ভবত বোঝাতে চায় যে, ভবিষ্যৎ বলে কিছু নাই, বর্তমানই সব। কিন্তু আমি সত্যিই আমার ভয়াবহ ভবিষ্যতের ডিটেইল জানি। আমার এই ক্ষমতা কারো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল নয়। ভবিষ্যৎ আমি দেখতে পাই; দেখাই বিশ্বাস। 

কেমন আমার ভবিষ্যৎ? অন্ধকার আচ্ছন্ন। অপমানে ভরা। অন্ধকার ও অপমান এই দুইয়ের ছুরি-চাকু-বিষ-বিপর্যয় আমাকে আমৃত্যু শাসন করার জন্য শাণিত হয়ে আছে। আমি তা হতে দেব না। ভবিষ্যৎ সামনে উপস্থিত হবার আগেই আমার মৃত্যু নিশ্চিত করব। যতই লোকে বলুক যে, জন্ম-মৃত্যু আল্লার হাতে। বাস্তবে চাইলেই অসংখ্য মৃত্যু নিশ্চিত করা সম্ভব। সবচেয়ে সহজ নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করা। এমন অসংখ্য প্রমাণপত্র আমি ডিজিটাল ফাইল করে রেখেছি যাতে ভুলে গেলে দেখে নিতে পারি। আমি নিশ্চিত জানি যে, ভবিষ্যৎ মানে কয়েকজন অপরিচিত মানুষ আমার মৃতদেহ আবিষ্কার করে বিরক্ত হচ্ছে। প্রতিদিন তারা এ ধরনের মৃত্যু দেখতে দেখতে এমনিতেই বিরক্ত। তাদের দাবির আলোকে সরকার ইতোমধ্যে মৃত্যু ব্যবস্থাপনা বিভাগ চালু করেছে। আমি যখন স্পষ্ট দেখি যে, মানুষ ও সমাজ থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়ে অবদমনের ভেতরে লুকানো এক বিপন্ন তরুণীর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আমার ভবিষ্যৎ কেলিয়ে হাসছে, তখন ঘুমাতে পারছি না; জেগে থাকতেও না। অতএব চোখ বন্ধ করে থাকি। ভাবি, কীভাবে বিভৎস ভবিষ্যৎ ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু বিভৎসতার বাইরে আর কোনো দৃশ্য ধরা দেয় না। 

আমার সাম্প্রতিক অতীত সম্পর্কে বিস্মরণ সত্তেও বলতেই পারি যে, নিশ্চয়ই আমি আগের সবগুলো সেমিস্টার শেষ করেছি সাফল্যের সাথে। মা বলে যে, মানুষ কেবল সফলই হবে, ব্যর্থদের জন্য কোথাও কিছু থাকে না। আমি সারাদিন সারারাত জেগে মেহেনত করেছি বলেই নাকি আমি ডিপার্টমেন্টের টপার। আমার টপার পজিশন কেউ অতিক্রম করতে পারেনি।  ‘তাই করি নাকি?’ আমি মাকে বলি, ‘তাই করেছি আমি?’  মা বলে যে, ‘এখনও তাই করতেছিস। না ঘুমায়া তুই স্টিকি পেপারে নোট লিখতেছিস, বইপত্র আউলায়া বসে থাকতেছিস, মোবাইল নোটবুকে একটার পর একটা টার্মিনলজি টুকে যাইতেছিস…।’  মা কথা বলে যায়। আমার কানে পরের কথাগুলো আসে না। উফ! জীবন আমাকে আসমান-অসীম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেÑ আমাকে শেষ সেমিস্টার অতিক্রম করতে দেবে না আমার অধ্যাপক এবং সতীর্থরা। তারা এমন সব টার্মিনলজি ব্যবহার করে যে, আমি মনে রাখতে পারি না। অথচ টার্মিনলজি মনে রাখতেই হবে। বাদবাকি যা হয় একটা কিছু ব্যাখ্যা করে যাওয়া যায় পরীক্ষার খাতায় পাতার পর পাতা ভরানোর জন্য। সতীর্থদের কথাবার্তায় বুঝতে পারি, অধ্যাপকরা কি-ওয়ার্ড পড়ে এবং কয় পৃষ্ঠা লিখতে পারলাম সেটা মাপে। তারপর নম্বর দেয় মুখ চিনে চিনে। কাকে নম্বর বাড়িয়ে দিতে হবে, কাকে কম তা ঠিক করার পদ্ধতি কনফিডেনশিয়াল। ক্যাম্পাসে থাকতে হলে কনিফিডেনশিয়ালিটি রুল ব্রেক করার চিন্তাও করা যাবে না। সেদিক থেকে আমাকে স্যার-ম্যামরা ভালোই বাসে। নিশ্চয়ই ভালোবাসে। তা না হলে শেষ সেমিস্টার পর্যন্ত এলাম কি করে, তাও আবার টপার হয়ে!

‘স্যার-ম্যামদের আনুকূল্য ছাড়া টপার হওয়া সম্ভব না।’ সেমিনার লাইব্রেরিতে ঢোকার মুখে এই কথা বলে আমার কানের কাছ দিয়ে সিড়ি বেয়ে ঘোড়ার মতো লাফাতে লাফাতে নিচে নেমে গেল একজন ব্যাচমেট। আমি তার মুখ দেখতে পেলাম না। মাথা টলে উঠলো। উন্মাদের মতো সেমিনার লাইব্রেরিতে ঢুকলাম। একসঙ্গে চারটা বই নামালাম। ব্যাগের ভেতর থেকে হলুদ স্টিকি পেপারের প্যাড বের করে গোটাচারেক শব্দ টুকে নিলাম। প্যাড থেকে চারটি শব্দ লেখা উপরের স্টিকি পেপারের টুকরো খুলে ক্যালকুলেটরের উপরে লাগিয়ে রাখলাম। হাতের তালুতে ক্যালকুলেটর নিয়ে শব্দ চারটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পরীক্ষার হলের দিকে পা বাড়ালাম। হাঁটতে হাঁটতে আচমকাই আমার চোখ ক্যালকুলেটর থেকে লাফিয়ে পড়ল কংক্রিটের রাস্তার উপর। ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়ার লালগালিচা যেন বৃত্তাকারে বিছান পথের উপর। পথের ধারে বিস্তীর্ণ ঘাসের আবরণের উপর ঝরাফুলের অর্ধবৃত্ত গাঢ় লাল, পুরু ও যুথবদ্ধ; এবং বাকি অর্ধবৃত্ত কংক্রিটের প্রশস্ত হাঁটাপথের উপর এলোমেলো, জায়গায় জাগায় থেতলানো। আমি থেমে যাই। আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে পথে পড়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার কোমল দল থেতলে চৈত্র সংক্রান্তীর শোভাযাত্রা চলেছে নাচতে নাচতে বাজাতে বাজাতে গাইতে গাইতে। 

আমি রাস্তা থেকে সরে একপাশে আসতে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম। টাল সামলাতে সামলাতে পথের উপরে ছড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া দলের থেতলে লেপটে যাওয়া দেখলাম। আচমকা কোথা থেকে ব্যাচমেট শোভা এসে আমার হাত ধরে টেনে সেখান থেকে সোজা পরীক্ষার হলে নিয়ে থামালো। ঘাড়ের ব্যাগ শেলফে জমা রেখে ক্যালকুলেটর হাতে নিয়ে ডেস্কে বসি। ইনভিজিলেটর স্যার খাতা দিতে আমার তালুর উপর থেকে ক্যালকুলেটর তুলে চোখের কাছে নিয়ে দেখেন। ‘হাঁ! এই তাহলে তোমার টপার হবার সিক্রেট! তোমার মতো মেয়ে নকলের উপাদান প্রকাশ্যে প্রদর্শন করে বেড়াচ্ছ!’  আমি বললাম, ‘স্যার, নকলের উপাদান! না না। কেন বলছেন এভাবে! এটা আমিই রেখেছি বারবার দেখার জন্য। পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে ফেলে দেওয়ার কথা নিশ্চয়ই ছিল। আসলে, স্যার, আমার মনে পড়েনি ওটা ফেলে দেওয়ার কথা।’

উনি আমার দিকে একটা বাঁকা হাসি ছুড়ে দিলেন। আমার চোখ খচখচ করে উঠল। আমার ক্যালকুলেটর নিয়ে ইনভিজিলেটর স্যার একটা হলুদ খামে ঢুকিয়ে ফেললেন। আমাকে সদ্য সরবরাহ করা খাতার প্রথম পাতায় একটা লম্বা টান দিলেন লালকালি দিয়ে। তারপর বাঁকা অক্ষরে লিখলেন, ‘রিপোর্টেড।’ এক্সটারনাল স্যার কাছে এলেন, বললেন, ‘মিস্টার প্রফেসর, ইউ সি, শি ইজ লেট অ্যান্ড শি ইভেন ডিড নট স্টার্ট, ইউ শুড নট রিপোর্ট।’  ইনভিজিলেটর দাঁতে জিব কাটলেন, বললেন, ‘ডিউটি, স্যার, ডিউটি। আমার চোখে পড়ে গেল যে, এড়াই কি করে। আমি কঠোর ডিসিপ্লিন মানি, স্যার। রিপোর্ট তো করে ফেলেছি ইনস্ট্যান্ট। এখন আমি কি করতে পারি, স্যার?’ 

এক্সটারনাল স্যার মুখ কালো করে পেছনের চেয়ারে বসলেন। আমি দাঁড়ালাম। জানতে চাইলাম, ‘এর মানে কি স্যার?’ ইনভিজিলেটর আমাকে ‘রিপোর্টেড’ খাতাটা দিয়ে বললেন, ‘তুমি লেখ। বাকিটা এক্সাম কন্ট্রলার বুঝবে। আমি জাস্ট তোমার টপারগিরির রহস্যটা আবিষ্কার করলাম। এছাড়া আর কোনো মানে নাই।’  হলশুদ্ধ ব্যাচমেটরা শব্দ করে হেসে উঠলো। করিডোর দিয়ে যাবার সময় চেয়ারম্যান ম্যাম পরীক্ষার হলে গর্জে ওঠা হাসি শুনে ভেতরে এলেন। ইনভিজিলেটর উত্তেজিত মুখে চেয়ারম্যান ম্যামের সাথে কথা বললেন হাত নেড়ে নেড়ে, হেসে হেসে। যেন অনেক খুশির খবর দিচ্ছেন তিনি চেয়ারম্যানকে। চেয়ারম্যান ম্যাম চোখমুখ সরু করে ছুটে এসে আমার খাতাটা নিয়ে ‘রিপোর্টেড’র পাশে সই করলেন। আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে হাসলেন, বললেন, ‘ফ্যাকাল্টি হইতে চাইছিলা না তুমি? বাইর করতেছি!’ তারপর আমার মুখের উপর খাতাটা ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘লেখ, মনের মাধুরি মিশায়ে, হুহ, ক্যারেকটারলেস কোথাকার!’ 

আবার হলভর্তি হাসি গর্জে উঠল। চেয়ারম্যান ম্যাম চিৎকার করলেন, ‘স্টপ!’ শান্ত হলো পরিবেশ। চেয়ারম্যান ম্যামের গা থেকে ঘামের গন্ধ এসে আমার নাকে বারি দিলো। আমি নাকে হাত দিতেই চেয়ারম্যান ম্যাম সরে গেলেন। হাই হিলে খটখট শব্দ তুলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন হল থেকে। আমি লেখা শুরু করলাম। খাতা ভরে লিখলাম। সবগুলো টার্মিনলজি আমার মনে পড়ল, আশ্চর্য! ভুলেই গেলাম যে আই অ্যাম ‘রিপোর্টেড’। 

শেষ মিনিট পেরিয়ে যেতে না যেতেই ইনভিজিলেটর আমারই খাতাটা প্রথমে কেড়ে নিলেন। তার চোখ থেকে আগুন বের হচ্ছে। সতীর্থরা কলকল করে বেরিয়ে যাবার সময় কেউ আমার সঙ্গে কথা বলল না। শোভাও তাকালো না আমার দিকে। না তাকিয়েই জোরে জোরে বলল শোভা, ‘দুই বছর ডিটেনশন দিবে তোমারে। তলে তলে তুমি আসলে এই। এক কাজ কর, এই মুখ ক্যামনে দেখাবা? অন্তিম সেবায় বুকিং দাও, শান্তিতে মর!’  

হাতের তালুতে ‘অন্তিম সেবা’ লিখে রাখলাম গাঢ় করে। কিছু একটা মারাত্মক ঘটেছে। কিন্তু কি ঘটেছে সেটা কিছুতেই স্পষ্ট নয়। তাতে আমার আসে যায় না। আমি জানি কি ঘটতে যাচ্ছে এরপর। আমি আর থাকছি না এদের মধ্যে। বিভৎস ভবিষ্যতের দৃশ্য আর আমি দেখতে চাই না। ভবিষ্যতের দাসত্ব থেকে আমার মুক্তি আমি নিজেই রচনা করতে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে দেরি করার সুযোগ আমার নাই আসলে। এক্ষেত্রে অন্তিম সেবার সার্ভিস নেওয়াই উত্তম হবে। শোভার মাথায় দারুণ একটা আইডিয়া খেলা করেছে। অন্তিম সেবার সেবা গ্রহণ করার মাধ্যমে শোভার ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টে কিছুটা ভূমিকা রাখতেও পারব। এটাই হবে ওর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। আমার নিশ্চিত মৃত্যু নিজের সাফল্য হিসেবে ক্যাপিটাল করে অন্তিম সেবার মার্কেটিং বিভাগে অনায়াসে কাজ করার সুযোগ পাবে শোভা। আজকাল কাজ করে রোজগার করার সুযোগ পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। তার উপর অন্তিম সেবার মতো ফার্স্ট গ্রোয়িং কর্মক্ষেত্রে ঢুকতে পারলে ভবিষ্যৎ মোকাবেলা করা নিয়ে চিন্তা থাকবে না। ঢাকা শহর যে এগিয়ে গেছে অন্তিম সেবাই তার প্রমাণ। শহরের বুদ্ধিমান যুবকেরা মৃত্যু দেখতে দেখতে বিরক্ত। হত্যা, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা, বায়ুদূষণ, ক্ষুধা, অপুষ্টি ইত্যাদি হাজার প্রকার মৃত্যুর যুগে আমরা প্রবেশ করেছি। আমার ভবিষ্যৎ-দর্শন অনুসারে মৃত্যুহার তীব্রতরই হবে ক্রমে। আমি চাই না আমার মৃত্যু নিয়ে কেউ বিপাকে পড়ুক। বরং অন্তিম সেবায় গিয়ে আমার মৃত্যু নিশ্চিত করাটাই সুবিবেচকের কাজ হবে। কারো দায় থাকবে না- না দুর্ঘটনার, না দূষণের। আমার হাতে যথেষ্ট টাকা আছে। টাকাগুলো সম্ভবত টিউশনি করে উপার্জন করেছিলাম। অন্তিম সেবার সেবামূল্য অত্যন্ত চড়া হলেও আমার সাধ্যাতীত নয়। শিক্ষার্থী হিসেবে কিছুটা ডিসকাউন্টও পাব। মনটা হালকা হয়ে গেল।       

হলে ফিরে দেখি সারাঘর কৃষ্ণচূড়া দিয়ে সাজানো। এলোমোলো ঘরের বিছানা। রুমমেট আর আমার বিছানার মাঝখানে লম্বা টেবিল পাতা। তাতে ছড়ানো কয়েক পদের খাবারের উচ্ছিষ্ট। রুমমেটের জন্মদিন ছিল কিনা আমার মনে পড়ছে না। এটা নিশ্চিত যে একটা কিছু উদযাপন শেষ হয়েছে। অতিথিরা চলে গেছে। রুমমেটও স্পেশাল ডেটিং-এ গিয়ে থাকতে পারে। চোখ বন্ধ করে দেখতে পেলাম, আজ রাতে রুমমেট ফিরবে না। গভীর রাতে একা হল থেকে বের হতে আর কোনো বাধা থাকল না। দাড়োয়ান খালার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এক হাজার টাকা আলাদা করে রাখলাম। কোঁচকানো বিচিত্র দাগ লাগা বিছানার চাদরের উপর বসলাম। হালকা আলোয় হাতের তালুতে লেখা ‘অন্তিম সেবা’দেখলাম। আমার অতীত মুছে গেছে অতীত বিস্মরণের তোড়ে। এবার ভবিষ্যৎ থামিয়ে দিতে হবে। ভবিষ্যৎকে আমি কিছুতেই আমার নাগাল পেতে দেব না। বিস্মরণে বন্দী থাকা আর ভবিষ্যতের মশকরা দুইয়েরই অবসান আমি নিজে ঘটাব। কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক, নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করা আমার জন্য একদম ব্যাপার না। যথেষ্ট ক্ষমতা আমার আছে। মোবাইল ফোনে ‘অন্তিম সেবা’অ্যাপ থেকে বুকিং দিলাম।

নিজের মৃত্যু নিশ্চিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের চেহারা পাল্টে গেল। নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করার ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হবার পরই ব্যাপরটা লক্ষ্য করলাম। সবাই নিজের মতো করে মরতে পারে না। বেশিরভাগ মানুষই তো আজকাল মরে টেনশনে, দুর্ঘটনায়, নিহত হয় সামান্য অসতর্ক মুহূর্তে। এই প্রেক্ষাপটে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত সমাজ ও নগর কর্তৃপক্ষ সবার জন্য স্বস্তিদায়ক। মা মিস করবে আমাকে। তবে এক সময় সয়ে যাবে। কিন্তু অন্ধকার ও অপমানে বিপর্যস্ত এক সম্ভাবনাময় সন্তানের সন্ত্রস্ত রূপ মায়ের সহ্য হবে না। অভিভাবকত্ব-দায়ের চাপে উল্টো আমাকেই দায়ি করবে। বলবে, ‘জীবন সবাইকে উপহাস করে না তো! তোর কেন এত সমস্যা? সবাই মিলে তোকেই কেন থামিয়ে দিতে চায়? আর কাউকে নয় কেন? তুই না টপার! তবু! ডনশ্চয়ই তোর দোষ আছে! তোর আচরণগত সমস্যা আছে।’  সুতরাং, মায়ের জন্য কিছুদিন বিষম বিলাপের পর স্বাভাবিক জীবন শুরু করাটা সম্মানজনক হবে। ভবিষ্যতে মা বলবে, ‘ওকে ধরে রাখতে পারলাম না!’ 

আমি এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়লাম। বুথে গিয়ে নগদ টাকা তুললাম। ক্যাম্পাসের এখানে-ওখানে বহুবর্ণিল আলোর চমক। গিজগিজ করছে তারুণ্য। একটা উঁচু মঞ্চের সামনে দিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। ভবিষ্যৎ নিয়ে বহুমাত্রিক আশঙ্কা সন্ত্রস্ত করে তুলেছে মানুষকে। বিষয়টা নতুন প্রজন্ম স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছে। মাইকে একজন বলছে, ‘জন্মের সময়েই মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত হয়। কেউ মৃতশিশু হয়েই জন্মায়, কেউ জন্মেই মরে, কেউ মরে একবছরে, কেউ কুড়ি বছরে, সাতাশে কিংবা সাতাশিতে। এটাই তো স্বাভাবিক। ঘুমের ঘোরে মৃত্যু হওয়ার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। এসব এতটাই স্বভাবিক! আসুন, মরার আগ পর্যন্ত জীবন উদযাপন করি।’ 

আজ আমার বয়স পঁচিশ বছর তেত্রিশ দিন। বেশ লম্বা জীবন পার করলাম। আমার খুব ভালো লাগছে যে আমাকে এতিমের জীবন কাটাতে হলো না, চোখের সামনে বাপ-মায়ের মৃত্যু আমাকে দেখতে হলো না। আমি খুব ভালোবাসি নানীকে। তাকে হারানোর বেদনা আমাকে আর স্পর্শ করল না। এমনকি ভবিষ্যতের অন্ধকার ও অপমান মোকাবেলা নিয়ে আমার আর একরত্তি চিন্তা রইল না।

হাঁটতে ভালো লাগছে। শিরশির হাওয়া ঢুকছে শরীরের ভেতরে। ঠান্ডা। গোঁ গোঁ করে ট্রাক ছুটে যাচ্ছে আমার পাশ দিয়ে একটার পর একটা। ধুলোর ঘন মেঘ নাকের কাছে উড়ছে। নাকে ওড়না চাপা দিলাম। অন্তিম সেবার প্রবেশপথের দুইধারে বড় বড় গাছের পাতা ঝরছে। এখানে তেমন হৈ চৈ নাই। চমৎকার নীরবতা। কোনো একটা গাছের উপর থেকে একটা পাখি ডাকছে, একটানা, বাহ! এটা কোকিল হবে হয়তো। সেরকমই শুনতে লাগছে। ঢাকা শহরে এর আগে পাখির ডাক শুনেছি কি না মনে নাই। বড্ড ভালো লাগছে রাতের পাখির ঘোর জাগানো ডাক। কিন্তু পাখির ডাক শুনতে গেলে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস হবে। সেটা আমার জন্য ভালো হবে না, কারণ অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের সময় অ্যাডভান্স করতে হয়েছে!  

অন্তিম সেবার প্রধান ফটক নিঃশব্দে খুলে গেল। একদল স্মার্ট তরুণ-তরুণী আমার উপর রজনীগন্ধার পাঁপড়ি ছিটিয়ে দিলো। কর্পুরের গন্ধ আসছে ওদের গা থেকে। আমি হেসে কাউন্টারে যেতেই আমার হাতে ছোট্ট কাচের পাত্রে নীল পানীয় দেওয়া হলো। তারপর অল্প বয়সী এক কিশোর আমার হাত ধরে নিয়ে গেল টপ ফ্লোরের কোমল আলোয় ভরা এক শূন্য ছাদখোলা স্যুটে। স্যুটের এক কোণে রাখা হাস্নাহেনার গাছ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে গোলাপজলের সুবাস। ম্যানেজার নিজে এসে বাকি পেমেন্ট নিয়ে গেলেন। এক তরুণী ট্রেতে করে মধুর মতো গাঢ় পানীয় নিয়ে এলো। বললাম, ‘রেখে যান’। তরুণী দাঁড়িয়ে থাকল, বললো, ‘আপনি এটা পান করলে আমি যেতে পারি। আপনার রিলাক্স করা দরকার। আমাকে রিপোর্ট করতে হবে। প্লিজ মিস, আমাকে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করুন।’ আমি পান করলাম। অসাধারণ জিনিস! আকাশে ঘন মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি মেঝের উপরে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমার ঘুমন্ত চোখের উপর ঘন বৃষ্টির ধারা নামল। ভবিষ্যতের কোনো আমাকে কাঁপাচ্ছে না। উঠে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির গন্ধে ঘর ভরে আছে। মেঝের উপর থেকে জোস্নারাতের মতো নেমে যাচ্ছে বৃষ্টির পানি। তাহলে কি আমার মৃত্যু নিশ্চিত হয়নি! চতুর্দিকে আজান হচ্ছে শুনতে পাচ্ছি। ভোর হচ্ছে। বৃষ্টি থেমে গেল হঠাৎ। অন্তিম সেবার ব্যান্ড কস্টিউম পরা কর্মীরা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আজান শেষ হলো। ম্যানেজার হতাশমুখে বললেন, ‘মিস, কোনো সমস্যা? সূর্যোদয়ের আগেই আপনার মৃত্যু নিশ্চিত হবার কথা, অথচ আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা কি কোনো সাহায্য করতে পারি?’ অথচ আমার ভাবান্তরের আর কোনো সম্ভাবনাই অবশিষ্ট নাই। আমি মৃত। মৃত বলেই ভবিষ্যৎ উধাও হয়ে গেছে আমার চোখের সামনে থেকে। তবু ওরা আমাকে কেন মৃত ভাবতে পারছে না তা ওরাই ভালো জানবেন। ম্যানেজার কাঁদতে শুরু করলেন, ‘মিস, আমার চাকরি থাকবে না। অন্তিম সেবার ব্যর্থতার রেকর্ড নাই। আমাদের সিওর ডেথ স্পেশালিস্ট আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। প্লিজ কোঅপারেট।’ সিওর ডেথ স্পেশালিস্ট একজন আমেরিকান বৃদ্ধা। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারেন না। হুইল চেয়ারে বসে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। খুব মৃদুস্বরে বললেন, ‘চিন্তা করবেন না। মরতে আপনাকে হবেই।’ মৃতের চিন্তাশক্তি থাকার ব্যাপরটাই তো হাস্যকর। আমেরিকান সিওর ডেথ স্পেশালিস্ট মৃত আমাকে মৃত্যুর হুমকি দিচ্ছে। ম্যানেজার উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,‘দেখুন, আমাদের অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করার সঙ্গে সঙ্গে আপনার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়েছে। আপনার মা অসুস্থ। আপনার ক্যাম্পাসের অধ্যাপক ও সতীর্থরা মোমবাতি জ্বালিয়ে আপনার শান্তিপূর্ণ মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করছে। এ অবস্থায় আপনি মরে না গেলে সমাজের সর্বস্তরে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সবাই বিশ্বাস করে আপনাকে। আপনার মৃত্যু নিশ্চিত না হলে আপনি সবার আস্থা হারাবেন, মিস। আমরা অন্তিম সেবার কার্যক্রম সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আপনার মৃত্যুর নিশ্চয়তার উপর আমাদের ইকনমিক এক্সপ্যানশন নির্ভর করছে।’

ওরা মিছেই উদ্বেগ বয়ে বেড়াচ্ছে। আমার যদি এখন অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষা বলে কিছু থাকত, তাহলে নিশ্চয় অন্তিম সেবার উন্নতি কামনা করতাম।