শিল্প ও সাহিত্য

মিজানের ইঁদুর-বিড়াল

টানা ছয়টা দিন ঘরের একটা কোণে কাত হয়ে পড়ে থাকার পর আমরা মিজানকে ডাকলাম। তখনো ওর মুখে ক্ষতগুলো দগদগে হয়ে ফুটে আছে, যেন খানিক আগেই কয়েকতলা উঁচু ভবনের ওপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়েছে, শুধু রক্তক্ষরণ হচ্ছে না, এ-ই যা। কয়েক দিন আগে মারধর করার পর থেকে ও ওইভাবে পড়ে ছিল; কোনো প্রকার চিকিৎসা-পত্তর না নিয়ে। মারধরের সময় ও যেভাবে প্রতিরোধহীন ছিল, তাতে যে কারও মনে হবে, এর জন্য ও অপেক্ষাই করছিল। প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখটা আরও নীল হয়ে যাচ্ছিল। যেন, নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ার আগেই ওর চোখ দিয়ে পানি গড়াতে শুরু করবে। কিন্তু ওকে পেটাতে শ্রমিকেরা এতটাই উৎসাহী আর দঙ্গল পাকিয়েছিল যে, এই বিষয়টা কারও দেখার সুযোগ ছিল না। ভাবতে পারি, হয়তো কেবল, আমিই। 

চার-পাঁচ বছর আগে মিজান যখন আমাদের শ্রমিক বহরে যুক্ত হয়েছিল, তার কিছুদিনের মধ্যে ওর কর্মঠ, স্বল্পভাষী আর সর্বসহা স্বভাবটা চোখে পড়েছিল। তখনই মনে হয়েছিল, এই স্বভাবের কারণেই ও সহকর্মীদের মধ্যে অপ্রিয় হয়ে উঠবে। ঘটে ছিলও তেমন। তাই বলে যে, ওকে এমন মারধর করা হবে, ভাবতে পারিনি। আমারই উচিত ছিল, ওকে আরেকটু আগলে রাখা, অন্তত অনেক কাজে দক্ষ আর পুরোনো শ্রমিক হিসেবে সেটা অসম্ভবও হতো না। কিন্তু জুনিয়র সুপারভাইজার থেকে সুপারভাইজার হওয়ার পর, তা আর সম্ভব হচ্ছিল না। আজ এই সাইটে তো কাল ওই সাইটে; মাসের পর মাস থাকতে হচ্ছে অন্য কোথাও। পরে মিজানের এক সহকর্মীর কাছ থেকে খবরটা পেয়ে আবাসনে আসতে হলো। 

অফিস গ্রাউন্ডে সকালের ব্রিফিংয়ের সময় নতুন কাজের জন্য শ্রমিকদের গুনতে গিয়ে একজন কম হওয়ায় খেয়াল করলাম, সব চেয়ে নতমুখো হয়ে কেউ একজন লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, কেটে ফেলা কলাগাছের মতো ঝুঁকে আছে মাথাটা। বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে গিয়ে নাম-ধাম জিজ্ঞেসের পর বলল, সে কাজটা বুঝেছে, পারবে। কিন্তু কথার মধ্যে কোনো আত্মবিশ্বাস ছিল না, এক প্রকার দায় বহন ছাড়া। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কাজটা ঠিকই করেছিল ও, অন্যদের চেয়ে দক্ষতার সঙ্গেই। তারপর টানা চার মাস আমার অধীনে কাজ করে গেছে কোনো রকম ওজর-আপত্তি ছাড়াই। এমনকি ছুটিছাটাও না। তখনই ওকে যতটুকু জানা। 

কিন্তু মিজানের ঠোঁট দুটো সবসময় এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকত যে, দুনিয়ার কেন, ওর মুখে নিজের সম্পর্কে কোনো কিছু জানা সম্ভব হতো না। ওর জিবটা, বোধ হয়, নিচের তালুর সঙ্গে এতটা লেপটে থাকত যে, খাবারের আলস্য ছাড়া কখনো নাড়াতই না। জিবটা একটা পাথরকুঁচির পাতা হলে, নিশ্চিতভাবেই, এত দিনে চারপাশে অঙ্কুর হয়ে দাঁতের ফাঁক দিয়ে কুঁশি-পাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। অবশ্য মুখ বন্ধ থাকার কারণে পুরোনো দেয়ালের রঙ তোলার মতো ধুলোময় কাজের সময়ও ওকে থুতু ফেলতে হতো না বলে ঠাট্টা করত সবাই। এ সব কারণেই হয়তো ওর একটা নাম দিয়েছে সহকর্মীরা—গুঙ্গা। 

একটা কাজ দিলে কখনো না করতে দেখিনি মিজানকে, শুধু ঘাড়টা একপাশে কাত করে বোঝাত—পারবে। এমনও হয়েছে, কোম্পানির পক্ষে আমাকে প্রায় দুঃসাধ্য কাজের ফরমায়েশ দিতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সবাই যখন রণে ভঙ্গ দিত, তখনো ওকে দেখতাম চেষ্টা করে যাচ্ছে। কোম্পানির কর্তাদের একজন হিসেবে আমার বরং খুশিই হওয়ার কথা, তবুও কখনো কখনো ওকে আস্ত একটা কৃতদাস মনে হতো, ইরেজারের মতো কাজের ভেতর নিজেকে ঘষে ঘষে ধ্বংস করে ফেলা কেউ। সবকিছুতেই ‘হ্যাঁ’ বলা স্বভাবের দুর্বলতা বৈ নয়। ওর শেষ না-হওয়া অনেক কাজ জমে গিয়েছিল। এ জন্য ও বিব্রতও ছিল, বোঝা যায়। ঘাড় মুড়ে মাটির দিকে এক ধিয়ানে চেয়ে থেকে হয়তো তারই একটা মীমাংসা খুঁজত। 

ব্রুনাইতে একটা প্রবাসী ঠিকাদারি কোম্পানি আমাদের। বিশেষ করে গৃহনির্মাণ ও অভ্যন্তরীণ সজ্জার প্রতিষ্ঠান, কিন্তু টেন্ডার করে যখন যে কাজ জোটে, তা-ই করতে হয়। ঘাস সাফ করা থেকে শুরু করে ভবন ভাঙা, মায় রাস্তার কাজ পর্যন্ত। নতুন ভবন তৈরির ঠিকা পেলে কী করতে হয়, তা সবারই জানা। মিজানকে প্রায় সব কাজ করতে দেখেছি। অ্যাটেনডেস খাতায় ওর হাজিরা তেমন ছিল। এমনকি আমাদের স্থাপত্য বিদ্যার জটিল-কুটিল জ্যামিতিক মাপ নিয়ে করতে হয়, তেমন কাজেও ওর হাত ছিল নিখুঁত। শুনেছি, তেমন একটা কাজে তাক লাগিয়ে দেয়ার পর এক সুপারভাইজার ওকে দিয়ে চারমাস ঘাস কাটার কাজ করিয়েছিলেন। 

এক রাতে খবর পেলাম, শ্রমিকদের আবাসনে কী এক গণ্ডগোল হয়েছে, সম্ভবত কথা-কাটাকাটি থেকে ঠেলাঠেলি পর্যন্ত। শ্রমিকদের আবাসন আমার ছোট্ট কটেজ থেকে খুব দূরে নয়। অগত্যা আমাকেই যেতে হলো। শুনলাম, মিজান যেন কাকে ঘুষি মেরেছে। তারপর ওকে সবাই মিলে চর-থাপর-লাথি-গুঁতা যা পারে মেরেছে। পরে ঘরের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রেখে যা ইচ্ছে বকে যাচ্ছে। সবার অভিযোগ, মিজান রাত-বিরাতে আবাসনের ছোট্ট বারান্দার, ব্যালকনিও বলা যায়, তার এক কোণায় হুতোম প্যাঁচার মতো বসে থাকে। এভাবে ওকে দেখে একজন ভয় পেয়ে চিৎকার করেছে। তাতেই লোকটার নাক-মুখজুড়ে টেনে এক ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে ও। তারপর যা হয়।   ‘ও যে গোয়ালের মতো চিৎকার করছিল!’  সব অপরাধ সাব্যস্ত শেষে ওর জিবটা ওপর তালু নিচ তালুতে আঘাত করে ওই কয়েকটা শব্দ বলল। কিন্তু সভাসদ কারও প্রতি ওর কোনো আস্থা আছে বলে মনে হয় না, তুচ্ছ উপেক্ষা ছাড়া।   ‘তুমি সিগারেট খাও?’   ‘না।’  কিন্তু ওকে পকেটে থাকা কলম, বা সাইটে ডিজাইনের কাঠপেনসিল দিয়ে ধূমপানের ভাব করতে দেখেছে কেউ কেউ। এটা ভেতরে কিছু চেপে রাখা কি না, কেউ বলতে পারে না। 

আবাসনের ওকে; বলা ভালো, ওর মতো করে থাকার পরিবেশে ছিল না। অন্যদের বলে ওর বালিশ-তোশক একপাশে নেওয়ার ব্যবস্থা করার পর মনে হলো, আসলে অন্যদের আসনগুলো একটু সরিয়ে আনা হয়েছে। মিজানের রুমমেটরা জানিয়েছিল, অনেকটা মেস ব্যবস্থায় ওখানে থাকা হয়। একেকদিন একেকজনকে রান্না করতে হয়, ক্রম অনুযায়ী। সবাই চেষ্টা করে সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে রান্নার দায়িত্ব নিতে। দৈনিকের হাজিরা ঠিক রাখার কৌশল হিসেবে করা এই রান্না সবার রোচে না। মিজানের সেই বাতিক ছিল না, নিজের কাজ বাদ দিয়ে সবার জন্য রান্না করে, খানিকটা প্রশংসাও আছে তার। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, রাতের খাওয়ার পর ভোরে গোসলের সময়ের জন্য রেখে দেওয়া সবার বাসনগুলো না চাইতেই মিজান পরিষ্কার করত। এ জন্য ওর প্রতি কারও কারও গোপন সহমর্মিতাও ছিল, যেটা কেবল বিদায়জনিত মুহূর্তেই প্রকাশ পেতে পারে। রাত বেশি হয়ে যাচ্ছিল শ্রমিকদের কথা শুনতে শুনতে। শেষে বলে এলাম, ওকে আলাদা করে থাকতে দিতে। আর একজন শ্রমিককে পাশে ডেকে বললাম, ওখানে কখন কী হয়, তা জানানোর জন্য। 

আবাসন থেকে মিজান সম্পর্কে যা জেনে এসেছিলাম, তা আমাদের কোম্পানির চেয়েও পুরোনো। সম্ভবত আট-দশ বছর আগে আত্মীয়-স্বজন ধরে ব্রুনাই এসেছে। বয়স তখন মোটে ত্রিশ পেরুনো। তখনই ওর মাথার চুল কমে গিয়ে ছিল, যতটা না বয়সের কারণে, তার চেয়েও বেশি কোনো অজ্ঞাত দুর্যোগে মনে হয়। মুখটা যে শুকনো নদীর মতো শীর্ণ হয়ে গিয়েছিল প্রশস্ত পাড়ের মতো চোয়ালের প্রসারই ওর স্বাস্থ্যের নির্দেশক। ওর আঙুলগুলো, সেই যে ষোড়শ শতকের জার্মানির হ্যানোভার বনে মাটি খুঁড়ে গাছের মূল খাওয়া বুনো পিটারের (পিটার দি ওয়াইল্ড বয়) আঙুলের মতো খসখসে হয়ে গিয়েছিল কেন, সেই ইতিহাস কারও জানা নেই। বুনো পিটার তবু দীর্ঘ সময় বনে থেকে মানুষের ভাষা হারিয়ে ছিল, মিজান তার উল্টো, বনের মৌন ভাষা শিখে নিয়েছে। 

আগের কোম্পানিতে ওর ভালোই মূল্যায়ন হয়েছিল, সম্ভবত ওই কোম্পানির কারও সঙ্গে আত্মীয়তা থাকার সূত্রে। বছর চারেক আগে কোম্পানির মালিকানা হস্তান্তর করার সঙ্গে ওকে পাওয়া গেছে। কিন্তু তাতে ও পুরোপুরি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। সমুদ্রে টুনা মাঝের ভিড়ে একটা জেলি ফিশের মতো, বা তার চেয়েও শোচনীয় কিছু। 

*** আমি প্রকৌশলী মানুষ। ক্যারিয়ার আর উপার্জন নিয়ে বেশি ভাবি। এর মধ্যে অন্যকে নিয়ে ভাবার অভ্যাস পেশার ধারা সূত্রেই কম। তবে প্রবাসে কাজ শেষে কিছুটা সময় মিলে যায়, তখন কিছু নিয়ে ভাবা যেতে পারে। সেই সূত্রে মিজান আমার কল্পিত খেলার নায়ক। তবু তাকে সব সময় প্রশ্রয় দিলে চলে না।  আবাসন থেকে ফেরার কয়েক মাসের মধ্যে দুটো খবর শুনলাম মিজান সম্পর্কে, আপাত ওর মন-মতি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। স্টার মার্ক আর ক্রম দিয়ে তথ্যগুলো নোটখাতায় তুলে রাখলাম, সামান্য বিশ্লেষণ সহকারে।  * প্রথম: শুনলাম, আবাসনের ঘরের পেছনে মিজান দুটো ইঁদুর এনে পালতে শুরু করেছে। আশ্চর্য! হঠাৎ করে এই বাতিক পেল কোৎ থেকে! প্রবাসী শ্রমিকের প্রবণতা সবারই জানা—কাজ, ঘুম, ফোনে কথা বলা, আর পরদিন আবার কাজে যাওয়া। মাসান্তে বাড়ি টাকা পাঠানো আর কিছু টাকা জমিয়ে দুই বছরান্তে বাড়ি ঘুরে আসা। পরে খবরটার একটা সংশোধনী পেলাম, ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। বৃষ্টিতে নিচু জায়গা পানিতে ভরে যাওয়ায় হয়তো দুটো মেঠো ইঁদুর ঘরের পাকা ভিডির পাশে খুঁড়ে মাটি তুলেছে। মিজান সেখানে এঁটো-কাঁটা ফেলে আসে। ও যে স্বেচ্ছায় সবার বাসন-কোশন ধোয়ার কাজ করে, সেখান থেকেই এসব পায়। রাতে ইঁদুরগুলো গর্ত থেকে বেরিয়ে এলে কাউকে কিছু বলতে দেয় না ও। কিন্তু আবাসনের অধিকাংশ শ্রমিকেরা ফ্লোরে বিছানা পেতে শোয়, আর জামা-কাপড় রাখে একটা কাপড়ের ব্যাগে, খুব বেশি হলে বহু ব্যবহারের একটা লাগেজে। ইঁদুর সেসব কেটে ফেলতে পারে বলে সবাই ওগুলো মেরে ফেলতে চায়, কিন্তু মিজানের জন্য পারে না। ওর রাত জেগে বারান্দায় বসে থাকা এতে সহায় হয়েছে। 

এর কিছুদিন পরে— * দ্বিতীয়: শুনলাম, মিজান কোত্থেকে একটা বিড়াল এনে ঘরে তুলেছে। কথাটা শুনে মনে হলো, ওর বুঝি জ্ঞান গেরামত হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকেরা বলছিল, এটা ওর নতুন প্রতারণা। ও ইঁদুর মারা জন্য বিড়ালটা আনেনি, বরং বিড়াল দেখিয়ে ইঁদুরগুলো পেলে রাখার ফন্দি করেছে। আবাসনের শ্রমিকের আনাড়ি রান্নার কারণে প্রচুর খাবার ফালানি যেত, কিন্তু সহজ রান্নার চিন্তা করে তাতে মাছ-মাংসের অভাব ছিল না। মিজান সেই সুযোগটা পেত। বিড়ালটাও বেশ পোষ মানা আর নাদুস-নুদুস হয়েছে।  আবাসনের বারান্দায় বিড়াল আর উঠোনে ইঁদুরকে একইসঙ্গে খাবার খাওয়াত, আরব শেখদের মতো গাড়িতে চিতা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মতো গৌরবোন্মোচিত সাবলীলভাবে। কিন্তু শ্রমিকেরা ওর ওপর ভীষণ ক্ষ্যাপা ছিল! শুরুতে বিড়ালটা সারা রাত মিঁউ মিঁউ করত। অল্প দিনের মধ্যে বিড়ালটা যে মদ্দা, তা প্রকাশ হয়ে পড়ার পরই মাদির জন্য গলা ছেড়ে মাউ মাউ ডাক শুরু করায় অন্যদের সব আশার গুঁড়ে ছাই পড়ে গেল। এসব নিয়ে সারাসময়ই নানা কথা আসত আমার কাছে। বিশেষ করে আমার দায়িত্ব দেওয়া লোকটা বাচাল প্রকৃতির, আর অন্যদের মধ্যে তোষামোদের মাত্রাটা বেড়ে যাওয়ায়। 

মিজানের ইঁদুর-বিড়ালের কাহিনি শুনে ক্লান্ত হাওয়ার দিনে কোম্পানির নতুন উইং খোলার সঙ্গে আমাকে যুক্ত করে নতুন সাইট দেখার দায়িত্ব আর বহুল কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি দেয়ায় আমাকে আর কটেজে থাকতে হলো না। তবে কটেজ ছাড়ার আগে মিজানকে একবার দেশে থেকে ঘুরে আসার অফার দিলাম। ওর সহকর্মীরা জানাল, ও বাড়ি যেতে চায় না। বাড়িতে ওর বোনেরা ছাড়া কেউ নেই। দুই বছর আগে বাধ্যতামূলকভাবে দেশে গিয়ে এয়ারপোর্ট এলাকার কোথাও না কি দিন পনেরো থেকে ফিরে এসেছে। বিমানের ফিরতি টিকিট হারানোর কোনো এক ঝামেলায় বিষয়টা সবাই জেনে গিয়েছিল। পরে ওর ভিসার মেয়াদ কয়েক মাস বাড়ানোর আবেদন করা হলো। কিন্তু ব্রুনাইতে দুই বছর পরপর প্রবাসীদের বাধ্যতামূলক দেশে যেতে হয়, নইলে সন্দেহের তালিকায় চলে যায়। কয়েক দফা ভিসার মেয়াদ বাড়িয়েও এক বছরের বেশি থাকার সুযোগ নেই। 

*** কটেজ ছাড়ার পরে মিজানের সঙ্গে আমার দুইবার দেখা হয়েছিল। দুবারই সমুদ্র সৈকতে, যেখানে ওকে সবচেয়ে কম আশা করেছিলাম। যখন অন্যদের শপিংমল, ঝলমলে স্থাপনা ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। দক্ষিণ চীন সাগর ঘেরা দ্বীপরাষ্ট্রে সমুদ্র সৈকতে কাউকে দেখা হয়তো অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু অন্য প্রবাসী শ্রমিকদের না দেখায় ওকে ঘিরে সেই উষ্ণতা ছড়িয়েছে। 

প্রথমবার দেখেছিলাম মুয়ারা সৈকতে। আমি তখন মুয়ারা বন্দর দিয়ে কোম্পানির নতুন বাণিজ্য খোলার জন্য পণ্য আমদানির লাভের সম্ভাব্যতা যাচাই করছিলাম। পরে একটু এপাশ-ওপাশ ঘুরে দেখতে গিয়ে সৈকতের একেবারে পাড় রক্ষা পাথরগুলো ঘেঁষে বালিতে মিজানকে দেখলাম। সৈকতে কিছু লিখছে, চীন সাম্রাজ্যের চেয়েও পুরোনো মন্থর ঢেউ দক্ষিণ চীন সাগর থেকে উঠে এসে তা ধুয়ে দিচ্ছে, আবার লিখছে। বিকলের দিকে সমুদ্র শান্ত থাকায় আয়তনের চেয়েও বিশাল, কিন্তু বৃত্তের পর বৃত্ত কুণ্ডলী পাকিয়ে বসা সাপের মতো ভয়ংকর নিঃসঙ্গ লাগছিল। 

দ্বিতীয়বার দেখেছিলাম জেরুদং সৈকতে। রাজধানী বন্দর সেরি বেগাওয়ানের কাছে বন্ধের দিনে ঘোরার জন্য ওই এলাকাটা অনেকেই পছন্দ করে, বিশেষ করে অর্থসম্পন্নরা। সৈকতের বিরাট এক অংশজুড়ে পাথর ফেলা। বালুময় সৈকত ধরে হাঁটতে হাঁটতে পাথরের এলাকা গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হলো। দূরে পাথরের চাইয়ের ওপর একটা লোক বসে আছে। পানিবন্দী কুকুরের চেয়েও কাতরভাবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম মিজানকে এক নাগারে দীর্ঘ সময় মাথা তুলে থাকতে দেখলাম। জলের প্রবাহে মসৃণ পাথরের মতো ওর মাথা মুড়িয়ে সমুদ্রের কোন লু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে বোঝা ভার। অথচ গ্রামে কোনো পুকুর বা খালে ও যে সাঁতার কেটেছে সে গল্প ওর সঙ্গের কেউ জানে না, দিনের পর দিন একই ঘরে থাকা বা একসঙ্গে কাজ করেও। 

গাঁটরি-বোঁচকা নিয়ে কটেজ থেকে পুরোপুরি বিদায় হওয়ার আগে, কোম্পানির মালিক, যিনি পরিচালকও, সুমন সাহেবকে বলেছিলাম, সম্ভব হলে মিজানের গ্রামে যেন একটু খবর নেন। পাসপোর্ট বলছে, ওর বাড়ি যশোর, শহরেই। শ্রমিকের বহরে একজন ওর পাশের উপজেলা, ঝিকরগাছার বাসিন্দা, বলেছিল, মিজানকে এলাকার সবাই চেনে মাস্টারের বাড়ির ছেলে হিসেবে। ওর বাবা ঝিকরগাছার একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। এতটুকু সূত্রই তুলে দিতে পেরে ছিলাম তাঁর কাছে। সুমন সাহেব চট্টগ্রামের মানুষ, বন্দর পাড়ায় পুরোনো যন্ত্রপাতি বিক্রি থেকে শুরু করে এই বিদেশে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে ব্যবসায় পেতেছেন। এখন দেশেও বিমানে এপাশ-ওপাশ চলাফেরা করেন। তাঁর কাছে কী করে এর কিছু আশা করা যায়, তা জানি না, বয়সের কাছাকাছি হওয়া ছাড়া। 

*** মিজানকে একবার অফিসে ডেকে ছিলাম, কটেজ ছাড়ার পরপরই। সেই ম্লান মুখ আরও বিব্রত বোধে ছেয়ে গেছে, যেন গনগনে চুল্লির পাশে আধপোড়া মানুষটা পড়ে আছে। সবচেয়ে বিবমিষার চোখে তাকিয়ে ছিল পাশের ছোট বুক শেলফের দিকে। যেখানে গোটা কয় স্থাপত্য বিষয়ক বই, দু-একটা ট্রাভেলগ, পুরোনো ম্যাগাজিন আর এখানে-সেখানে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সূত্রে পাওয়া স্যুভেনির ছাড়া কিছু ছিল না। আনত তাকিয়ে থাকলেও ওর চোখ দুটো অনবরত নড়ছিল, শিশুর হাতে জ্বলা টর্চের মতো এলেবেলে আলো ফেলে; তবে কোনোভাবেই যেন শেলফটার দিকে চোখ না যায়, সে জন্যই এখানে-সেখানে করুণ দৃষ্টি ফেলে দেখছিল, শেষে পাশ ফিরে বসল।  তখনই ওর মুখের বাঁ-পাশের কাটা দাগটা চোখে পড়ল। একটা গভীর ক্ষত দাগ চোখের নিচ থেকে কানের লতির দিকে এগিয়ে গেছে কেটে ফেলা জুলফির প্রান্ত দিয়ে। দাগটা এই আরবের ধূসর মরুভূমির নির্ণয় অযোগ্য স্থানে জেগে থাকা পরিত্যক্ত ভবনের মতো, অভিশাপে জর্জরিত নিঃসঙ্গতার প্রতীক যেন।  ‘তুমি বই কি খুব অপছন্দ করো?’  নতমুখে ঘাড় নেড়ে বোঝাল—না।  পরে ওর হাতে গাড়ির চাবি দিয়ে বললাম, শ্রমিকদের সাইডে আনা-নেয়া করতে করতে ওর আপত্তি আছে কি না। যদিও কী জানাবে তা জানাই ছিল, মূক মুখটা একপাশে হেলে পড়ে বোঝাল—পারবে। তারপর ওর উপস্থিতির চেয়েও অস্পৃশ্যতা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।  চোখের গঠনের মতো, ছোট ধূসর আই-বলের পেছনে আশ্চর্য বৃহৎ অক্ষিগোলকের মতো কত বড় চিন্তা ওর মাথায় ঘুরে গেল বোঝা গেল না। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ওর পেছনে টেনে নেওয়া একটা মৃত সাপের দীর্ঘ নিথর দেহ বয়ে যেতে কেন দেখছিলাম না, সেটাই আশ্চর্য হওয়ার মতো। জানালার শার্শি দিয়ে আমি দেখছিলাম।  কটেজ ছেড়ে আসার পর আবাসন থেকে মিজান সম্পর্কে দুইটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছিলাম। যথারীতি ব্যক্তিগত নোটবুকে টুকে নিলাম, সঙ্গে সূত্র উল্লেখ করে। 

১. মিজানের পালিত ইঁদুর দুটো মারা গেছে। গর্তের পাশেই মৃত ইঁদুরের ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেছে। সম্ভবত বিড়ালটাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।  [বি.দ্র.: শেষের মন্তব্যটা একজন শ্রমিকের, যিনি একটু অনুগ্রহের গৌরব প্রত্যাশা করেন। ]

২. এবার বিড়ালটাও মারা গেছে। সম্ভবত হাঁড়ির মাছ চুরি করে খেতে গিয়ে বৈদ্যুতিক চুল্লির তারে পা লাগিয়ে ছিল। সেখানেই মরে পড়ে ছিল। এ সময় বিড়ালের নাক-মুখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত-বিজলও পড়ে ছিল সেখানে। [সূত্র: আমার তথ্যদাতারা। ]

প্রতিক্রিয়া: প্রতিটি ঘটনা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক মনে হয়েছে সবার কাছে, কিন্তু মিজান থ-মেরে গেছে, যেন অবিশ্বাস্য, এটা হতে পারে না! এ সবের পর মিজান আগের চেয়ে বেশি বারান্দায় বসে থাকছে, আর কী যেন ভাবছে গভীরভাবে। [সূত্র: উৎসাহী শ্রমিক]

*** দৈনন্দিন যোগাযোগেই জেনেছিলাম, সুমন সাহেব দেশে গিয়েও ব্যবসায় বুদ্ধি নিয়ে ভাবছেন। তাই তাঁর কাছ থেকে মিজানের বাড়ির কোনো খোঁজ আশা করা যাচ্ছিল না। ফের-চক্রে, তাতেও আশার আলো মিলল, তবে ভরসা চার্জ ফুরিয়ে আসা টর্চের আলোর চেয়েও ক্ষীণ ও একইভাবে দূর প্রত্যাশী। 

ভারত থেকে পণ্য আমদানির ব্যাপারে যশোরের বেনাপোল বন্দর রেকি করতে গিয়েছিলেন সুমন সাহেব। সেই সুবাদে যশোরে বিখ্যাত মিষ্টি খেতে শহরে যাওয়া তার। শহরের দড়াটানা মোড়ে পুরোনো বইয়ের দোকানে জিজ্ঞেস করেছিলেন মিজানের কথা। বই বোঝাই শেলফের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে দোকানের স্টাফেরা তাঁকে নিয়ে যান মি. তুহিন নামের একজনের কাছে, যিনি কি না মিজানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন! দোকানের মালিকদেরও একজন। তুহিন সাহেব যা জানিয়েছেন, তা অস্বস্তিকর ও অভাবনীয়! সুমন সাহেব অনেকটা বিব্রতকর অবস্থায়ই পড়েছিলেন, যেমন শুনতে শুনতে আমারও মনে হচ্ছিল— মিজান একটা চোর। অনেকবার সে দোকান থেকে বই চুরি করেছে। সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়েছে, ডকুমেন্টগুলো এখনো আছে। এর আগেও লাঞ্ছিতও হয়েছে। বউ তাঁকে ছেড়ে গেছে, মাথা খারাপ হয়ে শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়েছে। মিজানের কথা শহরের কাউকে জিজ্ঞেস না করাই ভালো, সম্পর্ক না দেখানোই সম্মানের।  ব্যাপারটা সুমন সাহেব না-জানলেই ভালো হতো। এখন কোম্পানির কাছেও মিজানকে ছোট হতে হবে। তবে কোথাও একটু ফাঁক আছে মনে হলো। আমার মনে পড়ছিল, শেলফের দিকে মিজানের বিহ্বল চোখের ঘোরাঘুরি। 

ফেসবুকে বাণিজ্য ও প্রচার বাড়ায় দূর যশোরের বইয়ের দোকানের পেজ খুঁজে পাওয়া কঠিন হলো না। বই বন্দর। দোকানটার নাম। সুমন সাহেবের পাঠানো ছবিতেই পেয়েছিলাম। পেজে দোকানের একটা ফোন নাম্বার পাওয়া গেল বটে, কিন্তু বই সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া তারা কোনো কথা বলতে রাজি নয়, সম্ভবত দোকানের সেলসম্যান কেউ হবে। মেসেঞ্জারে কয়েক দিন মেসেজ চালাচালির পর একটা ফোন নাম্বার পেলাম, সম্ভবত অনুমতিসাপেক্ষে। মি. তুহিনের নাম্বার। তবে বিকেল থেকে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত কল করা যাবে না, কেবল রাত বারোটার আগে খানিকটা সময় কথা বলা যেতে পারে। গ্রিনিচ মান টাইমে বাংলাদেশের দেড়-দুই ঘণ্টা এগিয়ে থাকা ব্রুনাইতে ততক্ষণে গভীর রাত হয়ে যায়। তারপরও চেষ্টা করলাম। 

বিদেশি নাম্বার থেকে কল যাওয়ায় খানিকটা সৌজন্য দেখালেন, ঠিক যতটা মিজান সম্পর্কে অনাত্মীয় কারও উৎসাহ দেখে বিস্মিত হয়েছেন।  ‘মিজানকে ভীষণ স্নেহ করতাম, ছোট ভাইয়ের মতো। ভালো কবিতা লিখত ছেলেটা। ছদ্মনামে। দেশে অনেক পত্রিকায় ওর কবিতা চেয়ে নিত। ঢাকা থেকে ওর লেখক বন্ধুরা আসত ওর বাসায়। ওকে সঙ্গে নিয়ে এখানে-সেখানে যেতাম, একসঙ্গে মদের আসরেও বসেছি পর্যন্ত। দোকানের কর্মচারীরা পর্যন্ত জানত ব্যাপারটা। তাই দোকানে ওর যাতায়াত ছিল অবাধ। কর্মচারীরা প্রায়ই বলত, শেলফে রাখা বই পাচ্ছে না। লাখখানিক বইয়ের দোকানে কোথায় কোনটা কে নিয়ে যাচ্ছে, বলা যায় না। ওরা কয়েকটা ভিডিও ফুটেজ দেখাল। মিজানই জরুরি বইটা সরিয়েছে, আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না।’ 

একটা ঢোক গেলার শব্দ পেলাম।  ‘একদিন মিজান দোকান থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরই ওকে ফোন দিয়ে বললাম, বইটা দিয়ে যা। ও কোনো গাঁইগুঁই না করে দিয়ে গেল। পরে বিষয়টা ব্যবসার পার্টনারদের কানেও যায়। ওরা আরও কিছু ফুটেজ উদ্ধার করেছে। ওরাই আলাপটা তুলেছিল, বইগুলো ফেরতের জন্য চাপ দিতে। ফুটেজের কিছু এখনো আছে, চাইলে আপনাকে পাঠাতে পারি।’  ‘হুম, দরকার পরবে না।’ 

হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে যাওয়া লোকটার বিপরীতে শুধু বললাম। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তুহিন সাহেব আবের মুখ খুলেন।  ‘ও আমার কয়েকটা বড় সর্বনাশ করেছে— ১. আমার আস্থার জায়গা নষ্ট করেছে,  ২. আমার ঘনিষ্ঠ যারা দোকানে আসত, তাদেরও সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছিলাম। আর ৩. অর্থনৈতিক ক্ষতি তো আছেই।’ 

মুঠোফোনের ওপাশে তখন নগর যশোরের নিস্তব্ধতা। তবু নগরের বর্জ্যে দূষিত হয়ে পড়া ভৈরব নদের চোরা স্রোত কখনোই থামে না।  ‘কিছুই করার ছিল না, একবার ওর বাসায় উপস্থিত হলাম। ধরা পড়ার পর ও-ই আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ওর বুকশেলফ খুলে দিল, পুরোনো ধাঁচের, যে বইগুলো আমাদের দোকানে ছিল, নিয়ে এলাম। তারপর ও আর এদিকে আসেনি।’ 

হঠাৎ কী মনে করে, লোকটাকে কথার বাতিক পেয়ে বসল। তিনি অহেতুক মিজানের কবিতার বিশ্লেষণ করছিলেন, যা মাথামুণ্ডু কিছুই আমি বুঝছিলাম না। এর মধ্যে দুটি তথ্য আমার নোটবুকে টুকে নিলাম— ১. মিজানের স্ত্রী এখন যশোরেই একটা স্কুলে মাস্টারি করেন, নতুন সংসার হয়েছে,  ২. শুক্রবার করে যশোরে আসা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের অধীনে মিজানের চিকিৎসাও শুরু করা হয়েছিল। 

*** মাথা চুলকে যে চিকিৎসক বন্ধুর কথা মাথায় এল, সে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নয়। পয়সা করার জন্য অনেকের মতো সেও হার্টের ব্লক পরানোয় দক্ষ। তবে দেশে থাকতে ওর সূত্রে মনোরোগের এক চিকিৎসকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, গুলশানের একটা স্বল্প পরিচিত বারে, যে কি না বলিউডের সিনেমার পোকা। ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’ দেখার পর তাক লাগানোর মতো কিছু করে ফেলার উচ্চাভিলাষ দেখে। যে কারণে ওর কথার সার, আর বলার চেয়ে বেশি ভেবে নিতে হয়। মিজানের রোগের বর্ণনা দিয়ে সেই ডাক্তার বন্ধুকে মেইল করলাম।  ফিরতি মেইলে ও জানাল, লোকটা (মিজান) হয়তো চৌর্যোন্মাদ (ক্লিপটোমেনিয়া) রোগে ভুগছে। তারপর একগাদা মেডিকেল টার্ম জুড়ে দিল, যা বোঝা সাধ্য আমার নেই। পরে স্মৃতি থেকে বিস্মৃত প্রায় একটা গল্প বলল, আমাদের শৈশবের প্রিয় আরব্য রজনী থেকে। একটা লোক খাবারের জন্য রাস্তায় ভিক্ষা করছে, কেউ খাবার দিলে বলছে, আগে চাবুক দিয়ে তার পিঠে আঘাত করতে হবে, নইলে সে খেতে পারবে না। একটা অনুশোচনা থেকে এই আচরণ করছে। ক্লিপটোমেনিয়া আক্রান্ত হলে এই অবস্থা হয়।  ‘মিজান একজন কবি।’ ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝার জন্য বলি।  ‘তাঁর কি বই চুরির বাতিক ছিল!’  অভেদ্য আঘাতটা একেবারে আমার মনে লাগল। 

এই ধরনের মানুষের ভেতর লজিক আর অ্যান্টি-লজিক একই সঙ্গে চলে, সারাক্ষণ লড়াই চলে। গর্ড অ্যান্ড বিস্ট ওয়্যার। ঘোড়সওয়ার হয়ে রেসে নেমে পড়ার মতো। শেষে যখন ঘোড়াটা চাবুক সমেত মুনিবকে ফেলে দৌড়াতেই থাকে, তখন শক্ত চাবুক কেবল প্রত্যাখ্যাত ঘোড়সওয়ারের পিঠে পড়তে থাকে। পড়তেই থাকে।  ‘মিজান ঘরে একটা বিড়াল আর বাইরে দুটো ইঁদুর পুষতে শুরু করেছে।’  ‘ইউনিক কেস!’ উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল বন্ধু। সে মিজানের চিকিৎসা পত্তর করতে চায়।  ‘যে করেই হোক, ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন।’ শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটা দিয়েই দিল। 

*** তুহিন সাহেবের সুবাদেই মিজানের স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। শহররে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। বিয়ে করেছেন। তাই হয়তো বেশি কথা বলতে চান না।  ‘আপনি তো মিজানকে পছন্দ করে, আই মিন, ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। এখনো নিশ্চয়. . ’  ‘একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি ও কাঁদছে। ওর পছন্দের কিছু বই খোয়া গেছে। কী করে তা হলো, আজও জানতে পারিনি। সেদিন থেকেই ও নীরব হয়ে গেল। তারপর ওর বইগুলো একে-ওকে, নানা লাইব্রেরিতে দিয়ে দিতে লাগল। কিছু বই পুরোনো দরে বিক্রি করে দিল। একেবারে বদলে যাওয়া মানুষ, অচেনা। লেখালেখিও ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল, নিজের ভেতর কেবল ভাবনাটুকু ছাড়া ওর সার নেই কোথাও।’  ‘ওর চিকিৎসা শুরু করেছিলাম, কিন্তু ডাক্তারের সঙ্গে ও কো-অপারেট করছিল না। এর মধ্যে আম্মা মারা গেলেন। ও আরও ছন্নছাড়া হয়ে গেল। পরে ওর বোনেরা এক আত্মীয়কে ধরে ওকে ব্রুনাই পাঠিয়ে দিলেন।’  ‘শেষবার ওর দেশে ফেরা খবরে ঢাকায় এয়ারপোর্ট এলাকায় খুঁজে বের করে দেখা করেছিলাম। বাড়ি আসার জন্য জোর করলাম। ফিরতি টিকিট, পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে দুদিন আটকেও রাখলাম, কিন্তু ওর ভেতর ফেরার আগ্রহ না দেখে সব ফেরত দিয়ে চলে এলাম।’  এই সব বয়ানের ভেতর গুঁজে দেয়ার মতো আমার কোনো কথাই বলার ছিল না, যাত্রাপালার বিহ্বল গ্রামীণ দর্শকদের মতো। তাঁর কথার মধ্যে দ্রুত একটা গল্প শেষ করার তাড়া অনুভব করলাম মাত্র। 

‘এতটা গুমোট ওকে কখনোই দেখিনি। মনে হতো লাশের পাশে শুয়ে আছি, ও এতটাই শক্ত হয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকত। এমনকি সেই যে বই খোয়ানোর দুদিন পরে দেখতে পেরেছিলাম, ওর মুখের ওপর অনেকটা কেটে গেছে। ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। বোনদের সঙ্গে থাকতে পারে। ছেলেটা স্কুলে পড়ে। ভালো আছে।’ 

শেষ কথাটা যেন ক্ষতবিক্ষত পতিত জমিতে ড্রেজার দিয়ে বালু ফেলে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা, তাতে জমিনে সমান বুক তৈরি হলেও জেগে থাকা ধু ধু সাদা চোখে পড়ার মতো। 

*** আবাসনে যাওয়ার পথে তুহিন সাহেবের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম। বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল, তবু দ্রুতই পাওয়া গেল, যেমন কখনো কানের কাছে কারও মুখ পাওয়া যায়।  মিজানের মা তাঁর দোকানে আসতেন। বাড়ি ভাগ করার সময় ভাইয়েরা ওকে যে খাঁদ জায়গা দিয়েছিল, তা ভরাট করে একটা ঘর তোলার স্বপ্ন দেখতেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তাঁর মৃত্যুর পর ওই খাঁদটা ভরাট করার কথা বলেই মিজানকে বিদেশ যেতে রাজি করা গিয়েছিল। প্রবাসে মিজানের যা উপার্জন, তা বোনদের কাছে পাঠায়। কিন্তু তা এতই সামান্য যে, সাত-আট বছরেও তা ভরাট করা শেষ হয়নি।  আবাসনে পৌঁছানোর পর শ্রমিকেরা একগাদা অভিযোগ নিয়ে এল, মিজানকে মারধরের অপরাধ বোধসহ। 

‘ইঁদুর-বিড়ালের মৃত্যু নিয়ে মিজান খামোখা ঝামেলা করছিল। থামানোই যাচ্ছিল না। আপনার কথা ভেবে ওকে অনেকক্ষণ সহ্য করেছিলাম, কিন্তু তাতেও পাগলামি করায়...’ মিজানের দৃঢ় বিশ্বাস, ইঁদুর দুটো আবাসনের কেউ মেরেছে, আর বিড়ালটাকেও। এই নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে লেগেছিল। ও সবাইকে প্রাণী হত্যার অভিযোগে পুলিশে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিল।  আবাসনে কয়েকজন শ্রমিক ছিল, যাদের ভিসার মেয়াদ শেষে অনেক আগেই অবৈধ প্রবাসী হয়ে পড়েছে। এখন যে কটা দিন পারেন একটু গোপনে কাজ করে শেষে পুলিশে ধরা দিয়ে দেশে ফিরবেন। বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কাজটা তারা করেনি। ওটা একটা দুর্ঘটনামাত্র, যেমনটা ঘটে। কিন্তু মিজান কিছুতেই তা বিশ্বাস করছিল না, যেন মৃত প্রাণীগুলোর আত্মার ফরমান নিয়ে এসেছে। শেষে ওই শ্রমিকেরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ওকে মারধর করেছে, বেপরোয়া আর বেধড়কভাবে। ওরা না বললেও ব্যাপারটা অপরিষ্কার ছিল না। পরে মিজানকেই ডাকলাম। 

ডান হাতটা সোজা টানটান হয়ে দেয়াল ছুঁয়ে আঙুল দিয়ে খুঁট-খাট করছে। তার ওপর মাথাটা রাখা। বাম হাতটা মুখ-মাথাকে চাপ দিয়ে সোজা গিয়ে ডান হাতের তালুতে পড়েছে। মুখের ক্ষতর কারণে বাকিটা দেখা যাচ্ছিল না। ডাক শুনে করুণভাবে মুখটা তুলল।  ‘দেশে যেতে চাও? তোমার চিকিৎসাটা আবার শুরু করা হবে।’  শ্রমিকেরা আমার কথায় আশ্চর্য হচ্ছিল, অপ্রাসঙ্গিক বোধ থেকে।  ‘ডাক্তার বাড়ির সবাইকে ডেকে বলে দিয়েছে। যে বাঘটাকে কষ্ট করে দিনের পর দিন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম, তিনি সেটা সবার মধ্যে ছেড়ে দিয়েছেন। এটা সবাইকে কামড়ে দিবে ভেবে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মারতে চায়। আমি আর তার সামনে দাঁড়াতে পারব না।’  ‘যেভাবে কবিতা লিখে বসে আনতে।’  ‘ভেবেছিলাম, কবিতা লিখে বাঘটাকে বসে আনা যায়, সন্তানের হাসি দেখে অন্তত মৃত্যুর তাড়া থেকে বাঁচা যাবে। কবিতা তো ফুসফুস ভালো রাখে, কিন্তু বাঘটা যে রক্তে-হাড়ে-শিরা-উপশিরায় কামড় বসায়, অস্থির করে ফেলে। তাই সেই বন থেকে এই মরুতে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম, বালিতে হয়তো বাঘটা দৌড়ে পারবে না, পায়ের তল থেকে বালি সরে যাবে।’  শ্রমিকেরা আমাদের কথার মাথা-মুণ্ডু বুঝতে পারছিল না। কেবল শুনছিল, ছাই-ভস্মের ভেতর কিছু খোঁজার মতো বিরক্তি নিয়ে।  ‘আর তুহিন সাহেব?’  ‘ওরা একদিন এসে বই নিয়ে গেল। যা ওদের না, তা-ও।’ 

মিজান বুঝতে পারছিল, আমি খানিকটা জেনেই ওকে বলছি। একটু থেমে ও আবার বলল—‘আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতেই হতো। আমিও বেশি বেশি তুলে দিলাম। তারপরও ওরা আমাকে...’ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল মিজান। যেন শিশু। মুখের গভীর ক্ষত কাটা দাগে হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল। কদিন আগের মারধরে মুখে তৈরি হওয়া ক্ষত থেকে ব্যথায় ওর চোয়ালটা খোলার কথা ছিল না, কিন্তু ও তাকেও ছাড়িয়ে গেল।  ‘কিছুদিন সিসি ফুটেজের ভয় দেখিয়ে টাকা নিল। তারপর সেটাও ছড়িয়ে দিল। আর কী বাকি থাকল!’ 

দুই বছর আগে বাধ্যতামূলক দেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় মিজান আর দশে ফিরতে চায় না। তবে মালয়েশিয়া থেকে সমুদ্র পথে যাত্রা করতে চায়। কিন্তু সে যাত্রার উদ্দেশ্য কী, বলা যায় না। অনুশোচনায়, আক্ষেপে ওর জিবটা দুই পাটি দাঁতের চিপায় আটকে আছে, হিস্টিরিয়া আক্রান্ত কবুতরের মতো কেবল দাপাচ্ছে, ভেতরে-ভেতরে।  তুহিন সাহেব বই আনতে গিয়ে মিজানকে মারধরে কথা আমাকে জানায়নি। এমনকি টাকা আদায়ের কথাও না। হাজিরা খাতায় দেখেছি, সপ্তাহে চারদিন ও কাজে যায়। শ্রমিকেরা জানাল, সাপ্তাহিক ছুটি আর রান্নার পর আরেকটা দিনের হিসেব কেউ জানে না। কিন্তু এই উপার্জন দিয়ে প্রবাসে থাকা-খাওয়ায় প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তারপর যা থাকে তা বাড়িতে বোনদের কাছে পাঠিয়ে দেয় খাঁদটা ভরার জন্য, যে ভিটার প্রতি ওর কোনো আকর্ষণ নেই।  শ্রমিকেরা জানাল, বোনদের ছাড়ও অজ্ঞাত কোনো এক লোকের নামে কখনো কখনো টাকা পাঠাতে দেখেছে। লোকটা কে? কেউ বলতে পারে না। 

*** দেয়ালের পাশে ঠেস দিয়ে রাখা মাটির ভাঁড় ভেঙে পানিতে ঘর ভেসে যাওয়ার মতো বিস্ময় আর আক্ষেপ ভরে শুনছিল শ্রমিকেরা। চোখের তারায় টর্চ ধরা যে পথ দেখানো নয়, তখনো তাদের দেখার বাকি ছিল।  ‘কখনো সার্কাসে জীবন্ত মানুষকে বোর্ডে দাঁড় করিয়ে চাকু ছোড়া দেখেছেন?’  ‘হ্যাঁ’ ‘কখনো ওই বোর্ডে দাঁড়িয়েছে?’  ‘না।’  ‘কখনো ওই লোকের স্থানে নিজেকে কল্পনা করে দেখেছেন?’  আমি কোনো উত্তর না নিয়ে চুপ করে রইলাম।  ‘তাহলে বুঝবেন কী করে যে, আস্থা থাকার পরও অন্যের টার্গেটের মুখে নিজেকে সঁপে দিয়ে দাঁড়ানো কত কঠিন। খেলা শেষের অনেকক্ষণ পর লোকটার বোধ আসে। আপনার কাছে এটা দূরের মনে হতে পারে, আমি কাছ থেকে দেখেছি। সার্কাসে ত্রিফলা ছুড়তে দেখেছেন?’  ‘হ্যাঁ।’  ‘বাজিগরি দক্ষতায় ধারালো ত্রি-ফলা ওপরে ছুড়ে দেওয়ার উত্তেজনার পর প্রতিবার বুক পেতে দেওয়ার ক্লান্তি বুঝবেন খানিকটা। অন্যরা এসে তাঁকে মাটি থেকে তুলতে হয় ভরসার জন্য।’  ‘হুম।’  ‘সবচেয়ে ভেতরের ক্ষরণ হলো মার্জারের। জিবে কাঁটা ফুটিয়ে রক্তের অনিবার্য নোনতা স্বাদ তাকে কেমন অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। ক্ষতবিক্ষত হতে হতেও খসে পড়ার আগ পর্যন্ত তা চলাতেই হয়। এটা কোনো দাঁত ভাঙা সাপের সামনে সাপুরের মতো কৌশলী হাত দোলানো নয়, আকণ্ঠ বিষ তুলে নীল হওয়ার মতো বেদনার।’ 

অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ল মিজান, ছুড়ি ছোড়ার তক্তা থেকে, মাটিতে গাঁথা ত্রি-ফলার নিচ থেকে জাগিয়ে তোলাও কম কষ্টের নয়। প্রতিদিন পাশ দিয়ে যাওয়া দেয়ালের ভেতর প্রত্নতত্ত্ব খুঁজে পাওয়ার মতোই নিকট, আর অবজ্ঞার বিপরীতে বিদ্রূপের মতো।  শীতের কুয়াশায় চরের রাস্তা উধাও হয়ে যাওয়ার মতো নিঃস্পৃহতায় ছেয়ে গিয়েছিল ওর কথায়। তবু ওর কোমর ভাঙা বিড়ালের মতো হাঁচর-পাচর করে হলেও একটা প্রান্তসীমায় ওঠা দরকার ছিল আমার। 

ইঁদুর-বিড়ালের মৃত্যুর কারণের একটা চূড়ান্ত মীমাংসায় পৌঁছে গেছে মিজান, সত্য। ওর চোখের দিকে তাকিয়েই আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু আবাসনে ওকে নিয়ে সমস্যা চূড়ান্তে উঠেছে। কোনো ক্রমেই আর রাখা যাচ্ছিল না। আমারও ব্যস্ততা বেড়েছে। শ্রমিকদের মধ্যে কানাঘুষা তো আছেই। এ নিয়ে কথা শোনার দিন আর নেই।  মিজানকে বোঝানো হলো, দেশে কোনো কিছুই আগের মতো নেই। সব বদলেছে। ওকে সবাই স্বাভাবিক, আন্তরিকভাবে নেবে। ও সুস্থ হলে আমি গিয়ে দেখে আসব। ভেঙে পড়া বালির ঘরের ভেতর একটা পাটখড়ির কাঠামোর খুঁজে পাওয়ার মতো ভরসাটুকু সসংকোচে গ্রহণ করল, অনন্যোপায়ের মতো। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেল মিজানের পকেট একেবারেই কপর্দকশূন্য। আবাসনের শ্রমিকেরা অনুশোচনার শেষ সৌন্দর্যের মতো নিজেরাই টাকা-পয়সা উঠিয়ে ওকে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করেছিল। তারপর অনেক বুঝিয়ে ওকে বিমানে তুলে দেওয়া গেল। এয়ারপোর্টে মিজানের হাতে চিকিৎসক বন্ধুর ঠিকানা আর ফোন নাম্বার তুলে দিয়ে বললাম, অবশ্যই যেন দেখা করে। আর সময় সুযোগ হলে ওর চিকিৎসার খোঁজ-খবর নেব। একেবারে প্রচলিত চর্চার মতো কথাগুলো নিজের কানেই লাগছিল। বিদায়ের সময় অনেক প্রশ্নের মীমাংসিত বোধ পরিষ্কার করে দিয়েছিল ওর পানি ভরা চোখ।  ঘরের মেনি বিড়ালের বাচ্চার হুটোপুটি দেখতে যতই ভালো লাগুক, সংখ্যার বাড় বিস্তার হলে তাকেও দূরে ছেড়ে দেন গৃহস্থ। তারপর তাকে ভুলে যান। অস্বীকার করা সুযোগ ছিল না, মিজানের কথা আমরাও ভুলে গিয়ে ছিলাম। 

*** চার বছর পরে মিজানকে দেখেছিলাম ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়া মুখে, পুলিশ বক্সের সামনে। ও রাস্তার ওপারে। পুলিশ ওকে ঢুকতে দিচ্ছে না। রাস্তার এপাশ থেকে গাড়ির কাচ নামিয়ে ‘মিজান’ বলে চিৎকার করতেই ওর নজর পাওয়া গেল। কিন্তু ও রাস্তা পার হওয়ার আগ্রহ দেখাল না। শুধু আশ্বস্ত করার মতো হাতটা তুলে বোঝাল—সব ঠিকা আছে। সব উত্তর পেয়ে গেছে। তারপর ও ধাইধাই করে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু কিছুই ঠিক নেই। মলিন পোশাক। মাথাটা চুলের ভার মুক্ত হয়েছে ব্যথাতুর বৈচিত্র্যহীনভাবে। মুখের ক্ষতগুলো দূর থেকেও এড়ানোর যোগ্য নয়। গ্রামের কিছুই যে ওর অনুকূলে বদলায়নি, তা বোঝাই যায়। 

আমার বন্ধুর কাছে মিজানের চিকিৎসা-পত্তরের কী হয়েছে, তা ভাবাই বাহুল্য। ও চলে গেল আমাকে একটা গূঢ় কথা বলার সুযোগ না দিয়ে—আবাসনে ওর ইঁদুরটা এক শ্রমিককে দিয়ে আমিই মারিয়ে ছিলাম। পেটের ক্ষতটা নক প্লাস দিয়ে করা ছিল। তারপর বিড়ালটাকে মেরে বৈদ্যুতিক চুল্লির ওপর রাখার কাজটা আমার বুদ্ধিতেই হয়েছে। শুধু শ্রমিকেরা অতি উৎসাহে আঘাতটা বিড়ালের মাথায় লাগিয়ে ফেলায় নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়েছিল। এই কাজটা না করলে ওকে হয়তো আর কখনোই দেশে পাঠানো যেত না, এ-ই যা। ০