শিল্প ও সাহিত্য

হেলাল হাফিজ : অন্তহীন দুঃখের অক্ষরে লেখা নাম 

মৃত্যু অনিবার্য, অলঙ্ঘনীয় জীবন-বাস্তবতা। জীবনের শেষ পরিণাম মৃত্যু—এই সত্য জেনেও কোনো কোনো মৃত্যু মেনে নিতে পারি না আমরা। বিষাদ কবলিত হয়ে যায় আমাদের বর্তমান। তেমনই এক বিষাদময়তা ছড়িয়ে গত ১৩ ডিসেম্বর চিরদিনের জন্য চলে গেলেন বিপুল জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ (১৯৪৮-২০২৪)।

চির অভিমানী সেই নিঃসঙ্গ বাউল, সন্ত কবিকে কোনোদিন আর দেখবো না, কথা হবে না, শুনতে পাবো না তাঁকে আর—একথা ভেবে এই নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনটা বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। বিশেষ করে আমরা যারা তাঁকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী কাল আগে থেকেই চিনি, জানি, মিশেছি কবির সঙ্গে, তাদের জন্য কবি হেলাল হাফিজের প্রয়াণ স্বজন হারানোর গভীর ক্ষত হয়ে থাকবে বহুদিন। 

হেলাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৯ কিংবা ৮০ সালে। তিনি তখন সেগুনবাগিচা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘দেশ’-এর সাহিত্য সম্পাদক। প্রথম পরিচয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম তাঁর বিনম্র স্নিগ্ধ আচরণে। সবসময় ধীরে নিচু কণ্ঠে কথা বলতেন তিনি। রাজনৈতিক কোনো দলমতের বিরোধে জড়াননি কখনো। যে কারণে দলমত নির্বিশেষ সবাই তাঁকে ভালোবাসত; সকলের প্রিয় ছিলেন তিনি। আমার সঙ্গে সম্পর্কটা এমনই ছিল যে, ১৯৮১ সালে আমি সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে শয্যাশায়ী থাকা অবস্থায় তিনি মালিবাগে কুমকুমদের বাসায় আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন। সেই প্রথম তাঁকে নিবিড় করে বুঝবার কিছু সুযোগ হয়েছিল। 

ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা থাক, তাঁর কবিতার প্রসঙ্গে যাই। এমন বহু পাঠক আছেন, যারা হয়তো কখনো কবি হেলাল হাফিজকে দেখেননি কিন্তু তাঁর কবিতা পড়ে কিংবা আবৃত্তিজনের কণ্ঠে শুনে মুগ্ধ হয়েছেন। আমার ধারণা কবি হেলাল হাফিজের এমন ভক্ত পাঠকের সংখ্যাই বেশি। একজন কবির জন্য জীবদ্দশায় নিঃসন্দেহে এ এক পরম প্রাপ্তি! বাংলাদেশে হেলাল হাফিজের মতো ভাগ্যবান এমন কবির সংখ্যা দু’একজন যারা এত অল্প লিখেও এত বিপুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের আগে থেকেই তাঁকে চিনি সেই একটি কবিতার জন্য— ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামে সেই যে কালজয়ী কবিতা: ‘‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়...।’’

১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে যখন পূর্ব বাংলা উত্তাল হয়ে উঠেছে, আগরতলা মামলায় বিচারাধীন কারাবন্দি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে উত্তপ্ত সেই দিনগুলিতে তিনি রচনা করেছিলেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামের এই দুঃসাহসিক কবিতা। সেই প্রতিকূল সময়ে এই কবিতাটি সঙ্গত কারণেই কোনো পত্রিকায় তিনি ছাপাতে পারেননি। তাঁর এক সাক্ষাৎকার থেকে জেনেছি, সাহিত্যিক আহমদ ছফা এবং ঘাতকের হাতে নিহত অকালপ্রয়াত কবি হুমায়ুন কবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে কবিতার প্রথম দুটি লাইন উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন লেখক শিবিরের কর্মীদের মাধ্যমে। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর তথা স্বাধীনতার আগেই কবি হেলাল হাফিজ সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন দেশের মানুষের কাছে। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র বিপুল পাঠক-প্রিয়তার পর কবিকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। দিনদিন বেড়েছে তাঁর ভক্ত আর পাঠক সংখ্যা। 

বাংলাদেশের আবৃত্তি শিল্পীরাও হেলাল হাফিজের কবিতা যত উচ্চারণ করেছেন, মনে হয় নির্মলেন্দু গুণ ছাড়া আর কোনো কবির কবিতা এভাবে উচ্চারিত হয়নি। একটি মাত্র সাড়া জাগানো কবিতা লিখে সারা দেশের পাঠকের কাছে পৌঁছে যাওয়া— এ বড় সহজ কথা নয়! অনেক ভেবেছি, কী আছে হেলাল হাফিজের কবিতায় যে কারণে মানুষ এমন আসক্ত তাঁর কবিতার প্রতি! কবিতায় নানা রকম জিনিস থাকে, নানা উপকরণ থাকে। কোনো কোনো কবিতা বোঝার জন্য সামান্য চিন্তাও করতে হয় না, কবির সরাসরি বক্তব্য পাঠকের বা শ্রোতার মর্মলোকে পৌঁছে যায়। 

উচ্চকণ্ঠ রাজনৈতিক বক্তব্যও অনেক সময় মানুষের মুখে মুখে চলে যায়। কবিতার শৈল্পিক উৎকর্ষ বা নান্দনিকতা দিয়েও অনেক কবি বেশি জনপ্রিয় না হয়েও কালজয়ী হয়েছেন। আবার জগৎ ও জীবনের চিরন্তন সত্যকে কবিতায় সহজ ভাষায় তুলে ধরে কেউ কেউ মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি বাণী প্রধান কবিতা। অক্ষরবৃত্তের বিন্যাসে এই কবিতার যে বাণী তার আবেদন চিরন্তন। 

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিদের অনেকেই যুগে যুগে যৌবনের জয়গান গেয়েছেন। যৌবন মানব জীবনের এমন এক কাল পরিসর, এমন এক অসামান্য শক্তি, যার বন্দনা সভ্যতার সমান বয়সী। কবি হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ সেই শাশ্বত বাণীকেই ধারণ করেছে। আর সে কারণেই নন্দনতাত্ত্বিক সমস্ত ধারণাকে পেছনে ফেলে এই সহজ সরল উচ্চারণ চিরকালীন হয়ে উঠেছে অগণিত মানুষের কাছে। এ বাণী কবির সমকালে যেমন সত্য, ভাবি কালেও সমান সত্য হয়েই বেঁচে থাকবে।

যদিও কবিত্ব শক্তির মানদণ্ড কখনোই জনপ্রিয়তার নিরিখে হয় না। জীবদ্দশায় জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতাও জনপ্রিয় হয়নি; এমনকি তার সমসাময়িক কবিদের তুলনায় ছিলেন প্রায় অপরিচিত, উপেক্ষিত। মৃত্যুর পরে সেই জীবনানন্দ দাশ প্রতিভাবান গবেষক কবি বহুমাত্রিক লেখক বুদ্ধদেব বসুর মূল্যায়নে পুনর্জন্ম লাভ করেছেন তাঁর মরণোত্তর পাঠকদের কাছে। 

রবীন্দ্রনাথ অনেক দার্শনিক চেতনাখচিত গভীর কবিতা এমনকি সাংকেতিক কবিতাও লিখেছেন। সেগুলির নির্মাণকলা, বক্তব্য এবং শিল্পমূল্যেই শাশ্বত। ‘বলাকা’ কাব্যে সেই যে উচ্চারণ—‘‘পাহাড় হইতে চায় বৈশাখের নিরুদ্দিষ্ট মেঘ...।’’ এর বহুমাত্রিক অর্থ এবং চিত্রকল্পময় বয়ান আজো বাচ্যার্থকে ছাড়িয়ে ভাবার্থের বহুমাত্রিকতায় অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের একেবারে যে সহজ সরল একরৈখিক বক্তব্য প্রধান উচ্চারণ: ‘‘যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক/ তারা তো পারে না জানিতে/ তাহাদের চেয়ে তুমি কত কাছে/ আমার হৃদয় খানিতে...।’’ এই বাণীর চিরন্তনতা সারল্যকে ছাপিয়ে অসাধারণ ব্যঞ্জনায় কালোত্তীর্ণ হয়ে গেছে এবং আজও আমরা স্মরণ করি এ ধরনের পঙ্‌ক্তি। 

কিংবা কবি জসীমউদ্‌দীনের সেই যে মর্মস্পর্শী উচ্চারণ: ‘‘আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যে বা আমি বাঁধি তাঁর ঘর/ আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর...।’’ এ সরল আক্ষেপময় উচ্চারণ কিন্তু চিরকালের গভীর বেদনায় আমাদের অন্তর মথিত করেছে, করবেও অনাগত কাল ধরে। 

হেলাল হাফিজের কবিতার দিকে তাকালে অবাক হয়ে যাই এই ভেবে যে, ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতার যে জটিল বয়ন, চিত্রকল্প, প্রতীক আর বহুমাত্রিক অর্থ, ব্যঞ্জনার যে রহস্যময়তা তার ধারে-কাছেও না গিয়ে হেলাল হাফিজ প্রায় পদ্যের ভাষায় প্রেম আর বিরহের হাহাকারের আর্তনাদে যে কবিতামালা সৃষ্টি করেছেন, বিগত শতাব্দীর শেষ ষাট দশকের একজন কবির পক্ষে তা দুঃসাহসিক বৈকি! আরো সহজ করে বললে প্রতীক চিত্রকল্পের যে ব্যঞ্জনা কিংবা সাংকেতিক বক্তব্যের যে প্রবণতা বাংলা কবিতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে আছে, বিশেষ করে আমাদের প্রধান কবি আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, ফরহাদ মজহার, অকালে নিহত হুমায়ুন কবির থেকে শুরু করে সমসাময়িক আবিদ আনোয়ার, ময়ূখ চৌধুরী পর্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত কবিরা আধুনিকতার যে কালোয়াতি প্রতীকী কাব্য ভাষায় বুনেছেন, সেই কালোয়াতি হেলাল হাফিজের কবিতায় নেই। তাহলে কী আছে? এ প্রশ্ন করতেই পারেন যে কোনো পাঠক।

হেলাল হাফিজের কবিতায় আছে আবেগে উত্তাল হৃদয়ের এমন এক ফল্গুধারা যা পাঠককে সরাসরি স্পর্শ করে, সরল অর্থকে ছাপিয়ে প্রতীক চিত্রকল্পের আড়ালে থাকা ভাবার্থ অনুসন্ধানে পাঠককে ক্লান্ত করে না। কবিতা বোঝার জন্য সেই বিশেষ শ্রেণীর পাঠকেরও তাঁর দরকার হয় না, এই কবিতা একজন চির কুমার, বেদনামথিত, শিশু বয়সে মাতৃহারা নানারকম বঞ্চনার রিক্ত, স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় বিষণ্ন কবির সরাসরি বক্তব্যের কবিতা। এ কবিতা তাই সঙ্গত কারণেই হয়ে উঠেছে আমজনতার কবিতা। শোনামাত্র কবিতার অর্থ তাদের হৃদয়াঙ্গম হয়ে যায়। যেমন ‘প্রতিমা’ নামে কবিতার দুটো চরণ: ‘‘অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে/ মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল...।’’

বিশুদ্ধ অক্ষরবৃত্তের আঙ্গিকে সাজানো ‘প্রতিমা’ কবিতাটি চিরকালের একটি সত্যকেও তুলে ধরেছে। কোনো প্রতীক বা চিত্রকল্প নেই কিন্তু যা আছে তা কবিহৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ। 

তিনি যখন লেখেন: ‘‘আগামী তোমার হাতে/ আমার কবিতা যেন/ থাকে দুধে ভাতে।’’ তখন একজন স্বাপ্নিক কবির ভাবিকালের পাঠকের কাছে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে ওঠে। অনেকটা যেন ঈশ্বর পাটনীর কাছে স্বয়ং কবি ভারতচন্দ্রেরই সেই আবেদন: ‘‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’’ 

হেলাল হাফিজের কবিতা ভবিষ্যতের পাঠক কীভাবে মূল্যায়ন করবেন, সেটা ভবিষ্যৎ জানে কিন্তু সমকালের পাঠক যে তাঁকে এবং তাঁর কবিতাকে ভালোবেসে হৃদয়ের গভীরে ঠাঁই দিয়েছেন, এ সত্য মানতেই হবে। কবিতাকে তিনি সন্তান স্নেহে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন দুধভাত দিয়ে। এখানে দুধ ভাতের মধ্যে প্রতীকী ইশারা আছে। কবিতা দুধেভাতে বাঁচা মানে আগামীর পাঠকের কাছে যেন তাঁর কবিতার গ্রহণযোগ্যতা থাকে। আর ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর চেয়েছেন প্রকৃতই মানব সন্তানকে দুধে-ভাতে সুখী সমৃদ্ধ জীবনে বাঁচিয়ে রাখতে। 

১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিও হেলাল হাফিজের কবিতার বিষয় হয়েছে। এসেছে রণাঙ্গন আর মারণাস্ত্রের কথাও। এ  প্রসঙ্গে মনে পড়ে ‘দেশ’ টিভিতে আসাদুজ্জামান নূরকে দেওয়া কবি হেলাল হাফিজের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের কথা। সেখানে কবি অকপটে বলেছেন তাঁর একাত্তরের স্মৃতি। পঁচিশে মার্চ গণহত্যার রাতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে নিজের আবাসন ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল) থাকা হয়নি তাঁর। রাত কাটিয়েছিলেন ফজলুল হক হলে। নিজের হলে থাকলে নিশ্চিত মারা যেতেন। কারফিউ শেষে ইকবাল হলে ফিরে বহু লাশ দেখেছেন তিনি। নির্মলেন্দু গুণ তাঁকে ইকবাল হলে খুঁজতে এসেছিলেন বেঁচে আছেন কিনা। তাঁকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না দুজনের! 

তারপর ২৭ মার্চ নৌকায় বুড়িগঙ্গা পার হয়ে কেরানীগঞ্জ, কিছুদিনের জন্য বিক্রমপুরে চলে যাওয়া এবং আবার হানাদার কবলিত রাজধানীতে ফিরে উৎকণ্ঠায় দিনযাপন। আমি তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা ৭১’ ভেবেছিলাম তাঁর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণামূলক কবিতা। শিরোনাম দেখে পাঠক তাই ভাববেন। কিন্তু দেখা গেল ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র ৫৬টি এবং নতুন মাত্র ১৫টি কবিতা দিয়ে মোট ৭১টি কবিতার সংকলন বলে এ কাব্যের নামকরণ করা হয়েছে ‘কবিতা ৭১’। বইটি সাজানো হলেও আসলে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ছাড়া নতুন কবিতা এতই কম যে সেই নতুন কবিতা দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তিন বা চার ফর্মার কাব্যগ্রন্থ করা টানাপোড়েন হয়ে যায়।

শৈশব থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর জীবনব্যাপী যে চরম নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বের হতাশা, ব্যর্থ প্রেমের অমোচনীয় স্মৃতির হতাশা, ক্ষুধার্ত হৃদয়ের তৃষ্ণা এসব মিলিয়ে তাঁর কবিতা এক অনির্বাণ বিষাদের শিখা। এই বৃত্তটাই তিনি ভাঙতে পারেননি। নতুন কবিতা লেখার জন্য যে পরিবেশ, পঠনপাঠন— মনে হয় তাও পরিপূর্ণ তাঁর পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। যে কারণে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর কাব্যভাবনা। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র বিপুল জনপ্রিয়তা তাঁকে বিপুল আনন্দ দিয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু কবিকে আতঙ্কিতও করেছিল। সাক্ষাৎকারে  বলেছেন— নতুন কবিতা লিখতে ভয় হয়, এত জনপ্রিয় বইটিকে যদি ছাড়িয়ে না যেতে পারে, বা তার মানেরও না হয় আমার নতুন কবিতা, তাহলে লিখে কি হবে?

কবিতার আঙ্গিকের ক্ষেত্রে কবি হেলাল হাফিজ প্রধানত অক্ষরবৃত্ত এবং প্রবহমান মুক্তকে ছিলেন সচ্ছন্দ। স্বরবৃত্তেরও বেশ কিছু কবিতা আছে তাঁর। তবে কিছু কিছু কবিতা এক- দুই পঙ্‌ক্তির। কিন্তু খুবই অর্থবহ যা আমাদের চমকে দেয়! বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা তাঁর একটি প্রতীকী কবিতা আছে। কবি হেলাল হাফিজ নিজে না বললে বুঝতে পারতাম না এই কবিতাটি বঙ্গবন্ধুর বিশালত্বকে বোঝাতে লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা যেমন ‘খাটো কবিতা’ শিরোনামের এই কবিতাটি মাত্র ছোট ছোট চার লাইনের: ‘‘কে আছেন? দয়া করে আকাশকে/ একটু বলেন—/ সে সামান্য উপরে উঠুক,/ আমি দাঁড়াতে পারছি না।’’

এক লাইনের বিখ্যাত সেই কবিতার কোথাও মনে আসে এ মুহূর্তে: ‘‘নিউট্রন বোমা বোঝো,/ মানুষ বোঝ না!’’ বর্ণনাধর্মী কবিতার চেয়ে এই ধরনের চমকে দেওয়া কবিতাই হেলাল হাফিজকে ভিন্নতা দেয়। 

‘কবি ও কবিতা’ শিরোনামের কবিতাটিতে তিনি যখন লেখেন: ‘‘কবির জীবন খেয়ে জীবন ধারণ করে/ কবি তবু সযত্নে কবিতাকে লালন করেন,/ যেমন যত্নে রাখে তীর জেনেশুনে জল/ ভয়াল নদীর।’’

সর্বভুক এ কবিতা কবির ‘‘প্রভাত খায়,/ দুপুর, সন্ধ্যা খায়, অবশেষে/ নিশীথে তাকায় যেন বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরী/কবিকে মাতাল করে/ শুরু হয় চারু তোলপাড়।’’ কবিতা এবং প্রেম তার জীবনটাকে যে কুরে কুরে খেয়েছে, সে কথা বিভিন্ন কবিতায় তিনি সরাসরি বলেছেন।

কবিতা, মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম এবং সেই প্রেমের কঠিন বিরহ তাঁর কবিতার এই তিন অনুষঙ্গই  তাঁর কবিতায় বারংবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ শিরোনামের কবিতায় তিনি লিখেছেন: ‘‘দুঃখ তো আমার সেই জন্ম থেকে জীবনের/ একমাত্র মৌলিক কাহিনী!/ আমার শৈশব বলে কিছু নেই/ আমার কৈশোর বলে কিছু নেই/ আছে শুধু বিষাদের গহীন বিস্তার।/ ...দুঃখ তো আমার হাত, হাতের আঙ্গুল—আঙ্গুলের নখ/ দুঃখের নিখুঁত চিত্র এ কবির আপাদমস্তক।’’

এই আত্মস্বীকৃতিমূলক বিবরণের মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই কবির জীবনব্যাপী দুঃখের মর্মস্পর্শী চিত্র। আরেকটি কবিতা এত সরাসরি লিখেছেন ‘দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ!’ সম্ভবত কবিতাটির শিরোনাম ‘তাবিজ’। 

অকাল প্রয়াত কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন: ‘‘দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাদি রাখবো না আমার ভিতরে।’’ হেলাল হাফিজের ক্ষেত্রেও এ কথা সমান সত্য। তিনি দুঃখের ফেরিওয়ালা হয়ে কবিতায় এক জনমের গভীর দুঃখ ফেরি করেছেন। নানা রকম কষ্টের কথা তিনি তাঁর কবিতায় বলেছেন। মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে সেই কষ্টগাথা।

‘অচল পদ্য’ শিরোনামের একটি সিরিজ কবিতামালা তিনি রচনা করেছিলেন। দুই লাইন, চার লাইনের ছোট ছোট পদ্যধর্মী সেই কবিতার শিরোনাম ছিল ১. ২. ক্রমিক নাম্বার দিয়ে। ৪. নম্বর অচল পদ্যটির উদ্ধৃতি দিই: ‘‘ভালোবেসেই নাম দিয়েছি তনা/ মন না দিলে ছোবল দিও/ তুলে বিষের ফণা।’’

কবি হেলাল হাফিজ তাঁর অধিকাংশ কবিতাই লিখেছেন ১৯৭২ থেকে ৮০-৮১ পর্যন্ত। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বাকি প্রায় ৪ দশকে তিনি খুব সামান্য কবিতাই লিখেছেন। তাই তিনটি বই পাশাপাশি মিলিয়ে পড়লে অনেক পুনরাবৃত্তি চোখে পড়বে। সব মিলিয়ে তিনি লিখেছিলেন আসলে এক অবিচ্ছিন্ন বিষাদগাথা। সেই বিশাদগাথা এমনই মর্মস্পর্শী যে, তা কবির অন্তরের কান্না পাঠককেও সংক্রমিত করেছে। শৈশবে মাতৃহারা কৈশোরের নিঃসঙ্গতা আর যৌবনের গভীর প্রেমের বিরহ কবির গোটা জীবনটাকেই যেন তছনছ করে দিয়েছে। যে কারণে আমৃত্যু অকৃতদার এবং স্বেচ্ছা নিঃসঙ্গতা বেছে নিয়ে নিজের অন্তরের গভীর বেদনাবোধ থেকে একের পর এক উচ্চারণ করেছেন প্রেমের শোকগাথা, স্বপ্নভঙ্গের বিপন্ন উচ্চারণ। ১৯৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত ব্যর্থ প্রেমের আর্তনাদ এত তীব্র ভাষায় তিনি উচ্চারণ করেছেন, যা সত্যিকারের প্রেমিক ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। বারবার প্রেমে পড়েছেন একথাও সত্য, আবার বারবার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। স্বজন পরিজন থেকে দূরে একাকীত্ব বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছায়। দিনমান প্রেসক্লাবে আর হোটেলে কেটেছে তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময়। দুঃখের গভীরতা মেপেছেন যেন নিজের জীবন দিয়েই!

ইতিহাসের অমর হেলেনের কারণে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল, এই কিংবদন্তির মতো প্রেমকাহিনি আমরা জানি। কিন্তু কবি হেলাল হাফিজ জানি না কোন হেলেনের প্রেমের ছোবলে নীল হয়েছিলেন, যাকে তিনি কবিতায় বারবার উচ্চারণ করেছেন গভীর বিষাদে, অভিমানে, কখনো বা ক্রোধে- ক্ষোভে!

১৯৭৩ সালে লেখা ‘ইচ্ছে ছিলো’ কবিতাটি যেন না পাওয়া হেলেনেরই হাহাকারে বিদীর্ণ! ইচ্ছে ছিল সফল প্রেমের স্বপ্নের সাম্রাজ্যে প্রেমিকাকে সম্রাজ্ঞী করবেন, রাজত্ব করবেন প্রেমের সিংহাসনে বসে, কিন্তু তা হয়নি, প্রেমিকা সাম্রাজ্য সাজিয়েছেন অন্য কোনো সম্রাটকে নিয়ে। এই বেদনা নানাভাবে উচ্চারিত হয়েছে হেলাল হাফিজের কবিতায়। 

কার কবিতায় পড়েছিলাম মনে নেই, অন্তত ৪৪-৪৫ বছর আগে— ‘‘তোমাকে পাইনি আমি এই কথা লিখে দেবো দেয়ালে দেয়ালে!’’ হেলাল হাফিজ তাঁর কাঙ্ক্ষিতাকে না পাওয়ার বেদনা, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা দেয়ালে লেখেননি, লিখেছেন কবিতার পাতায় পাতায়, রক্তাক্ত হৃদয়ের সুনীল খাতায়। ইহজনমে এতটুকু সুখ পাননি যে চিরবিরহে দগ্ধ প্রেমিক—সেই কবিকে স্রষ্টা পরলোকে সুখে রাখুন, শান্তিতে রাখুন।