মারুফ রায়হানআমাদের সমাজে কিংবদন্তি হয়ে আছেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। ‘জ্ঞানতাপস’ অভিধাটি তাঁর নামের পাশে স্থায়ীভাবে সেঁটে বসে আছে। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর অসাধারণত্ব রয়েছে নিশ্চয়ই, তবে একটি ব্যাপারে সম্ভবত তিনি বিরাট ব্যতিক্রম। জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মান জানানো হয়েছে তাঁকে। ‘জাতীয় পড়ুয়া’ বলে জাতীয় পর্যায়ের কোনো সম্মাননা প্রতিষ্ঠিত থাকলে এর সব চেয়ে উপযুক্ত দাবীদার হতেন তিনিই। একটা জীবন কেবল বই পড়েই কাটিয়ে দেয়া- আজকের দিনে আর ভাবাই যায় না। সমাজে পাঠপ্রবণতা কমে গেছে, নাকি সেভাবে গড়েই ওঠেনি তা নিয়ে বিতর্ক হওয়া সম্ভব।তাঁকে বলতে পারি নিভৃত নিমগ্ন শিখা। আজকের বুদ্ধিজীবীদের মতো মঞ্চ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখার কৌশলটি তিনি পরিহার করেছিলেন। থাকতেন নিজের বলয়ে, নিঃসঙ্গই বলা যায়। তাঁর জ্ঞানের শিখায় আলোকিত হওয়ার জন্যে সমাজের বিশেষ জ্ঞানপ্রাপ্তদের যেতে হতো তাঁরই কাছে। যদিও তাঁকে কেন্দ্র করে কোনো বুদ্ধিজীবীতার বৃত্ত প্রতিষ্ঠিত হোক- এমনটা সচেতনভাবে চাইতেন না বলেই ধারণা করি। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক যেহেতু একেবারেই কম লিখেছেন, [তাঁর একমাত্র গ্রন্থ বাংলাদেশ : জাতির অবস্থা (Bangladesh : State of the Nation)] তাই তাঁর শিষ্য ও সতীর্থদের স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ন এবং তাঁর কয়েকটি আলাপচারিতাই বারবার আলোচিত হয়। সেসব পাঠ ও বিশ্লেষণ করে ব্যক্তি মানুষটাকেই উত্তমরূপে চেনা যায়। এই চেনার ভেতর দিয়ে তাঁর ‘বাংলার সক্রেটিস’ অভিধাটি মজবুত হয়ে ওঠে। এই গুণীজনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র (আবুল খায়ের লিটু) পরিচালিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল পাবলিকেশন্স’ থেকে যে ঢাউশ স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, তাতে বাংলাদেশের বিশিষ্ট বহু লেখক উদারভাবেই অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রতিকৃতি নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছেন। আহমদ ছফা তাকে নিয়ে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ নামে একটি বই রচনা করেছেন। সরদার ফজলুল করিম তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতার ভিত্তিতে রচনা করেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ : অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা।’ সমাজচিন্তাবিদ ও দার্শনিক হিসেবে প্রয়াত ওই দুই লেখক যথেষ্ট খ্যাতিমান ছিলেন। উভয়েই তাঁদের জীবনশিক্ষক হিসেবে আব্দুর রাজ্জাককে দারুণ এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। অসামান্য লেখক হুমায়ুন আজাদ তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ব্যক্তি আব্দুর রাজ্জাকের অন্তর অবলোকনের জন্য সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। হুমায়ুন আজাদ তাঁকে উস্কে দিতে চেয়েছিলেন ‘আমার কাছে বাঙলাদেশের সমাজকে নষ্ট সমাজ ব’লে মনে হয়। আপনার কেমন মনে হয়’ এমন একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। আবদুর রাজ্জাক যে জবাব দেন তাতে তাঁর ইতিবাচক মানসিকতাটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘আমি এর সঙ্গে একেবারেই একমত নই। বরং আমার কাছে এই এলাকাটিকেই সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল এলাকা ব’লে মনে হয়। বাঙলাদেশে ছোটো থেকে বড় হওয়ার, তুচ্ছ অবস্থা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার যে-সুযোগ রয়েছে, তা এই উপমহাদেশের আর কোথাও নাই। শুধু উপমহাদেশে কেনো, সারা পৃথিবীতেও নাই।’ মাতৃভূমির মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার ক্ষেত্রেও তাই পরম শিক্ষক হয়ে আছেন এই জীবনবাদী।পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও একাডেমিক তকমা অর্জনের ক্ষেত্রে তাঁর স্বচ্ছতা তুলে ধরতে গিয়ে একটি উদাহরণ বেশ দেয়া হয়। সেটি হলো তিনি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে পিএইচডি করার জন্যে লন্ডন গমন করেন; তবে লাস্কি পরলোকগমন করায় তাঁর থিসিসি মূল্যায়ন করার মতো কেউ নেই এই বিবেচনায় তিনি থিসিস জমা না-দিয়েই (অর্থাৎ কোনো ডিগ্রী ছাড়াই) দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আরেকটি গল্পও ওঠে তাঁকে নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আড্ডায়। সেটি হলো তাঁর নিজের হাতে বাজার ও রান্না করা। নিয়মিত বাজার করা শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর। রান্না তিনি শিখেছিলেন শৈশবেই। তিনি বলতেন, ‘আমি যে-কোন দেশে গেলেই দুটি জিনিস দেখি, একটা কাঁচাবাজার, অন্যটা বইয়ের দোকান। আমার মনে হয় কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান সম্ভবত সমাজের অবস্থার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নির্দেশক। যে-দেশে বইয়ের দোকান নাই সে-দেশে লেখাপড়া খুব হয় তা বিশ্বাস করি না। কাঁচাবাজার দেখলেই বোঝা যায় দেশের অবস্থা কেমন। বইয়ের দোকানে গিয়ে কী ধরনের বই পাওয়া যায়, কেমন বিক্রি হয়, তা দেখেই দেশের জ্ঞানচর্চার অবস্থা বোঝা যায়। একবার তুরস্কে গিয়েছিলাম। সেখানে বইয়ের দোকানে শতকরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা বই কম্যুনিজম সম্পর্কে, শতকরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা বই ইসলাম সম্পর্কে। সুতরাং ওই দেশে যে টেনশন থাকবে তা বোঝার জন্য হাফেজ হওয়ার দরকার নাই।’অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া- একথা একটুও বাড়িয়ে বলা নয়। তাঁর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মৃতি বক্তৃতায় বক্তারা বলেছিলেন, তাঁর সংস্পর্শে শিক্ষার্থীদের জানার ইচ্ছা বেড়ে যেত। এ যুগের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শেখান কীভাবে পরীক্ষায় পাস করে বেশি নম্বর পেতে হবে, তিনি শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহকে বাড়িয়ে দিতেন। তাঁর জানাশোনার পরিধি ছিল সুবিশাল। তাঁর মধ্যে তীব্র সমাজ সচেতনতা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সামাজিক জাগরণের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। তাঁর খ্যাতি দেশের সীমারেখা পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশ-বিদেশ থেকে বহু শিক্ষার্থী, গবেষক ও জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তি তাঁর কাছে আসতেন। আব্দুর রাজ্জাক প্রয়াত হন ১৯৯৯ সালে। এখনও আমার চোখে ভাসে তাঁর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক মরদেহবাহী সেই গাড়িতে সারাক্ষণ ছিলেন। সেসময় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ডিজি ছিলেন তিনি। সেখানে কাজ করার সুবাদে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের দীর্ঘ কথোপকথনের ভিডিও দেখার সৌভাগ্য হয় আমার। সম্ভবত ওই ফুটেজটি পরে আর সম্পাদনা করে প্রদর্শনযোগ্য করা হয়নি। কারণ এ নিয়ে কোনো খবর পরে আর চোখে পড়েনি। ওই ফুটেজটির প্রামাণ্য মূল্য রয়েছে। সেখানে আব্দুর রাজ্জাককেও পাওয়া গেছে খুবই ঘরোয়া ভঙ্গিতে খোশমেজাজে। তাঁর প্রয়াণের প্রথম বার্ষিকীতে চ্যানেল আইয়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ নিই। বেঙ্গল থেকেই তাঁর তেলরঙে আঁকা বিরাটাকৃতির প্রতিকৃতিটি স্টুডিওতে নিয়ে আসা হয় মঞ্চসজ্জার প্রয়োজনে। বরেণ্য লেখক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সে অনুষ্ঠানে অনেক কথাই তুলে ধরেন যার প্রামাণ্য মূল্যও অপরিসীম বলে মনে করি। জানি না সেটা আর্কাইভে আছে কিনা। মূলত সে সময় থেকেই আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের প্রস্তুতি শুরু হয়। যদিও সেটি বই হয়ে বেরুতে প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় লেগে যায়। বাংলাদেশের জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে বাস্তবিকই আব্দুর রাজ্জাক ব্যতিক্রমী নিভৃত শিখা হয়ে রইবেন। শুধু আফসোস ভবিষ্যত প্রজন্ম সেই শিখায় যথাযথভাবে আলোকিত হওয়ার সুযোগ লাভে বঞ্চিত হলো। যত অক্ষর তিনি পাঠ করেছেন জীবনভর, তার অতি সামান্য অংশও যদি তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন তাহলে মনীষা ও প্রজ্ঞায় অতি প্রাগ্রসর কিছু অমূল্য গ্রন্থ পেত জাতি।marufraihan71@gmail.comরাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জানুয়ারি ২০১৫/তাপস রায়