বুদিয়া মাঈশ্বর। মাথায় চুল নেই, পড়ে গেছে। কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। কুচকে গেছে শরীরের চামড়াও। দেখে মনে হয়, বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই বা তার বেশি।
এই শীতে ছেঁড়া শাড়ি আর চটের বস্তা গায়ে জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকেন।
কারো সঙ্গে কথা বলেন না। নেই কোনো আবদারও। যার তার দেয়া কোনো কিছুও তিনি নেন না। ক্ষুধা লাগলে পছন্দসই কারো নিকট থেকে সামান্য নেন তিনি।
বলছিলাম নওগাঁ জেলার ধামইরহাটের এক ছিন্নমূল প্রবীণ নারী বুদিয়া মাঈশ্বরের কথা। তিনি ঠিক কবে, কখন এই এলাকায় আসেন তা সঠিক করে কেউ বলতে পারেন না। বুদিয়া নিজেও তার ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে পারেন না। হয়তো জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এসব ভুলেই গেছেন। বা ইচ্ছে করেই এসব আর কাউকে বলেন না।
জানা যায়, ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে উপজেলার পূর্ব বাজারে খোলা আকাশের নিচে ছিন্নমূল মানুষের মত জীবন যাপন করছেন বুদিয়া। ছেলেমেয়ে, স্বামী সংসার কোথায় কি অবস্থায় আছে এসব বলতে পারেন না তিনি। আনমনে নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলেন। বলতে গেলে তিনি এক প্রকার মানসিক প্রতিবন্ধী নারী।
এলাকার ইলেকট্রিশিয়ান শ্রী রাজেন রাইজিংবিডিকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে তিনি তার দোকানের পাশে থাকেন। সে কারণেই মাঝে মাঝে বুদিয়ার সঙ্গে তার কথা হয়। একবার নাম, ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, নাম বুদিয়া মাঈশ্বর, স্বামী হরিপদ, ভারতের বালুরঘাট জেলার তপন থানায় তার বাস। তিন মেয়ে শিমুল, পারুল আরেকজনের নাম বলতে পারেননা। পথ ভুল করে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়লে নিজদেশে (ভারতে) আর ফিরে যেতে পারেননি। প্রায় ৩০ বছর ধরে তাকে এখানে বসবাস করতে দেখা যায়। তিনি সন্তান স্বামীর কাছে যেনো ফিরে যেতে পারেন সে ব্যাপারে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
ধামইরহাট বাজারের কীটনাশক ব্যবসায়ী মামুনুর রশিদ বলেন, ‘কেউ চাইলেও তাকে এক টাকাও দিতে পারবেন না। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন তিনি। সরকারিভাবে বিভিন্ন শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও সেগুলো শুধু ফটোসেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। একারণে ফুটপাতে জীবন ধারণ করা ছিন্নমূল গৃহহীন মানুষের কাছে শীতবস্ত্র থেকে শুরু করে সরকারের দেয়া কোন অনুদানই পৌঁছায় না। ছিন্নমূল এসব মানুষের জন্য সরকারের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। এছাড়া আমার মনে হয়, তিনি মানসিক দিক দিয়ে অসুস্থ। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত।’
এলাকার বাসিন্দা জিয়াউল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘জয়জয়পুর আদিবাসী গ্রাম থেকে তাকে মাঝে মাঝে চাল সংগ্রহ করতে দেখা যায়। আমি যতটুকু দেখেছি তিনি যাকে পছন্দ করেন তার কাছ থেকেই শুধু সাহায্য গ্রহণ করেন। অন্য কেউ কিছু দিতে চাইলে গ্রহণ করেন না।’
চায়ের দোকানদার রেজাউল করিম বুদিয়া সম্পর্কে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘তার খুব বেশি চাহিদা নেই। আমার দোকানে আসা যাওয়া তার একটা রুটিনে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সকাল আর দুপুরে এসে এক কাপ চা আর একটি বিস্কুট আর এক পান নেন তিনি। রাতে দুধের সঙ্গে এক রুটি দিয়ে থাকি।’
উপজেলার ২ নম্বর পৌর ওয়ার্ড কমিশনার মুক্তাদিরুল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া শীতবস্ত্র আমরা দুস্থ মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বিতরণ করছি। রাস্তায় জীবন ধারণ করা দু’একজন হতদরিদ্র মানুষের কাছে হয়তবা আমরা শীতবস্ত্র পৌঁছে দিতে পারিনি সে কারণে দুঃখ প্রকাশ করছি।’
ধামইরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান আজাহার আলী রাইজিংবিডিকে জানান, প্রকৃত দুস্থ মানুষের কাছে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া শীতবস্ত্র পৌঁছে দেবার জন্য উপজেলা প্রশাসন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বৃদ্ধা বুদিয়া মাঈশ্বরের ব্যাপারে আমরা খোঁজখবর রাখছি। তিনি যেন তার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারেন আমরা তার ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
উপজেলা কর্মকর্তা গণপতি রায় রাইজিংবিডিকে জানান, সরকারের দেয়া শীতবস্ত্র চেয়ারম্যান মেম্বার এবং ওয়ার্ড কমিশনারের মাধ্যমে দুস্থ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়ে থাকে, তাছাড়া নিজ উদ্যোগেও বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দুস্থ মানুষের কাছে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে।
তবে, রাস্তায় রাত্রি যাপন করা অসহায় মানুষের তালিকা হয়নি। তালিকা পেলে তাদের মাঝে শীতবস্ত্র পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। বৃদ্ধা বুদিয়া মাঈশ্বরের তথ্য আমরা সংগ্রহ করছি। তিনি তার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারেন, সে ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
নওগাঁ(ধামইরহাট)/বুলাকী