চাঁদপুরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভগুলো স্বাধীনতার এতো বছর পরেও অযত্মে অবহেলায় রয়েছে। সচেতনতার অভাবে এগুলো অযত্মে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল ‘বড়স্টেশন’ ছিলো পাক বাহিনীর অন্যতম ‘টর্চার সেল’। রাজাকারদের সহযোগিতায় অগণিত বাঙ্গালীকে এখানে এনে নির্যাতন করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলো পাক-বাহিনী। এই বধ্যভূমিতে ‘রক্তধারা’ নামের এক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ছাড়া আর কোনো স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়নি।
অপরদিকে, মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুরে শহীদদের স্মরণে জেলা শহরের লেকের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ভাসমান স্মৃতিস্তম্ভ ‘অঙ্গীকার’। বোমা বানাতে গিয়ে চাঁদপুরের প্রথম চার শহীদের স্মরণে নির্মিত হয় ‘মুক্তিসৌধ’। সকল শহীদদের স্মরণে শহরের পাঁচ রাস্তার মোড় কালীবাড়িতে নির্মাণ করা হয় ‘শপথ ফোয়ারা’। এসব স্মৃতিস্তম্ভ অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বুধবার (২০ জানুয়ারি) সরেজমিনে শহরের বড়স্টেশন এর রক্তধারায় গিয়ে দেখা যায়, এটির ওপরে মুরগিকে খাওয়ানো হচ্ছে। একই হাল শহরের লেকের পাড়ের অঙ্গীকার পাদদেশে। সেটির ওপর নানান কুৎসিত লেখা ও বেশ কিছু স্থানে আস্তর খুলে খুলে পড়ছে। দেশ স্বাধীনের পঞ্চাশ বছরেও চাঁদপুরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমি ও গণকরব সংরক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
তাদের মতে, ৭১ এ নির্যাতনের স্থান ও বধ্যভূমিগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করায় নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছে সেসব দিনের ইতিহাস। জেলায় কয়টি গণকবর বা বধ্যভূমি রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই।
তবে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলার তালিকায় ১৮ থেকে ২০টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ রয়েছে। যার মধ্যে জেলা সদরের ছোটসুন্দর, বাগাদী, দাসাদী ও শিলন্দিয়া গ্রাম, ফরিদগঞ্জের কাদলা, আহমদনগর, কচুয়ার সাচার, গৃদকালিন্দিয়া, বড়কুল, রায়শ্রী, বড়স্টেশন, কাসিমপুর, দত্রা, চরভাগল, রঘুনাথপুর, লাওকরা, রহিমানগর, রসুলপুর ও এনায়েতনগর এলাকায় হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালানোর তথ্য রয়েছে।
এসব ব্যপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. বিনয় ভূষণ মজুমদার জানান, স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ না করায় তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। চাঁদপুরের যেসব স্থানে বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে, সরকার যেন তা ভালোভাবে তদন্ত করে শহীদদের স্মৃতির স্মরণে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়। না হলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের আত্মত্যাগ আর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানবে না।
বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত সাহা জানান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে জেলার বিভিন্ন স্থানে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভগুলোও অযত্ন-অবহেলায় রয়েছে। এমন হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চাঁদপুর জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি শাহানারা বেগম জানান, চাঁদপুরের বিভিন্নস্থানে বধ্যভূমি চিহ্নিত করার পাশাপাশি যুদ্ধে যারা প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের পরিচয় শনাক্ত করে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের কাছে স্মৃতি সংরক্ষণ করা জরুরি। এগুলো এখনই সংরক্ষণ না করতে পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলে যাবে।
এ ব্যপারে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ ওয়াদুদ জানান, তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও ইতিহাস সংরক্ষণের জোড় দাবি জানাচ্ছি।
এসব ব্যপারে চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো বহন করা বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের জন্য সরকার খুবই আন্তরিক। এর মধ্যে বড়স্টেশনে বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ ‘রক্তধারা’ নির্মাণ করা হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আরও জানান, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও এলজিইডি থেকে আমাদের কাছে বধ্যভূমির তালিকা চেয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা জেলায় ১৮ থেকে ২০টি বধ্যভূমি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা সংরক্ষণ করা হবে। বধ্যভূমি সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি স্মৃতিস্তম্ভগুলোও যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।