স্বামী মইরা গেছে ৪ বছর হইল। ছয়াল, মাইয়্যা বিয়ে দিয়া দিছি। বিয়ার পর ছয়াল ঢাহা থাহে। আমারে আর এহন দ্যাহে না। তাই পরের বাড়িতে কাজ কইরা খাই। করোনা আইস্যা তাও বন্ধ হইয়া গ্যালো। রোজা চলতাছে। এহন আর বাসি-পান্তা দিয়া ইফতার করন লাগে না।
এক প্যাকেট ইফতার নিতে এসে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন, ৬৫ বছরের বৃদ্ধা মজিরন বেগম। স্বামী মারা যারার পরই ছেলে-মেয়ে তাকে এখন দেখে না। কারোনাকালীন আয় রোজগার না থাকায় চেয়ে চিন্তে দিন চলছে তার।
কারোনাকালীন এক বেলার ইফতার নিয়ে এমন সব মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ফেসবুকভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘প্রজ্জ্বলিত গোপালগঞ্জ’। প্রতিদিন কর্মহীন মানুষের মাঝে রান্না করা ইফতার বিতরণ করছে তারা।
সরকার ঘোষিত লকডাউনে কর্মহীন হয়েছে পড়েছে গোপালগঞ্জের খেটে খাওয়া অসংখ্য মানুষে। কাজ না থাকায় এসব নিম্ন আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছেন। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। ফলে আর্থিক অনটনের কারণে রমজানে ইফতার করতে পরিবার নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
গোপালগঞ্জে শহরের মডেল স্কুল রোডের ‘প্রজ্জলিত গোপালগঞ্জ’ এর অস্থায়ী কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন বিকাল থেকে ইফতার তৈরির কাজ শুরু করে ‘প্রজ্জলিত গোপালগঞ্জ’ এর একদল সদস্য। এরমধ্যে কেউ বা স্কুল আবার কেউ বা পড়ছে কলেজে।
এসব সদস্যরা নিজেদের হাত খরচ, পরিবার আর পরিচিতজনদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে প্রতিদিন দেড় শতাধিক মানুষের মুখে এক বেলা খাবার তুলে দিচ্ছেন। এসব রান্না করা খাবারে কোনদিন রয়েছে খিচুড়ি আবার কোনদিন রয়েছে বিরিয়ানি। যেদিন যেমন আর্থিক সাহায্য পান সেই সেইরকমই খাবার তৈরি করেন তারা।
পরে ইফতারের আগে জেলা শহরের লঞ্চঘাট, ডিসি রোড, চৌরঙ্গীসহ বিভিন্ন সড়কে ঘুরে ঘুরে অসহায় মানুষের মাঝে এসব খাবার বিতরণ করেছে। এছাড়া হাসপাতালে রোগী, তাদের স্বজসহ বিভিন্ন মাদ্রসায়ও ইফতার সরবরাহ করেছেন।
‘প্রজ্জলিত গোপালগঞ্জ’-এর সদস্যরা খাবার দিতে এলেই সেখানে ভিড় করেন অসহায় মানুষেরা। পরে তাদের হাতে খাবার তুলে দেন সদস্যরা।
কোটালীপাড়া উপজেলার চিত্রাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রিকশাচালক মো. চুন্নু শেখ (৪৫) বলেন, ‘সংসারে তিন ছেলে, স্ত্রী ও মা-বাবা রয়েছে। লকডাউনের আগে প্রতিদিন ৭’শ থেকে ৮’শ টাকা রোজগার করতাম। এতে কোনো রকমে দিন চালিয়ে নিতাম। কিন্তু লকডাউনের কারণে এখন মাত্র দুই’শ থেকে তিন’শ টাকা রোজগার হয়। এতে রিকশা ভাড়া দিয়ে ৭ সদস্যের পরিবারের ইফতার কিনতে পারি না। এখান থেকে প্রতিদিন ইফতার নিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ইফতার করছি।
অপর রিকশাচালক হামিম কাজী, ওহিদ শেখ বলেন, লকডাউনের কারণে তেমন একটা আয় রোজগার নেই। পরিবারের জন্য ভাল কোনো ইফতার কিনতেও পারি না। প্রতিদিন চলতি পথে এনাদের থেকে ইফতার নিয়ে যাই।
ফেসবুকভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘প্রজ্জলিত গোপালগঞ্জ’-এর সদস্য শাওন রাজীব, শীরিন আক্তার তানহা বলেন, ‘লকডাউনের কারনে অনেক দু:স্থ, আসহায় গরীব মানুষ আর্থিক সমস্যার কারণে ঠিকমত ইফতার করতে পারছে না। আমরা তাদের কথা বিবেচনা করে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী রান্না করা ইফতার বিতরণ করছি। প্রতিদিন অন্তত দেড় শতাধিক মানুষের মাঝে এসব খাবার বিতরণ করে থাকি।’
সংগঠনের অপর সদস্য রেজওয়ান আহম্মেদ চৌধুরী, রওনক আমিন ঐশি বলেন, ‘আমরা নিজেদের হাত খরচ, পরিবার ও প্রতিবেশি এবং পরিচিত জনদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে এসব খাবার বিতরণ করছি। নিজেদের মনের আনন্দ পেতে কষ্ট হলেও কিছুটা করার চেষ্ঠা করছি। বৃত্তবানদের কাছে আমাদের আবেদন তারা যেন এসব অসহায় মানুষদের দিকে একটু সাহায়্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।’
ফেসবুকভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘প্রজ্জলিত গোপালগঞ্জ’-এর পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম রানা বলেন, ‘কারোনা সময় থেকেই মাঠে রয়েছে ‘প্রজ্জলিত গোপালগঞ্জ’-এর সমস্যরা। গত বছর করোনা ভাইরাস রোধে ও সাধারণ মানুষেকে সচেতন করতে মাস্ক বিতরণসহ সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়েছি। এবার রোজায় কর্মহীন মানুষের মুখে একবেলা ইফতার তুলে দিতে চেষ্ঠা করে যাচ্ছি। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী রান্না করা ইফতার এসব মানুষেদের হাতে তুলে দিচ্ছি। যাতে তারা অন্তত এক বেলা পেট ভরে খাবার খেতে পারে।’
পরিচালক জানান, সমাজের বিত্তবানেরও এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন। তারা আর্থিক বা বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে এসব মানুষের এক বেলার খাবার যোগাতে পারেন। তারপরেও যতটুকু সম্ভব পুরো রমজান মাস ধরে আমাদের এ কার্যক্রম চলবে। কর্মহীন মানুষের মুখে একবেলা খাবার তুলে দিতে এগিয়ে আসবে সমাজের বিত্তবানের এমনটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।