বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার-আলবদরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করেছিলো ২৫ মার্চের কাল রাত থেকে।
সেই থেকেই বাংলাদেশের একেকটি জনপদকে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। আর তেমনি একটি গণহত্যা হয়েছিল গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের তারকান্দর গ্রামে।
বাংলা মাসের ১৯ জ্যৈষ্ঠ (২ জুন) এদিন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার তারাকান্দর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা মিলে তারাকান্দর গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে গণ-কবর দিয়েছিল।
কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও স্বীকৃতি না মেলায় তারাকান্দর গণহত্যা রয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে। তাই স্বাধীনতার এত বছর পরও এই গণহত্যার ইতিহাস অজানা থেকে গেছে সবার কাছে। ইতিহাসের পাতায় ঠাঁয় হয়নি তারাকান্দরে গণহত্যার।
এমনকি, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এখানে নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিফলক। দিবসটি উদযাপনে নেওয়া হয় না কোনো উদ্যোগ। শুধু স্বজনহারা মানুষ চোখের পানি ফেলে নিহতদের স্মরণ করেন। শহীদদের নামের তালিকা দিয়ে ওই স্থানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন নিহত ও আহতদের স্বজনরা।
তারাকান্দর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ১৯ জ্যৈষ্ঠ (২ জুন) সকালটা ছিল অন্যান্য দিনের মতো শুভ্র। কিন্তু, দিনের বাকীটা সময় যে রক্তের হলিখেলায় শুভ্র সকালটা রক্ত ধারণ করবে তা বুঝতে পারেননি সেই গ্রামের মানুষ।
এদিন, কোটালীপাড়া থানা থেকে তিনটি গান বোটে করে ঘাঘর নদী দিয়ে ১১ জন পাকিস্তানি সেনা গোপালপুর আসে। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে অপেক্ষা করছিল স্থানীয় দোসর রাজাকার। এরপরই স্থানীয় দোসর রাজাকারদের সহযোগিতায় হিন্দু প্রধান এলাকা তারাকান্দর গ্রামে এসে শুরু করে হত্যাযজ্ঞ।
এসময়, মুক্তিকামী মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুললেও পাক বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হন। আশ্রয় নেন ডোবায়, ঝোপঝাড়ে, পুকুরের কচুরিপানার মধ্যে। স্থানীয় রাজাকার ও আলবদররা পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তারাকান্দর গ্রামে ঢুকে বিভিন্ন বাড়িঘরে লুটপাট চালিয়ে পুড়িয়ে দেয় তারা। এরপর দুই শতাধিক মানুষকে হত্যা করে ফেলে রেখে চলে যায়।
সকাল থেকে শুরু হয়ে এ হত্যাযজ্ঞ চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এ হত্যাকাণ্ডে পরিচয় পাওয়া রাধিকা বৈদ্য, বিশ্বনাথ বৈদ্যর স্ত্রী পরিষ্কার বৈদ্য এবং তার দুই মেয়ে, পচু মণ্ডলের স্ত্রী, কুটিশ্বর মণ্ডল, লক্ষ্মণ বিশ্বাস, দীনেশ হালদার, পোকাই, কালু বালা, বিমল ঢালীর মা, মহেন্দ্র বৈদ্য, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে এবং রাজেশ বাড়ৈর স্ত্রীসহ শিশু-নারী এবং নাম না জানা বহু মানুষকে তারাকান্দর বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। মাঠে ও পুকুর পাড়ে পরে থাকে সারি সারি লাশ।
এদিকে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও স্বীকৃতি মেলেনি তারকান্দর গণহত্যার। এমনকি দিবসটি পালন করা তো দূরের কথা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে নির্মাণ হয়নি কোনো স্মৃতিফলক।
পাকিস্তানি হানাদারদের সেই নির্মম নৃশংসতার সাক্ষী মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া নটবর রায় (৭৫) বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের তাড়া খেয়ে ওইদিন একটি কচুরিপানা ভর্তি ডোবার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির সামনে পুকুরের পাশের একটা ডোবার মধ্যে পালিয়েছিল নয়জন। তাদের কাউকে গুলি করে, কাউকে কুপিয়ে, চোখ তুলে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। পাকিস্তানি সেনারা এই গ্রামের নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছিল। নিজেকে কোনো রকমে বাঁচাতে পেরেছিলাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চলে যাবার পর উপরে উঠে আসি তখন দেখি সারি সারি লাশের স্তুপ। সেই ভয়াল দৃশ্যের কথা এখনো মনে পড়লে আঁতকে উঠি।’
তারাকান্দর গ্রামের ৬৫ বছরের বৃদ্ধা সবিতা রানী রায় বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী যখন এ গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালায় তখন আমার বিয়ে হয়নি। প্রাণ বাঁচাতে বাবার সঙ্গে খাল ঝাঁপিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। পরে আমার বিয়ে হলে এখানে ফিরে আসি। তখন পুকুর, খাল ও ডোবার মধ্যে সারি সারি মাথার খুলি, হাড় পড়েছিলো।’
একই গ্রামের রমেশ রায় বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও তারাকান্দর গণহত্যার কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। এমন কি এখানে কোনো স্মৃতিফলকও নির্মাণ হয়নি। এ কারণে আমার শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারি না। এমনকি নতুন প্রজন্মও এ গণহত্যার সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে না। আমরা চাই এ গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়ে এখানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক।’
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম মাহফুজুর রহমান জানান, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ধরে রাখতে আমাদের বদ্ধভূমিগুলো সংরক্ষণ করা দরকার। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে এসব বদ্ধভূমি বা স্মৃতি সংরক্ষণ অত্যাবশ্যকীয়। এর মধ্যে তারাকান্দর বদ্ধভূমিটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করি দ্রুত বদ্ধভূমিটি সংরক্ষণ করা হবে।