আজ ৩রা জুন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বানিয়ারচর গির্জা বোমা হামলা বোমা ট্রাজেডি দিবস। এ ঘটনা পার করল দীর্ঘ ২০ বছর। ২০০১ সালের এই দিনে ভয়াবহ বোমা হামলায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ১০ জন নিহত ও আরও অর্ধশত মানুষ আহত হন।
কিন্তু এ হত্যাকাণ্ড দীর্ঘ বছর পার কলেও বিচার কাজতো দূরে থাকা অভিযোগ গঠন করতে পারেনি সিআইডি। ফলে হতাশা আর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহতদের স্বজনরা।
এদিকে, দিবসটি পালন উপলক্ষে বানিয়ারচর গির্জায় প্রতি বছরের ন্যায় প্রার্থনা সভা, কবর জিয়ারত, প্রদীপ প্রজ্জ্বলণ ও পুষ্পমাল্য অর্পণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
মামলার বিবরণ ও প্রত্যক্ষদর্শী এবং নিহত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০১ সালের ৩রা জুন সকাল ৭টার দিকে মুকসুদপুর উপজেলার বানিয়ারচর ক্যাথলিক গীর্জা সাপ্তাহিক প্রাথর্না চলছিল। প্রার্থনা চলার কিছু সময় পর হঠাৎ করে বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরিত হয়। মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গির্জার মধ্যে থাকা অনেকই ছুটতে থাকেন দিক-বিদিক। ঘটনাস্থলে প্রাথর্নারত অবস্থায় ১০ জন নিহত হয়। আহত হন আরও অর্ধ শতাধিক। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় পুরো গির্জা।
নিহতরা হলেন— রক্সিড জেত্রা, বিনোদ দাস, মন্মথ সিকাদার, সঞ্জীবন বাড়ৈ, পিটার সাহা, অমর বিশ্বাস, সতীশ বিশ্বাস, ঝিন্টু মণ্ডল, মইকেল মল্লিক ও সুমন হালদার।
এ বোমা হামলার ঘটনায় মুকসুদপুর থানায় ওই গির্জার তৎকালীন ফাদার পিতাঞ্জা মিম্মো বাদী হয়ে হত্যা ও পিটার বৈরাগী বাদী হয়ে বিস্ফোরক মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পরপরই হত্যাকারীদের ধরতে তৎপর হয়ে ওঠে পুলিশ। কিন্তু কোনো কুল-কিনার করতে পারেনি। পরে এ মামলা দু’টি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়।
এরপর দেশের অন্যান্য স্থানের বোমা হামলার আলামতের সঙ্গে এ বোমা হামলার আলামতের মিলে গেলে সরকার নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জেহাদ এ বোমা হামলা চালায় বলে এক প্রকার নিশ্চিত হয় সিআইডি। ফাদার পিতাঞ্জার দায়ের করা হত্যা ও পিটার বৈরাগী বাদী হয়ে দায়ের করা বিস্ফোরক মামলায় ৩৭ জনকে আসামি করা হয়। এ দু’টি মামলার প্রধান আসামি হরকাতুল জেহাদ নেতা মুফতি হান্নানের ফাঁসি অন্য মামলায় কারণে কার্যকর হয়েছে।
কিন্তু হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২০ বছর বছর পার হলেও এ সংক্রান্ত বিস্ফোরক ও হত্যা মামলার কোনো সুরাহা করতে পারেনি সিআইডি। বিচার কাজতো দূরে থাকা আদালতে অভিযোগ গঠন করাও সম্ভব হয়নি সিআইডির পক্ষে। এমনকি এ পর্যন্ত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল হয়েছে ২৩ বার। এ সকল জঙ্গি সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হলেও এখন পর্যন্ত এ বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারীকেও শনাক্ত করতে পারেনি সিআইডি।
নিহত সুমন হালদারের বাবা সুখ রঞ্জন হালদার বলেন, ‘সেদিন ছিল রোববার। আমার ছেলে সুমন হালদার প্রার্থনা করতে গিয়েছিল গির্জায়। হঠাৎ করে বিকট শব্দ শুনি। দৌঁড়ে এসে দেখি আমারা ছেলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এরপর থেকে ছেলে হত্যার বিচারের আশায় দিন গুনছি আমরা। কিন্তু দীর্ঘ ২০ বছর অপেক্ষার পরও এখন পর্যন্ত বিচার পেলাম না। ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারব কিনা তাও জানি না।’
নিহত সতীশ বিশ্বাসের স্ত্রী ললিতা বিশ্বাস বলেন, ‘ছেলে ছোট থাকতেই বোমা হামলায় আমার স্বামী মারা যান। অনেক কষ্টে খেয়ে না খেয়ে ছেলেকে মানুষ করেছি। দীর্ঘ দিন পার হলেও আমার স্বামী হত্যার বিচার পেলাম না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবি আমি যেন দ্রুত স্বামী হত্যার বিচার পাই।’
নিহত সতীশ বিশ্বাসের ছেলে অরূপ বিশ্বাস বলেন, ‘খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছি। আদর-স্নেহ পাওয়া তো দূরের কথা বাবার চেহারাটা মনেও নেই। আর যেন কেউ তার বাবাকে না হারায়। প্রধানমন্ত্রী কাছে আবেদন আমি যেন আমার বাবার হত্যার বিচার পাই।’
বানিয়ারচর গির্জার পাল পুরোহিত ফাদার জার্মেইন সঞ্চয় গমেজ বলেন, ‘ঘটনার দীর্ঘ ২০ বছর পার হলেও বিচার কাজের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে নিহতদের পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে। নিহতদের স্মরণে বানিয়ারচর ক্যাথলিক গির্জায় বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। সকাল ৭টায় গির্জায় নিহতদের স্মরণে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর নিহতদের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপশি ছিটানো হবে মঙ্গলজল। পরে বিকালে স্মরণ সভা ও সন্ধ্যায় প্রজ্জ্বলন করা হবে মোমবাতি।’
তবে মামলা দু’টির বিষয়ে সিআইডি কোনো কথা বলতে না চাইলেও গোপালগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবুনালেল স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট রঞ্জিৎ কুমার বাড়ৈ (গামা) জানান, দীর্ঘ দিন ধরে এ বোমা হামলা মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। কিন্তু তদন্ত শেষ না হওয়ার ফলে দীর্ঘ দিনেও চার্জশিট দেওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়া এ মামলার বারবার তদন্ত কর্মকর্তা বদলি করা হচ্ছে। সিআইডি দ্রুত তদন্ত শেষ করে চার্জশিট জামা দিলে বিচার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।