এরশাদ শিকদার! শতাব্দীর ভয়ঙ্কর এক সিরিয়াল কিলারের নাম। ২০০৪ সালের ১০মে মধ্যরাতে খুলনার জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার বাবার নাম বন্দে আলী।
খুলনা মহানগরের সোনাডাঙ্গার মজিদ স্মরণিতে মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে তার বিলাসবহুল বাড়ি ‘স্বর্ণকমল।’ এরশাদ শিকদারের বহু অপকর্মের সাক্ষী এই ‘স্বর্ণকমল।’ বাড়িটিতে গোপন কুঠরি এবং অস্ত্র ভাণ্ডারের কথাও শোনা যায়।
ফাঁসির রায় কার্যকরের পর এরশাদ শিকদারের সহযোগী জাহাজী মতিকে বিয়ে করে ঢাকায় পাড়ি জমান তার বড় স্ত্রী খোদেজা। প্রথম দিকে এ ধরনের খবর শোনা গেলেও বর্তমানে খোদেজা ‘স্বর্ণকমলে’ই বসবাস করছেন।
তার তিন ছেলে মো. মনিরুজ্জামান শিকদার জামাল, মো. কামাল শিকদার ও মো. হেলাল শিকদার বর্তমানে খুলনায় ছোট-খাটো ব্যবসা করেন। এছাড়া বিয়ের পর মেয়েটি শ্বশুর বাড়িতেই আছে।
এরশাদ শিকদারের ছোট স্ত্রী শোভা ‘স্বর্ণকমল’ ছেড়ে বিউটি পার্লারের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন বলে জানা যায়। শোভা বর্তমানে একমাত্র মেয়ে এষাকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস করছেন বলে শোনা যায়।
আলোচনায় ‘স্বর্ণকমল’ : এরশাদ শিকদার গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘাট এলাকায় তার বরফকল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে আলোচিত ‘স্বর্ণকমল’ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও মজিদ স্মরণি দিয়ে চলাচলের সময় উৎসুক জনতার চোখ একবারের জন্য হলেও ‘স্বর্ণকমল’ এড়িয়ে যেতে পারে না।
উত্তরাধিকাররা কে কোথায় : এরশাদ শিকদারের বড় ছেলে মো. মনিরুজ্জামান শিকদার জামালকে জীবদ্দশায় বিয়ে দিয়ে যান বাবা এরশাদ শিকদার। তার শ্বশুর খুলনা নগরীর বৈকালী এলাকার তারা কাজী। পূর্ণ প্রভাব থাকায় তৎকালীন বেশ উৎসব করেই ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন শিকদার।
কথিত আছে- ছেলের বিয়ের উৎসবেই তিনি ‘আমি তো মরেই যাবো, চলে যাবো, রেখে যাবো সবি/ আছসনি কেউ সঙ্গের সাথী, সঙ্গেনী কেউ যাবি/ আমি মরে যাবো’…। গানটি গেয়ে সবাইকে আনন্দ দেন। পরবর্তীতে গানটি সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও মেঝ ও ছোট ছেলে নিজেদের পছন্দেই প্রেম করে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন।
এরশাদ শিকদারের ফাঁসির পর তার ছেলেদের জীবন-যাপনে ছন্দপতন ঘটে। ‘স্বর্ণকমল’ যখন উৎসুক জনতার কৌতুহলে পরিণত হয়, তখন তারা ‘স্বর্ণকমল’ ছেড়ে দূরে থাকার চেষ্টা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে জামাল ‘স্বর্ণকমল’ ছেড়ে বৈকালীর শ্বশুর বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে সেখানেই তিনি মুরগির খামারসহ ব্যবসা-বাণিজ্য করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন।
এরশাদ শিকদারের সন্তানদের মধ্যে তার মেঝ ছেলে মো. কামাল শিকদার অন্যদের চেয়ে বুদ্ধিমান। ফাঁসি পরবর্তীতে বাবার সব বিষয় সে-ই সামাল দিয়েছে। সেও ‘স্বর্ণকমল’ ছেড়ে খুলনার নিউ মার্কেট সংলগ্ন গির্জা রোডে ‘রাকিব প্রোপার্টিজ’র একটি ফ্লাট কিনে স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে সেখানেই বসবাস করছেন। ওই ভবনের নিচতলায় কাপড়ের দোকান। এছাড়া বৈকালীতে তার ব্যবসা রয়েছে।
এরশাদ শিকদারের ফাঁসির পর স্বর্ণ কমলের সামনে ‘সুবর্ণা এন্টারপ্রাইজ’ নামে ফোন-ফ্যাক্সের দোকান এবং ‘ফুড ক্যাসেল’ নামে একটি ফাস্ট ফুডের দোকানের ব্যবসা শুরু করেন কামাল শিকদার। যদিও পরবর্তীতে সে ব্যবসা ছেড়ে দেন তিনি।
এরশাদ শিকদারের ছোট ছেলে মো. হেলাল শিকদার মা খোজেদা বেগম ও নানী ফরিদা বেগমের সঙ্গে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ‘স্বর্ণ কমলে’ই বসবাস করছেন। এরাই এখন ‘স্বর্ণকমল’র বাসিন্দা। এছাড়া মেয়ে সুবর্না ইয়াসমিনকে (সাদ) পরিবারেরই পছন্দে খুলনা শহরেই বিয়ে দেওয়া হয়।
শিকদারের যত সম্পদ : জীবদ্দশায় এরশাদ শিকদারের অর্থ-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির হিসেবের কোনো শেষ ছিল না। খুলনা শহর ছাড়াও আশ-পাশের এলাকায় ছিল তার সম্পদ-বাড়ি। এমনকি ঢাকার উত্তরার ৭নং সেক্টরের ২০ নম্বর রোডে জনৈক নজরুল ইসলামের একটি বিলাসবহুল বাড়িও কিনে নেন এরশাদ শিকদার। যদিও ওই বাড়িটি বিক্রির কথা শোনা যায় পরবর্তীতে। এমনকি বর্তমানে তার সন্তানরা এরশাদের প্রিয়-আলোচিত ‘স্বর্ণকমল’ও বিক্রির কথা ভাবছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
ছেলে কামাল শিকদার যা বলেন : এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় এরশাদ শিকদারের মেঝ ছেলে মো. কামাল শিকদারের সঙ্গে। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন খুব ভালো আছি। ব্যবসা-বাণিজ্য করে সংসার চলছে। মায়ের সঙ্গে স্বর্ণ কমলেই আছি।’
‘নিজের বাবাকে একজন আদর্শ বাবা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘প্রত্যেক বাবাই তার সন্তানের কাছে আদর্শ। বাবার পরিচয়েই তারা চলছেন। কোথাও বাবার পরিচয় লুকাতে হয় না। তার বাবা ব্যক্তিগত জীবনে কী করেছেন- সেটি তার পার্সোনাল ব্যাপার। আমার বাবা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাবার পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল কিন্তু তিনি আইনের প্রতি শদ্ধাশীল হয়ে স্যারেন্ডার করেছিলেন। আশা করেছিলেন আইনের সুযোগ পাবেন। পাননি। রাজনীতিই বাবাকে ওপরে উঠয়েছে- রাজনীতিই তাকে শেষ করেছে। বাবার ফাঁসির পর পুলিশের চাপ এবং মিডিয়ার কারণে কিছুটা মানসিক চাপ ছিল পরিবারের সবার। এছাড়া কৌতুহলি লোকজন ভিড় করতো। ফলে ওই সময় স্বর্ণকমলে থাকতে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। তবে, আমরা কোনো ভাই রাজনীতিতো দূরের কথা, কোথাও বসে আড্ডাও দেই না। ফলে সাধারণ মানুষ আমাদের তেমন একটা চেনেও না। যে কারণে এখন আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’
প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে গ্রেপ্তার হন এরশাদ শিকদার। গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে তার নৃশংসতার অজানা সব কাহিনী। তার নৃশংসতার ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও হতবাক হয়ে যান। গ্রেপ্তারের পর তার নামে ৪৩টি মামলা বিচারাধীন ছিল। এর অধিকাংশই হত্যা মামলা। নিম্ন আদালতের বিচারে সাতটি হত্যা মামলায় তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ হয় ও চারটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়।
তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি তার আবেদন নাকচ করে দেন। এরপর ২০০৪ সালের ১০মে মধ্যরাতে খুলনা জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। পরে নগরীর দক্ষিণ টুটপাড়া কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। এর মধ্য দিয়েই পতন ঘটে এরশাদ শিকদার সাম্রাজ্যের।