কপোতাক্ষ, কয়রা ও শাকবেড়িয়া নদীবেষ্টিত সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত খুলনার কয়রা উপজেলা। এখনকার মানুষ আকাশে মেঘ আর নদীতে ঢেউ দেখলেই আঁতকে ওঠে। প্রতিনিয়ত ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় তাদের। এখন তারা আতঙ্কে আছে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে। কখন বেড়িবাঁধ ভেঙে সব তালিয়ে যায়!
ঘূর্ণিঝড় আইলা, আম্ফান এবং এ বছর ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি কয়রাবাসী। দুর্যোগের সময় বসতঘর ছেড়ে যাওয়া অসংখ্য পরিবার আজও নিজ বাড়ি ফিরতে পারেনি। রাস্তার ওপর ঝুপড়ি ঘরে বসবাস তাদের। এই ঝুপড়ি ঘরেই ঈদ কাটছে তাদের।
মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণে দেশে প্রতিনিয়ত মৃত্যু বাড়ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে মৃত্যু দুই শতাধিক এবং সংক্রমণ ১০ হাজারের উপরে থাকছে। করোনা নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এমন সময়ে এসেছে ত্যাগ ও মহিমার ঈদ, ঈদুল আজহা। তবে ঈদের আনন্দ ছুঁতে পারেনি কয়রা উপজেলার এই সকল মানুষকে।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে বাঁচতে সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার উপকূলীয় এলাকার মানুষ বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে অন্যত্র যেতে শুরু করেছে। কয়রা উপজেলা থেকে বিভিন্ন সময় ৩০ হাজারের বেশি মানুষ অন্যত্র চলে গেছেন বলে তথ্য উঠে এসেছে।
কয়রা সদর ইউনিয়নের গোবরা সোনাইপাড়া গ্রামের ফরিদা খাতুন সাত বছরের ছেলে ইয়াছিনকে নিয়ে খাস জমিতে ঝুপড়ি বেধে বসবাস করেন। স্বামী পরিত্যক্তা ফরিদা খাতুন ছেলেকে নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন। কয়েক বছর আগে বাবা মারা যায়। ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানার পর বসতভিটা নদীগর্ভে বিলিন হলে অসহায় হয়ে পড়েন ফরিদা। ছেলে ইয়াছিনকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে ঝুপড়িতেই বসবাস করেন এখন। নদীতে জাল টেনে মাছ ধরে সংসার চালান। তবে ছেলেকে স্কুলে পাঠান তিনি।
ফরিদা খাতুন বলেন, ‘ঈদে ছেলে ইয়াছিনের আবদার ছিলো নতুন জামার। যেখানে নিজেদের তিন বেলা খাবার যোগাতে অন্যের কাছে হাত পাততে হয়, সেখানে নতুন জামা কোথায় পাবো?’
ষাটের দশকে নির্মিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়ে বছরের পর বছর বাপ-দাদার ভিটে বিলীন হচ্ছে নদীতে। বহু মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে উপকূল ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
উপজেলা পরিসংখ্যান অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে কয়রা উপজেলায় জনসংখ্যা ছিলো ১ লাখ ৯৩ হাজার ৬৫৬ জন। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪৭ শতাংশ। সেই অনুসারে কয়রা উপজেলায় ২০০৯ হতে ২০২১ সালে জনসংখ্যা বেড়ে পৌঁছানোর কথা প্রায় ২ লাখ ২৮ হাজারে। কিন্তু বর্তমানে ২০২১ সালে উপজেলায় জনসংখ্যা আছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ২৯২ জন। সেই হিসাবে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ এই উপজেলা থেকে অন্যত্র চলে গেছে।
উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কবি নূর ইসলাম বলেন, শুধু দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন থেকে ৩ হাজার মানুষ অন্য জায়গায় চলে গেছে। অনেকে রাস্তার ওপর ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। সেখানেই তারা ঈদ উদযাপন করছেন।
উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা মনোজ মণ্ডল বলেন, প্রতিবছর প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে তিন হাজারের বেশি মানুষ উপকূল ছেড়ে চলে যায়। আর একশত মানুষ উপকূলে কাজের খোঁজে আসে।
উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, বার বার প্রাকৃতিক দূর্যোগ আঘাত হানায় জীবনমান উন্নয়নের জন্য অনেকে পাশের জেলাসহ শহরে চলে যান।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, ঈদে যতটুকু সম্ভব উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গতদের সহায়তা করা হয়েছে।