মো. শাহজাহান মিয়া ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে বাড়ির কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সৌধ দেখাতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে বাঁধে বিপত্তি। সৌধের গায়ে সাদা পাথরের কালো রঙের অক্ষরে লেখা ইতিহাস পড়ার উপায় নেই। রঙ উঠে সব লেখা সাদা হয়ে গেছে। লেখা পড়তে না পারার সন্তোষজনক কারণ জানাতে পারেননি সন্তানদের। আবার অনেক দর্শনার্থী সৌধের লেখা না পড়েই ফিরে গেছেন।
নিরুপায় হয়ে নিজেই শুরু করেন শ্বেত পাথরের উপরের লেখায় কালি দেওয়ার কাজ। জ্বল জ্বল করে উঠে ইতিহাস। জয়রামপুর রণাঙ্গণে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্মুখ সমরে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের ইতিহাস।
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের 'জয়রামপুর যুদ্ধ' জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অনন্য মর্যাদা পেয়েছে। সম্মুখ সমরে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাকবাহিনীর পলায়নের ইতিহাস আজও এখানকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এ অঞ্চলের অনেক এলাকায় পাক হায়ানার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। সম্মুখ বা গেরিলা যুদ্ধ চলাকালে প্রচুর পাকিস্তানি নিহত হলেও আমাদের মুক্তি বাহিনীর কয়েকজনকেও প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবির হোসেন।
তাঁরই স্মরণে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার জয়ারামপুর গ্রামে "মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি সৌধ" নামক একটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। সেখানে এই ম্যুরাল তৈরির নেপথ্যের কিছু কথা স্থাপনার ভেতরের দেওয়ালে পাথরে খোদাই করে লিখে সেটিকে লাগানো আছে।
পেশায় ব্যাংকার মো. শাহজাহান মিয়া। তাঁর বাড়ি নহাটা ইউনিয়নের বেজড়া গ্রামে। সম্প্রতি তিনি তার সন্তানদের জয়রামপুর যুদ্ধক্ষেত্রে নির্মিত স্মৃতি সৌধ দেখতে যান। গিয়ে দেখতে পান স্মৃতি ফলকের সব লেখা মুছে গেছে। তারপর তিনি বাড়ি ফিরে রঙ সংগ্রহ করে পরদিন সব লেখার চিহ্নের পর রঙ করে দেন।
শাহজাহান মিয়া বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে নহাটা ইউনিয়নের অবদান অনেক। সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের যত বীরত্ব গাঁথা রচিত হয়েছে তার মধ্যে বিশেষ জায়গা দখল করে আছে আমাদের নহাটা ইউনিয়ন। নহাটা অঞ্চলে যারা মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছেন এবং সম্মুখ সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এলাকাকে শত্রু মুক্ত করেছেন তাঁদের মধ্যে বীর প্রতীক গোলাম ইয়াকুব মিয়া এবং আবির হোসেনের নাম অন্যতম।
তিনি বলেন, ‘এখানে পরিবার নিয়ে বেশ কয়েকবার ঘুরতে এসেছি। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যেবার ছেলে মনিমকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে এসেছিলাম। তখন দেখতে পাই সৌধের দেওয়ালে পাথরে খোদাই করা বস্তুর উপরে কিছু একটা লেখা, কিন্তু কালি মুছে যাওয়ার কারণে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। তখন কষ্টের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে গেল। ভাবলাম কত দর্শনার্থীই তো এখানে ঘুরতে আসেন। তাঁরাও হয়তো এমন দুঃখ নিয়ে ফিরে যান। ভেবেছিলাম কর্তৃপক্ষ হয়তো বিষয়টি ঠিক করবেন। কিন্তু না, ঠিক হয়নি। পরে আমি আমার দুই সন্তানকে নিয়ে আবারও ঘুরতে গেলাম স্থানটিতে, সঙ্গে নিলাম অমোচনীয় কালি। ’
শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘দর্শনার্থীদের কষ্ট লাঘবে প্রকৃত ইতিহাস জানার সুযোগ করতে এবার দেরি না করে পাথরে খোদাই করা অংশের উপর স্থায়ী কালি দিয়ে লিখতে বসে গেলাম। লেখা শেষে ছেলেকে পড়তে বল্লাম এখানকার ইতিহাস। পরিপূর্ণ ইতিহাস যেনে মনের তৃপ্তি নিয়ে এবার বাপ-বেটা ফিরে এলাম ঘরে।’
কলেজ ছাত্র আরিফ বলেন, ‘আমরা এখানে প্রায়ই ঘুরতে আসি। ইতিহাসটা পড়তে পারতামনা। এখন পরিস্কার পড়তে পারছি।’
মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রামানন্দ পাল জানান, মো. শাহজাহান মিয়াকে সাদুবাদ জানাই তাঁর কাজের জন্য।