লামিয়া আক্তার। বয়স মাত্র ১৫। খুলনা মহানগরীর গিলাতলা হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় গত তিন মাস আগেই তার বিয়ে হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের ইচ্ছাতেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে।
এভাবে লামিয়ার মতো খুলনা মহানগর ও জেলায় দেড় বছরে ৩ হাজার ৯জন ছাত্রীকে বাল্য বিয়ের শিকার হতে হয়েছে। খুলনায় করোনা মহামারি যেন বাল্য বিয়ের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। এ মহামারিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লম্বা ছুটি থাকায় বাল্য বিয়ের উৎসব হয়েছে। খুলনা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রুহুল আমিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে, শিশু বয়সেই সংসারের ভার কাঁধে চেপে বসায় তাদের শিক্ষাজীবন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
খুলনায় বাল্য বিয়ের শিকার ৩ হাজার ৯জন ছাত্রীর সবাই মাধ্যমিক স্তুরের। তারা ৭ম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পার হতে পারেনি। এর মধ্যে জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় সর্বোচ্চ ৭৫১টি এবং কয়রা উপজেলায় ৬৮১টি আর সবচেয়ে কম দিঘলিয়া উপজেলায় ৬টি বাল্য বিয়ের তথ্য পাওয়া গেছে।
খুলনা জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনার দেড় বছরে ডুমুরিয়া উপজেলায় ৭৫১টি, কয়রা উপজেলায় ৬৮১টি, পাইকগাছা উপজেলায় ৪৮৩টি, দাকোপ উপজেলায় ২৯১টি, রূপসা উপজেলায় ২১৭টি, খুলনা মহানগরীতে ১৫৮টি, তেরখাদা উপজেলায় ১৪৯টি, ফুলতলা উপজেলায় ২৪০টি, বটিয়াঘাটা উপজেলায় ৩৩টি ও দিঘলিয়া উপজেলায় ৬টি বাল্য বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে রূপসা উপজেলার বেলফুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ৭০টি, কয়রা উপজেলার কালনা মহিলা দাখিল মাদ্রাসায় ৫২টি, মদিনাবাদ মহিলা মাদ্রাসায় ৫০টি, ডুমুরিয়া উপজেলার মহিলা দাখিল মাদ্রাসায় ৩৮টি, তেরখাদা উপজেলার কুশলা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩৭টি, খুলনা মহানগরীর হ্যানে রেলওয়ে গার্লস স্কুলে ১৭টি বাল্য বিয়ে হয়েছে।
খুলনা মহানগরীর গিলাতলা হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী লামিয়া আক্তার (১৫)। তিন মাস আগে তার বিয়ে হয়। পরিবারের সদস্যদের প্রত্যাশা অনুযায়ী তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে।
লামিয়া জানায়, করোনায় স্কুল বন্ধ, পরিবারে চলছে অভাব-অনটন। এ অবস্থায় পরিবারের সদস্যরা তার বিয়ে ঠিক করে। কাবিন হয়েছে, তাই বাবার বাড়িতে থেকে সে এখনো স্কুলে যেতে পারছে। ডিসেম্বর মাসে তাকে উঠিয়ে নেওয়ার পরে স্বামীর পরিবার চাইলে শ্বশুর বাড়িতে গিয়েও সে লেখাপড়া করতে আগ্রহী।
লামিয়ার মা ফাতেমা বেগম বলেন, বাল্যবিয়ে নিষিদ্ধ এটা আমি জানি। কিন্তু অসহায়। অভাব-অনটনের মধ্যে কর্মজীবী ভালো ছেলে পেয়ে হাতছাড়া করতে চাইনি। তাই এখন কলমা দিয়ে রেখেছি। ডিসেম্বর মাসের ৯ তারিখ মেয়েকে তারা উঠিয়ে নেবেন।
তিনি বলেন, গরিব মানুষের অনেক সমস্যা থাকে। তারপরেও লকডাউনের মধ্যে স্বামীর আয় নেই, কাজ নেই, স্কুল বন্ধ, মেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না- এলাকার পরিবেশ ভালো না। মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় থাকতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে ভেবেই বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।
ফুলবাড়িগেট ইউসেপ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী শাহিনা খাতুনের চাচাতো বোন আলেয়া বেগম বলেন, স্কুল বন্ধ, গরিব পরিবার, অর্থ কষ্ট, কাজ নেই, ত্রাণ নেই, কোনো প্রকার সহযোগিতা নেই, বেঁচে থাকা কষ্টকর। তাই কর্মজীবী ছেলে পেয়ে আমরা গত সপ্তায় শাহিনার বিয়ে দিয়েছি। এখন তার স্বামী লেখাপড়া শেখালে সে লেখাপড়া করবে।
লবন ফ্যাক্টরিতে কর্মরত নাসিমা বেগম জানান, তার মেয়ে শাজেদাকে (১৪) গত শনিবারই বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে নিরাপত্তাহীনতার কারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর আর স্কুলে যেতে পারেনি। খালার বাসায় থাকত। তিনি কোম্পানির পরিত্যক্ত জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছেন। আর্থিক সঙ্কট ও নিরাপত্তার কারণেই আগেভাগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ৭ বছর আগে তার স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। কষ্ট করে মেয়েকে আগলে রাখতেন।
আটরা শ্রীনাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহসেন বিশ্বাস বলেন, করোনার সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় এ স্কুলের ১২ ছাত্রী বাল্য বিবাহের শিকার হয়েছে। দেড় বছরের অধিক সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের পরিবারের মেয়েরাই বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে। এছাড়া স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন অভিভাবক জানান, করোনাকালে স্কুল বন্ধের সময় তাদের মেয়েদের নিরাপত্তার কারণেই তারা বাল্যবিবাহ দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, গিলাতলায় ইতোপূর্বে নিম্নবিত্ত পরিবারে বাল্য বিয়ের ঘটনা বেশি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রধান শিক্ষক জানান, গিলাতলা ও আশেপাশের প্রতিটি বিদ্যালয় থেকেই সপ্তম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কমপক্ষে গড়ে ২০ জন করে শিক্ষার্থীর বাল্য বিয়ে হয়েছে। বিবাহিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে দু’একজন শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হচ্ছে। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই চিত্র।
খুলনা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, বাল্য বিয়ের শিকার হওয়া ছাত্রীরা কম বেশি স্কুলে আসা যাওয়ার মধ্যে আছে। তবে সবাই যাতে স্কুলের সাথে সম্পৃক্ত থাকে বা থাকতে পারে, সে বিষয়ে তাদের অভিভাবকদের সচেতন করা হচ্ছে।