তসলিমা বেগম মুসলিমা। বয়স ৪১। একজন গৃহবধূ। ছিল সুখের সংসার। জীবনে তেমন কষ্ঠ করতে হয়নি তাকে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে শিখিয়েছে জীবন সংগ্রাম। জীবন যুদ্ধে হার না মানা এই সংগ্রামী নারী মুসলিমার সংসার এখন ঘুরছে সাইকেলের চাকায়।
তিনি বাই সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুড়ি, ফিতা, কানের দুল, আংটি, চেইন, টিপ, চিরুনিসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে হাল ধরেছেন সংসারের।
জানা গেছে, স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে ভালোই চলছিল নগরীর দৌলতপুর জুট মিলের শ্রমিক ওবায়দুর রহমানের (৫০) সংসার। সেই সুখে ছেদ পড়ে ২০১৯ সালে। হার্টের সমস্যার কারণে রিং পরানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা করানোর অর্থ ছিল না তার। ধীরে ধীরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
এদিকে, জুট মিল বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়ে পড়েন ওবায়দুর। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তির আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। তিন মেয়ের লেখাপড়ার খরচ তো দূরের কথা, ধার-দেনা করে তাদের খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাকে। নিরুপায় হয়ে পথে নামেন ওবায়দুরের স্ত্রী তসলিমা বেগম মুসলিমা (৪১)। শুরু করেন বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাপড় বিক্রির কাজ। শুরুতে হেঁটে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে থ্রি-পিসসহ নারীদের পোশাক বিক্রি করেন। তাতেও চলছিল না সংসার। পরে একটি বাইসাইকেল কেনেন। সেই সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুড়ি, ফিতা, গোল্ডপ্লেটের কানের দুল, আংটি, চেইন, টিপ, চিরুনিসহ প্রয়োজনীয় মালামাল বিক্রি শুরু করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, সাইকেলের সামনে ও পেছনে একাধিক ব্যাগ ও কাগজের কার্টুনে মালামাল নিয়ে ফেরি করার উদ্দেশ্যে বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন মুসলিমা। খালিশপুর হাউজিং বাজারের এস লাইনে এক বাড়ির সামনে জটলা পাকিয়ে রয়েছেন কয়েকজন নারী। মাঝে মুসলিমা চুড়ি, টিপ, চিরুনিসহ গ্রাহকের চাহিদা মাফিক মালামাল খুলে দেখাচ্ছেন। অনেকে পছন্দের জিনিস কিনছেন, অনেকে আবার দর কষছেন। সামান্য লাভ হলেই জিনিস ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। কেউ কেউ নগদ টাকা দিয়ে পছন্দের জিনিস কিনছেন, কেউবা বাকিতে খাতায় লিখে রাখছেন। এভাবে প্রতিদিন সাইকেলে বাড়ি বাড়ি ফেরি করে মালামাল বিক্রি করছেন মুসলিমা। জীবন যুদ্ধে সংগ্রামী নারী তিনি। এখন তিনি ওই এলাকার নারীদের প্রিয়জন।
খালিশপুর হাউজিং বাজার এস লাইনের গৃহবধূ শাহানারা বেগম বলেন, ‘মুসলিমা ভাবীকে ২২ বছর ধরে চিনি। খুব ভালো তিনি। কিন্তু খুব কষ্ট তার। স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত। এখন বাধ্য হয়ে এলাকায় সাইকেলে মালামাল বিক্রি করার জন্য নেমেছেন। সরকার বা কোনো বিত্তবান সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলে ভালো হয়।’
ওই এলাকার মুদি দোকানী ইমরান বলেন, ‘স্বামী অসুস্থ থাকায় দারিদ্র্যতার কারণে ওই নারী পর্দার মধ্যে থেকে রাস্তায় নেমে কাজ করছেন। প্রতিদিনই তিনি মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মালামাল বিক্রি করছেন। যেটা পুরুষদের করার কথা। এটা দেখলেও খারাপ লাগে, কিন্তু কী করব? এটা ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।’
স্থানীয় বাসিন্দা জসেদা রাণী বিশ্বাস বলেন, ‘তার কাছ থেকে প্রায় মালামাল কিনি। তার তিনটি মেয়ে আছে। স্বামী অসুস্থ থাকায় তিনি বাড়ি বাড়ি মালামাল বিক্রি করে সংসার এবং মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন। এটা অন্য নারীদের জন্য দৃষ্টান্ত।’
মুসলিমার স্বামী ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘দুই বছর আগে থেকেই আমার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। ২০১৯ সালে মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তাম। এরপর শহিদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসককে দেখায়। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে। আমি হাঁটতে গেলে হাঁপিয়ে যেতাম, অনেক সময় বুকে ব্যথা অনুভব করতাম। হার্টের ৯০ শতাংশ ব্লক ধরা পড়ে। চিকিৎসকরা দ্রুত এনজিওগ্রাম করে রিং পরানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারনে রিং পরানো সম্ভব হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুটমিলও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েছি। এখন ভারী কোনো কাজ করতেও পারি না। আর হৃদরোগে আক্রান্ত শুনলে কেউ কাজও দিতে চায় না। দুর্দশার মধ্যে আছি। তিন মেয়ের লেখাপড়াও ঠিকমতো করাতে পারছি না। এ অবস্থায় সংসার চালাচ্ছেন আমার স্ত্রী।’
জীবন যুদ্ধে হার না মানা সংগ্রামী নারী তসলিমা বেগম মুসলিমা বলেন, ‘আমার স্বামীর হার্টে ৯০ শতাংশ ব্লক ধরা পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে তার চিকিৎসা করাবো কীভাবে? তারপরও আমি হাল ছাড়িনি। প্রতিদিন ফেরি করি, বাচ্চাদের পড়ালেখা ও খাবারের ব্যবস্থা করছি। স্বামীর চিকিৎসার টাকার ব্যবস্থা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে আমি ব্যাগ কাঁধে করে নারীদের আনুষঙ্গিক জিনিস বিক্রি শুরু করি। এখন আর কাঁধে করতে পারি না। মেরুদণ্ডের হাড়ে সমস্যা হয়ে গেছে। এরপর সাইকেল কিনলাম। এখন কখনও সাইকেল চালিয়ে, কখনও পায়ে হেঁটে জিনিস বিক্রি করি। প্রতিদিন ৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। খুব কষ্ট করেই চলছে আমার সংসার। সরকার ও বিত্তবান ব্যক্তিদের তার পরিবারের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়ানোর মিনতি ছিল তার পরিশ্রমি ও সংগ্রামী কণ্ঠে।’