একজন মেধাবী ও নবীন শিক্ষকের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক সমিতি ও ছাত্রলীগ একে অপরের মুখোমুখী অবস্থান নিয়েছে। ফলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এড়াতে কর্তৃপক্ষ আগামী ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) বন্ধ ঘোষণা করেছে।
শুক্রবার (৩ ডিসেম্বর) বেলা ১১টায় সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। দুপুরে কুয়েটের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. আনিসুর রহমান ভূঁঞা স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে হঠাৎ হল ত্যাগের নির্দেশে বাড়ি ফিরতে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
শুক্রবার খুলনা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ইলেক্ট্রিকাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেনের অকাল মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নোংরা রাজনীতি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে কুয়েট ছাত্রলীগ।
কুয়েটের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. আনিসুর রহমান ভূঁঞা স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৬তম জরুরি সিন্ডিকেট সবার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইইই বিভাগের প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা কারণে শুক্রবার থেকে আগামী ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিকেল ৪টার মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
জড়িতদের শাস্তি দাবি শিক্ষক সমিতির অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এক বিবৃতিতে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের শাস্তি দাবি করেছে।
খুবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মো. ওয়ালিউল হাসানাত ও সাধারণ সম্পাদক ড. তানজিল সওগাত স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বিবৃতিতে বলা হয়, কুয়েট শিক্ষকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একদল শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছনার যে অভিযোগ উঠেছে, তা তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ করে দায়ীদের আইনের আওতায় আনা হোক। এ ঘটনার প্রতিবাদে কুয়েটের সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যে প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছে।
ছাত্রলীগের সংবাদ সম্মেলন বেলা ১১টায় খুলনা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ড. মো. সেলিম হোসেনের অকাল মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নোংরা রাজনীতি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে কুয়েট ছাত্রলীগ। তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে একটি কুচক্রী মহল সাধারণ শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়াসহ মূলধারার সংবাদমাধ্যমে অসত্য তথ্য দিয়ে নোংরা রাজনীতি করছে।
এতে লিখিত বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান বলেন, ‘সেলিম হোসেন স্যারের অকাল মৃত্যুতে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা বিশ্বাস করি, তার এই শূণ্যস্থান কখনো পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু একটি মহল তথ্যপ্রমাণ ব্যতিরেকে প্রাণপ্রিয় শিক্ষকের অকাল মৃত্যুর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতার যোগসূত্র ঘটিয়ে আমাদের মানসিক ট্রমার মধ্যে ধাবিত করেছে। এটি এক কথায় জঘন্য ও ঘৃণিত কর্মকাণ্ডের শামিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই কর্মকাণ্ডের প্রতি তীব্র নিন্দা এবং ঘৃণা জ্ঞাপন করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে তিনি শিক্ষক সেলিম হোসেনকে মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘সেদিন সেলিম স্যারের সঙ্গে সৌহার্ধ্যপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। তিনি আমাদের আপ্যায়িত করেছেন। তার সঙ্গে খারাপ আচরণের প্রশ্নই আসে না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি কুয়েটের লালন শাহ হলের ডিসেম্বর মাসের খাদ্য ব্যবস্থাপক (ডাইনিং ম্যানেজার) নির্বাচন নিয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান প্যানেলের বিরুদ্ধে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার প্রচেষ্টার অভিযোগ ওঠে। ওই প্যানেলের সদস্যেরা হলের প্রভোস্ট ড. সেলিম হোসেনকে নিয়মিত হুমকি দিয়ে আসছিলেন তাদের মনোনীত প্রার্থীকে নির্বাচিত করার জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের গ্রুপ ক্যাম্পাসের রাস্তা থেকে ড. সেলিম হোসেনকে জেরা শুরু করে। পরে তাকে অনুসরণের পর তার ব্যক্তিগত কক্ষে (তড়িৎ প্রকৌশল ভবন) প্রবেশ করে। তারা আনুমানিক আধাঘণ্টা ড. সেলিম হোসেনের কক্ষে ছিলেন। পরে অধ্যাপক ড. সেলিম হোসেন দুপুরে খাবারের জন্য বাসায় যান। এরপর দুপুর আড়াইটার দিকে তার স্ত্রী লক্ষ্য করেন, সেলিম হোসেন বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। এরপর দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
হঠাৎ হল ছাড়ার সিদ্ধান্তে বিপাকে কুয়েট শিক্ষার্থীরা যদিও শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৮তম জরুরি সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক কুয়েট বন্ধ ঘোষণার পরই হল ছাড়তে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে হঠাৎ হল ছাড়ার নির্দেশনায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার পরপরই দুপুর থেকে ক্যাম্পাস ছাড়তে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। বাস বা ট্রেনের টিকিট পাওয়া নিয়ে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। গত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ক্যাম্পাস খোলার কিছুদিনের মধ্যে আবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেক শিক্ষার্থী।
ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিরিয়ারিং চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মঈন ঢালী ঢাকার বাসা থেকে ২২ অক্টোবর ক্যাম্পাসে আসেন। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ বন্ধ হওয়ায় বিড়ম্বনায় পড়েছি। এখন আর বাড়ি ফিরব না। আমার বন্ধুর মেসে থাকব। সে ঢাকায় চলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যাপক বিড়ম্বনা।’
যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হারুনুর রশীদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীর জন্য এটা চরম ভোগান্তির। ঠাকুরগাঁও সদরের টিকিট পেলে বাড়ি চলে যাব। আর না পেলে কী করব, তা এখনো ভাবিনি।’
যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওসমান গণি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘করোনার জন্য অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এত দিন তো পড়ালেখা শেষ হয়ে যেত। ২৫ অক্টোবর ক্যাম্পাসে এসেছিলাম। আবার ভ্যাকেন্ট। আমাদের জন্য কষ্টদায়ক। পড়াশোনা শেষ করতে কত দিন লাগবে, জানি না। সব মিলিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই শিক্ষার্থী বলেন, ‘করোনায় ক্ষতি তো অনেক হয়েছে। এবারের বন্ধ ঘোষণার কারণে আরও কিছুটা ক্ষতি হবে। তবে যেহেতু তদন্তের স্বার্থে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, তাই আমরা চাই, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীরা চিহ্নিত হোক।’
এদিকে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ছাত্রলীগের একাংশ আবাসিক হল না ছাড়ার জন্য প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। সেখানে তারা কর্তব্যরত সাংবাদিকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। পরে বিকেল ৪টার দিকে তারা প্রশাসন ভবনের সামনে থেকে সরে যায়।
সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে কুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রতীক চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘সিন্ডিকেট থেকে যেসব সিদ্ধান্ত এসেছে, তা দেখে বুঝলাম, শিক্ষকদের রিলেটেড কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তাই আমাদের দাবি মানা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে পর্যালোচনা করার মতো কিছু আসেনি। আজকের সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং হল কেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত। ফলে আমাদের সাধারণ সভায় আগে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেগুলোই বহাল থাকছে। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভা ব্যতীত আমাদের অবস্থান পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।’
গত মঙ্গলবার দুপুর ৩টার দিকে মারা যান কুয়েট শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেন। অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেন কুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং লালন শাহ হলের প্রভোস্ট ছিলেন। তার মৃত্যুকে ঘিরে রহস্যের সৃষ্টি হয়। অভিযোগ ওঠে, তার মৃত্যুর আগে তিনি লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলেন।
শিক্ষক সেলিমের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে দোষী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবিসহ ৫ দফা দাবিতে বৃহস্পতিবার দুপুরে একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করে শিক্ষক সমিতি। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান শিক্ষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, কুয়েট ছাত্রলীগের বেশ কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। এর একটি প্রভাবশালী গ্রুপ বর্তমান কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।