২০২১ সালজুড়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম খবরের শিরোনাম আর আলোচনায় শীর্ষে ছিল নগরীর মানুষ খেকো খোলা ড্রেন এবং শতবছরের ঐতিহ্য সিআরবি রক্ষার আন্দোলন।
চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা প্রায় দুই দশকের স্থায়ী সমস্যা। কিন্তু ২০২১ সালটি ছিল এই জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কারণে উন্মুক্ত খোলা ড্রেন আর এসব ড্রেনে পড়ে একের পর এক নিখোঁজ ও প্রাণহানীর ঘটনা। অন্যান্য বছর জলাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা থাকলেও ড্রেনে পড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
তবে ২০২১ সালের শুরু থেকে চট্টগ্রামে ড্রেনে পড়ে নারী ও শিশুসহ পাঁচ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এদের মধ্যে একজনের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ গত ৯ ডিসেম্বর নগরীর ষোলশহর এলাকায় ড্রেনে পড়ে ১০ বছর বয়সী এক শিশু নিখোঁজ হয়। এর দুদিন পর ঘটনাস্থলের এক কিলোমিটার দূর থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত ২৫ আগস্ট সকালে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় বাসা থেকে বের হন সবজি ব্যবসায়ী সালেহ আহমদ (৫৫)। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে বহদ্দার হাট এলাকায় কর্মস্থলে যাওয়ার সময় ডুবে থাকা উন্মুক্ত ড্রেনে পড়ে যান তিনি। স্রোতের টানে হারিয়ে যান। প্রায় তিন দিন ধরে সন্ধান করেও ফায়ার সার্ভিস তার লাশও উদ্ধার করতে পারেনি।
এর আগে গত ৩০ জুন, নগরীর ষোলশহর চশমা হিল এলাকায় উন্মুক্ত ড্রেনে পড়ে ডুবে যায় একটি যাত্রীবাহী সিএনজি অটোরিক্সা। এতে মারা যান সিএনজি অটোরিক্সা চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর নগরীর আগ্রাবাদ মাজার গেইট এলাকায় চশমা কিনে ফুটপাত ধরে হেঁটে বাসায় ফেরার সময় খোলা ড্রেনে পড়ে নিখোঁজ হন সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া (১৯) নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী। সাদিয়া ছিলেন চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্রী। দীর্ঘ প্রায় ৬ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে ড্রেনের গভীর থেকে সাদিয়ার লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
এ ঘটনার পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একে অপরকে দায় চাপালেও ড্রেনে পড়ে মৃত্যু থামেনি। সর্বশেষ গত ৯ ডিসেম্বর নগরীর ষোলশহর এলাকায় প্লাস্টিকের বোতল কুড়াতে গিয়ে কামাল নামের এক শিশু খোলা ড্রেনের আবর্জনায় তলিয়ে যায়। তিন দিন পর তার লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
মানুষখেকো ড্রেনের বাইরে চট্টগ্রামে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল চট্টগ্রাম মহানগরীর ফুসফুস খ্যাত সিআরবি রক্ষার আন্দোলন। শতবর্ষী শত শত বৃক্ষ বেস্টিত সবুজে আচ্ছাদিত রেলওয়ের সিআরবি এলাকাটি নগরীর সব শ্রেণির মানুষের কাছে বুকভরে বিশুদ্ধ শ্বাস নেওয়ার স্থান। এই সিআরবি এলাকাতেই রেলওয়ে এবং ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করলে প্রতিবাদ বিক্ষোভে মুখর হয়ে উঠে চট্টগ্রাম নগরী।
গত আগস্ট মাস থেকেই সরকারিদলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করে প্রায় তিন মাস ধরে টানা আন্দোলন চালিয়ে যায়।
প্রতিদিন প্রতিবাদ সমাবেশ, মানবন্ধন, গান, আবৃত্তিতে প্রতিবাদ, মোমবাতি জ্বালিয়ে কিংবা নানা প্রতিবাদি সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাধ্যমেও সিআরবি রক্ষার আন্দোলনে শরিক হয় শিক্ষক সাংবাদিক, পেশাজীবী, ছাত্র/ছাত্রীসহ সকল শ্রেণির মানুষ। সিআরবি রক্ষার আন্দোলনে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন। সেই আন্দোলন এখনো চলমান।