এক সময় মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার আমতৈল (মানিকদিহি) গ্রামের পালপাড়ার তৈরি মাটির তৈজসপত্রের কদর ছিলো জেলা জুড়ে। মাটির তৈরি ভাতের হাঁড়ি, মুড়ি ভাজার হাঁড়ি, রুটি বানানোর তাওয়া, পানির কলস গৃহবধূদের কাছে ছিলো বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু কালের বিবর্তনে প্লাস্টিক, স্টেইনলেস ষ্টিল আর এ্যালুমিনিয়ামের ভিড়ে সে কদরে ভাটা পড়েছে অনেক আগেই। ফলে জীবন জীবিকার তাগিদে অনেক কুমোর পেশা বদলিয়েছেন। তারপরও শতাধিক পরিবার বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে না পেরে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েও নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন এ পেশার সঙ্গে।
একই আবস্থা সদর উপজেলার চাঁদবিল, মুজিবনগর উপজেলার বল্লভপুরসহ জেলার বিভিন্ন গ্রামের কুমোর পরিবারগুলোর।
ছোট বেলায় মা-বাবার কাজে সহযোগীতা করতে গিয়ে কুমোর জীবনে জড়িয়ে পড়েন মঞ্জুরী পাল। বাবা-মায়ের সংসার ছেড়ে স্বামীর সংসারে এসেও একই কাজ আজো করে চলেছেন তিনি। রাত-দিন কাদামাটির কাজ করে যেন হয়ে গেছেন মাটির মানুষ।
মঞ্জুরী পালের সংসারে রয়েছে এক মেয়ে ও দুই ছেলে। জমি জায়গা নেই তাদের। এ কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়েই সংসারের ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি এইচএসসি পাশ করিয়ে একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে এমএ পাশ করে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করছেন। আর ছোট ছেলে স্থানীয় কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন।
চাকি পোড়ানোর চুল্লি
কৃষিতে লোকসান ও অন্য ব্যবসা করার মতো অর্থ না থাকায় বাধ্য হয়ে আমতৈল গ্রামের মানুষ পোড়া মাটির চাকি তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এ পেশায় নিয়োজিতরা জানান, স্বল্প সুদে সরকারের কাছ থেকে ঋণ পেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শুধু মঞ্জুরী পাল নয়, তার মতো গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠানে বসেই পরিবারের সবাই মিলে মাটি দিয়ে তৈরী করছেন মাটির রিং বা চাকি। দুই একটি পরিবার মিলে চাকি পোড়ানোর জন্য চুল্লি বা ভাটা তৈরি করে রেখেছেন। এসব ভাটায় থরে থরে শুকনা মাটির রিং বা চাকি চুল্লিতে সাজিয়ে জ্বালানো হচ্ছে।
সাদা মাটির চাকি দুইদিন পোড়ানোর পর পরিণত হচ্ছে লালচে বর্ণের। গ্রামে প্রবেশ করলেই মনে হচ্ছে পুরো গ্রামকে যেন সাজানো হয়েছে পোড়া মাটির লালচে রংয়ের মাটির চাকি দিয়ে।
গাংনী উপজেলা শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে আমতৈল গ্রাম। গ্রামের অন্তত ৩০টি কারখানায় শতাধিক পরিবারের লোকজন মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। নারী-পুরুষ সবারই কাদামাটির গন্ধমাখা শরীর। এক সময় এদের নিপুন হাতের শিল্পকর্মে তকতকে কাদামাটি হয়ে উঠত নিত্য ব্যবহার্য বাসনপত্র, ফুলের টব, নান্দা, খেলনাসহ কারু কাজ করা শোপিচ। বেশ কদরও ছিল এসব জিনিসের। কিন্তু প্লাস্টিকের তৈরী জিনিসের কদর বেড়ে যাওয়ায় মাটির তৈরী এসব জিনিসের এখন আর সেই কদর নেই।
এখন আমতৈল গ্রামের কুমোররা পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য তৈরী করেন মাটির চাকি। জেলার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন জেলাতেও বিক্রি হচ্ছে এসব চাকি।
চাকি কারখানার মালিক স্বপন বলেন, ‘আগে এক ট্রলি মাটির দাম ছিল ২০০ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০০০ টাকা। জ্বালানির দামও বেড়ে গেছে। কারখানার মালামাল তৈরী ও চুলার জন্য জমি লিজ নিতে হয়। এক বিঘা জমি লিজ নিতে বাৎসরিক ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা দিতে হয়। বছরের মাত্র ৮ থেকে ৯ মাস চলে এ ব্যবসা। অনেক কুমোর বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে মৃৎ শিল্পে বিনিয়োগ করেছেন। আনুষঙ্গিক খরচ মিটিয়ে এমন কোন টাকা থাকে না যা দিয়ে সমিতির কিস্তি পরিশোধ করা যায়। সরকার যদি স্বল্প সুদে কুমোরদের ঋণের ব্যবস্থা করতো তাহলে সবাই স্বাবলম্বী হতে পারতো।’
গাংনী উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার কাজি আবুল মনসুর বলেন, ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির উন্নয়নে সরকার দুটি কর্মসূচী চালু করেছে। একটি ভাতা কর্মসূচী। অন্যটি ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচী। ওই গ্রামের কুমোররা যদি ঋণের জন্য আবেদন করেন তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’