ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশের অন্যতম শুঁটকি মহাল কক্সবাজারের নাজিরারটেকে দেড় কোটি টাকার শুঁটকি নষ্ট হয়ে গেছে। জলোচ্ছ্বাসে আড়ৎগুলোতে পানি প্রবেশ করে এ সব শুঁটকি নষ্ট হয় বলে জানিয়েছেন একাধিক ব্যবসায়ী।
মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) দুপুরে সরেজমিন নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে শুঁটকি শোকানোর মাচাগুলো লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এ ছাড়া মাচার নিচে হাঁটু সমান পানি দেখা গেছে।
একাধিক শুঁটকি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোমবার (২৪ অক্টোবর) রাতে জোয়ারের পানিতে ১নং ওয়ার্ডের কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া ও নাজিরারটেকের প্রায় ৬০০ শুঁটকি মহাল প্লাবিত হয়েছে। এতে সংরক্ষণে থাকা দেড় কোটি টাকার শুঁটকি পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে। এছাড়া লবণ, চাল ও মুদি দোকানসহ অন্যান্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ কোটির উপরে বলে জানিয়েছেন ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকতার কামাল আজাদ।
নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ কোম্পানি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং উপকূলে আঘাত হানবে এই খবর শোনার পর মাইকিং করে মৎস্য ব্যবসায়ীদের সতর্ক করেছিলাম। তারপরও ঘূর্ণিঝড়ের থাবা থেকে অনেক শুঁটকি রক্ষা করতে পারিনি। কেউ শুঁটকি সরাতে পেরেছে কেউ যানবাহনের অভাবে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে পারেনি। আড়তে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বস্তা ভর্তি দেড় কোটি টাকার শুঁটকি ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।’
শুঁটকি ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, ‘ঘূণিঝড়ে সতর্ক থাকলেও এভাবে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হবে তা ভাবিনি। বাতাসের বেগে আমাদের মাচাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া সংরক্ষণে থাকা বস্তা বস্তা মাছ ভিজে গেছে। এখন মাচাগুলো পুনরায় ঠিক করছি।’
আরেক ব্যবসায়ী মুজাহিদ বলেন, ‘এই ঘূর্ণিঝড়ে আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। মাচার মধ্যে আমাদের যে শুঁটকিগুলো ছিল তা পানিতে তলিয়ে গেছে। শুধু শুঁটকি মহাল নয়, বাসা-বাড়িও জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছিল।’
নাইমুল আহমেদ মুবিন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে সমুদ্রের পানি ৮ থেকে ১০ ফুট বেড়ে যায়। সোমবার (২৪ অক্টোবর) রাতে জোয়ারের পানি জলোচ্ছ্বাস হয়ে আমাদের শুঁটকি পল্লীতে প্রবেশ করে অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। শুঁটকি ব্যবসায়ীদের অনেক সরঞ্জাম ও আশপাশের দোকানিদের মালামাল সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে গেছে।’
নাজিরারটেকে ১২ বছর ধরে বসবাস করছেন মল্লিকা বেগম। অভাব অনটনে ভিটে বাড়ি বিক্রি করে ঈদগাঁও থেকে নাজিরারটেক চলে আসেন তার পরিবার। স্বামী ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে কোনো মতে শুঁটকি ও সামান্য দোকান করে চলছে সংসার।
মল্লিকা বেগম বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে নাজিরারটেক প্লাবিত হয়ে আমাদের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। পানিতে ভেসে গেছে শুঁটকি। শেষ সম্বল হারিয়ে আমরা নিঃস্ব প্রায়। আমাদের আর কিছুই রইলো না।’
শুঁটকি দোকানদার গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘জলোচ্ছ্বাসে আমার দোকানে ১ ফুট পর্যন্ত পানি প্রবেশ করে। এ ছাড়া আশপাশে ২ থেকে ৪ ফুট পানি বেড়েছিল। আমার আড়তে পানি প্রবেশ করে দুটি শুঁটকির বস্তা ভিজে ২ লাখ টাকার শুঁটকি নষ্ট হয়ে গেছে।’
ওই এলাকার কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, ‘১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পরে এটাই আমার দেখা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ঘূর্ণিঝড়। শুঁটকির ভরা মৌসুমে মহালের এতগুলো শুঁটকি চোখের সামনে নষ্ট হয়ে গেল। পানি বেশি হওয়ার কারণে মানুষ শুঁটকিগুলো রক্ষা করতে পারেনি। একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে গরীব মানুষগুলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে আমার এলাকার ৪০ হাজার মানুষের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। সবার বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া চাউলের দোকান, লবণের গুদাম ও শুঁটকি মহালে তুলনামূলকভাবে বেশি প্রভাব পড়ে কোটি কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি নিরূপণ করার জন্য কক্সবাজার পৌরসভাসহ কাজ করতেছি। খুব শিগগিরই ক্ষয়-ক্ষতির সঠিক প্রতিবেদন তৈরি করে আমরা সরকারের কাছে জমা দিবো।’
ঘূর্ণিঝড়ে জেলার মোট ক্ষয়-ক্ষতির তথ্য প্রকাশ করেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। জেলায় দূর্যোগ কবলিত ইউনিয়ন হলো ৪১টি, আর পৌরসভা ৩টি। ঘূর্ণিঝড়ে জেলায় ২ জন আহত হলেও মৃত্যু হয়নি কারো। ক্ষতিগ্রস্ত খামার ৮২৯টি, নিঁখোজসহ ৩৪টি ট্রলার ডুবি। দূর্যোগ আক্রান্ত ফসলি জমির পরিমাণ ৯২১ একর, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বাধের পরিমাণ প্রায় ৩০ কিমি এবং এলজিইডির ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার পরিমাণ প্রায় ৭ কিলোমিটার।