সারা বাংলা

এক রশিতে বাধা ছিল ১৭ শহিদের লাশ

১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হয়েছে দেশ। এর ১৪ দিন পর ৩০ ডিসেম্বর খবর ছড়িয়ে পড়লো পদ্মা নদীর পাড়ে মাটিচাপা লাশ দেখা যাচ্ছে। মুহূর্তেই উৎসুক মানুষের ঢল নামলো রাজশাহী নগরীর শ্রীরামপুর এলাকার পদ্মা নদীর পাড়ে।

সেখানে একই রশিতে বাধা অবস্থায় পাওয়া গেল ১৭ শহিদের লাশ। এদের মধ্যে ১২ জনের গলায় ছিল ফাঁস লাগানো। তাদের জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে হত্যা করেছিল পাকিস্তানী বাহিনী। এই স্থানটি বাবলা বন বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। ১৭ শহিদের লাশ পাওয়ার পর স্বজনদের গগনবিদারী আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে পদ্মা পাড়ের আকাশ-বাতাস।

মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের তথ্যমতে, ১৯৭১ সালে শ্রীরামপুরের বোয়ালিয়া ক্লাব ভবন দখলে নিয়ে টর্চার সেল গড়ে তুলেছিলো পাকিস্তানি বাহিনী। এখানে স্বাধীনতাকামী মানুষদের ধরে এনে নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর হত্যা করে ফেলে দেওয়া হতো পাশের পদ্মা নদীতে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে বিজয়ের আগে ২৫ নভেম্বর রাজশাহীর শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার বুদ্ধিজীবীদের এখানে ধরে আনা হয়।

এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পর গণকবর দেওয়া হয় বাবলা বনে। অনেকে মনে করেন ৩০ ডিসেম্বর যে ১৭ জন শহিদের লাশ পাওয়া যায়, তাদের জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ, তাদের একই রশিতে বাধা অবস্থায় পাওয়া গেলেও শরীরে বুলেটের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

এই বধ্যভূমিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ুম, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য নাজমুল হক সরকার, সরকারি কর্মকর্তা আবদুল হক সরকার, ব্যবসায়ী আজিজুল হক চৌধুরী, শামসুল ইসলাম ঝাটু, অ্যাডভোকেট সুরেশ, বীরেন সরকার, মকবুল হক চৌধুরী, আলতাফ হোসেন, মির্জা সুলতান, মির্জা আজিজুর রহমান, নওরোজ দৌল্লাহ খান, আমিনুল হক, তৈয়ব আলী, আলাউদ্দিন চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহম্মদ মুক্তাসহ মোট ১৭ জনের লাশ পাওয়া যায়।  শহিদদের পরনের পোশাক ও হাতের আংটি দেখে লাশ শনাক্ত করেন স্বজনরা।

শহীদ আজিজুল হক চৌধুরী জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের ভগ্নিপতি। তার ছেলে ওমর ফারুক চৌধুরী এখন রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ও চাচাকে ৩ নভেম্বর ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে আমার বাবা আর চাচাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তাম। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা আমার নিজের চোখে দেখা। আমি আমার বাবা-চাচার লাশ নিজে তুলি।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ুমের নামে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ডরমেটরির নামকরণ করা হয়েছে। তাঁর মেয়ে মাহবুবা কানিজ এখন মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাসা ছিল রাজশাহী শহরের মালোপাড়ায়। ২৫ নভেম্বর এই বাসা থেকে আমার বাবাকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মিরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মোহাম্মদ আবদুল বারী ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী। তার অধীনে মনোবিজ্ঞান বিভাগের দুজন শিক্ষকও পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করতেন। আর আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাই তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। বাবলা বন বধ্যভূমিতে আমার বাবার লাশ পাওয়া যায়।’

রাজশাহীর এই বধ্যভূমিটি দীর্ঘ দিন অনাদরেই পড়ে থেকেছে। ১৯৯৫ সালের ২৫ নভেম্বর শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক বসানো হয়। এর উদ্বোধন করেন শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ুমের স্ত্রী অধ্যাপক মাসতুরা খানম। সেদিন অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য এখানকার মাটি সংগ্রহ করে নিয়ে যান। ওই স্মৃতিফলক স্থাপনের পরও কেটে যায় অনেক দিন। ২০২০ সালে বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ‘মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় বধ্যভূমি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। বধ্যভূমির জায়গাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হলেও এখনও কেউ সেভাবে এটি দেখভাল করেন না।

গত ২৫ নভেম্বর বাবলা বন গণহত্যা দিবসেও স্মৃতিস্তম্ভের ফটকে তালা লাগানো ছিল। ফলে যারা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়েছিলেন তাদের সীমানা প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকতে হয়েছে। রাজশাহীর জননেতা আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদের সদস্য এবং গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষক লীগের নেতারা প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে শ্রদ্ধা জানান।

রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক ওয়ালিউর রহমান বাবু বলেন, ‘বাবলা বনে যে সমস্ত শহিদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, তাদের প্রায় সবাইকেই ২৫ নভেম্বর তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাই ২৫ নভেম্বরকেই বাবলা বন গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে ‘

তিনি আরও বলেন, এ দেশিয় রাজাকার-আলবদরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী এই ১৭ জনকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। এতদিন পর সেখানে স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এ বধ্যভূমিতে ১৭ জনের লাশ পাওয়া গেলেও আরও লাশ হয়তো পদ্মায় ভেসে গেছে। তাদের পাওয়া যায়নি। তাদের নামটাও জানা যায়নি। পরিবারের কাছে আজও তারা নিখোঁজ।’