কেবল ফেব্রুয়ারি মাস নয়, পুরো বছরজুড়েই দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকে সিলেটের দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তৈরি শহিদ মিনারে। ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যতিক্রমী শৈল্পিক নিদর্শন হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি কুড়িয়েছে এই দুই শহিদ মিনার। দেশের দূর দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন ভাষা শহিদদের স্মৃতিতে তৈরি এই শহিদ মিনার দুটির সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে।
সিলেটের দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত শহিদ মিনারের একটি হচ্ছে সিলেট শহর থেকে একটু দূরে রাগীব নগরের লিডিং ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব মাদার’ ও অপরটি হচ্ছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (সিকৃবি) ক্যাম্পাসের ‘সূর্যালোকে বর্ণমালা।’
এই দুই শহিদ মিনারের স্থপতি লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের প্রধান রাজন দাস।
রিপ্রেজেন্টেশন অব মাদার: সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসে ১৫ শতক জায়গার ওপর ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব মাদার’ শহিদ মিনারটি তৈরি করা হয়েছে। এই শহিদ মিনারের মূল কাঠামো নির্মাণকাজে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যয় হয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা। শহিদ মিনারটির উচ্চতা ৩৮ ফুট, চওড়া ৬০ ফুট। এর মূল অংশ ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের আদলে তৈরি। এর ঠিক মধ্যভাগে ‘মা’ শব্দটি বড় করে বাংলায় লেখা রয়েছে। তারপর থরে থরে আরও ‘মা’ লেখা। তবে সেগুলোর ভিন্ন ভিন্ন ভাষার নানা বর্ণে।
বাংলা ভাষা, জনজাতি ও আঞ্চলিক উচ্চারণে ‘মা’ ডাকও আছে এই শহিদ মিনারে। সেই সঙ্গে ইংরেজি থেকে শুরু করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভাষায় লেখা রয়েছে ‘মা’ শব্দটি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শহিদ মিনারজুড়ে শুধু ‘মা’ শব্দের আচ্ছাদনে তৈরি হয়েছে অন্য রকম এক আকর্ষণ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুক্তচিন্তার মানুষরা শহিদ মিনার দেখতে আসেন এই ক্যাম্পাসে।
শিক্ষার্থী লিজা আক্তার বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রাইভেট হলেও এর স্থায়ী ক্যাম্পাসে রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহ। এর স্থাপনাগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই, আর আমাদের শহিদ মিনারতো গৌরবের। দেশের দূর দূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন শহিদ মিনারটি দেখতে।
সূর্যালোকে বর্ণমালা: টিলার উপর নির্মিত দৃষ্টিনন্দন শহিদ মিনারটি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিকৃবি) অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়টির ধান ফটক পেরোলেই চোখে পড়বে এই শহিদ মিনারটি। এটি মনোরম ক্যাম্পাসের এক অনন্য স্থাপনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের শুরুর দিকে প্রায় ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘সূর্যালোকে বর্ণমালা’ শহিদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। এটির নকশা করেন লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক স্থপতি রাজন দাশ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রবেশদ্বার অতিক্রম করলেই দূর থেকে টিলার ওপর শহিদ মিনারটি চোখে পড়ে। টিলার পাদদেশে পৌঁছালে মিনারের শিরভাগ দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। সেখান থেকেই সিঁড়িপথের যাত্রা শুরু। অনেকগুলো সিঁড়ি অতিক্রম করে সামনে এগোলে মিনারের পুরো অংশটির দেখা মেলে। মূল চত্বরে উঠে গেলে দেখা যায়, অনেকগুলো খাড়া সরু দেওয়াল আকাশমুখী হয়ে বিভিন্ন উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছে। দেওয়ালগুলোর মধ্যে থাকা অল্প ফাঁকটুকু আমাদের মাতৃভাষার বর্নমালায় ভরে আছে। বর্ণমালার কোনটি বড়, কোনোটি আবার ছোট। মিনারটি পশ্চিমমুখী আর বর্গাকৃতি চত্বরের উত্তর ও দক্ষিণে পাঁচ ফুট উচ্চতায় বর্ণমালার প্রাচীর রয়েছে ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়হান উন নবী বলেন, ‘সূর্যালোকে বর্ণমালা’ শহিদ মিনারটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্য গৌরবের। এই শহিদ মিনারের পাশে দাঁড়ালে মনে হয় বর্ণমালার উঠানে দাঁড়িয়ে আছি। যেদিকে চোখ যাবে হয় বর্ণমালা, নয়তো আকাশ । শহিদ মিনারটি পশ্চিমমুখী হওয়ায় প্রতি ভোরে এর সমনে রক্তিম সূর্যে আবির্ভাব হয় এবং দিনের বয়স বাড়তে থাকলে সূর্য মধ্যগগণ পেরিয়ে পশ্চিমে ঢলে পড়ে।
দৃষ্টিনন্দন দুটি শহীদ মিনার প্রসঙ্গে স্থপতি রাজন দাশ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সিকৃবির ‘সূর্যালোকে মিনারটি’ ভোরের দিকে ছায়াচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট থাকে। দিন পরিক্রমায় ক্রমশ সে সূর্যের আলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই এই শহিদ মিনারের শিরোনাম ‘সূর্যালোকে বর্ণমালা’ দেওয়া হয়েছে। শহিদ মিনারটি সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।’
লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য কর্মের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমি এই স্থাপত্য কর্মের নাম দিয়েছি ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব মাদার।’ এতো উঁচু শহিদ মিনার দেশে খুব একটা নেই। এই উচ্চতা শুধু মা ও মাতৃভাষাকে সবার উপরে রাখার ইচ্ছে থেকে করা। মূলত ভাষা শহিদদের জন্য শহিদ মিনারটি নির্মাণ করা হলেও এর মধ্য দিয়ে ‘মা’ শব্দটি সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সব ভাষায় ‘মা’ শব্দ এখানে বসানোর একটাই লক্ষ্য, সেটি হচ্ছে পৃথিবীজুড়ে মায়ের ভাষাকে সম্মান জানানো।’