গত ৭ মাসে টেকনাফের পাহাড়কেন্দ্রিক এলাকায় ৬০ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটে। অপহৃতদের বেশিরভাগই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন। অথচ পাশবিক নির্যাতন এবং আবারো অপহরণের ভয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কোনো তথ্য দিয়েই সহযোগীতা করতে ভয় পান ভুক্তভোগীরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টেকনাফের বাহারছড়া (দক্ষিণ) ও হ্নীলায় বেশিরভাগ অপহরণের ঘটনা ঘটে। বাহারছড়া ও হ্নীলা ইউনিয়নের মাঝখানে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়। এই পাহাড় হয়ে উঠেছে অপরাধীদের অভয়াশ্রম। দুই ইউনিয়নে যাতায়াতের সহজ পথ বাহারছড়ার জাহাজপুরা ঢালা ও হ্নীলার পানখালী ঢালা। এই পাহাড়িপথের দূরত্ব সাড়ে ৩ কিলোমিটার। দিনের বেলাতেও অন্ধকার থাকে গাছপালায় ঘেরা পথটি। ফলে খুব সহজেই সাধারণ মানুষদের অপহরণ করতে পারে অপহরণকারীরা।
আরও পড়ুন: পাহাড়ে র্যাব-সন্ত্রাসী গোলাগুলি: আটক ৬
মো. হাবিব নামের ভুক্তোভোগী পরিবারের একজন বলেন, ‘আমরা দিন রাত ২৪ ঘণ্টা ভয়ে দিন কাটাচ্ছি। গত ৭ মাসে আমাদের ইউনিয়ন থেকে ৩১ জন লোক অপহরণ হয়েছে। তার মধ্যে একজনের কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে। অপহরণকারীদের কাছ থেকে চার জন পালিয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যেও ২ জন গুরুতর আহত অবস্থায় ছিলেন। বাকিরা সবাই মুক্তিপণ দিয়ে পরিবারের কাছে ফেরত আসেন। টাকা দিতে না পারলে অপহরণকারীরা নির্মম নির্যতন চালায়। তাই নিরুপায় হয়ে মুক্তিপণের টাকা দিতে রাজি হয় পরিবারগুলো।’
আরও পড়ুন: টেকনাফে ছালেহ বাহিনীর সঙ্গে র্যাবের গোলাগুলি
তিনি আরও বলেন, ‘বাহারছড়ার শিলখালী থেকে অপহৃত একজনের লাশ পাওয়া যায়। চৌকিদারপাড়া থেকে ৫ জন অপহৃত হন, যার মধ্যে দুইজন পালিয়ে আসেন। হাজামপাড়া থেকে ১৬ জন অপহরণ হন, তাদের মধ্যে ১৪ জন্য মুক্তিপণ দিয়ে এসেছেন বাকি ২জন আহত অবস্থায় পালিয়ে এসেছেন। বড়ডেইল থেকে দুই ধাপে ৫ জন অপহরণ হয়ে সবাই মুক্তিপন দিয়ে ফেরত এসেছেন। মারিশবনিয়া থেকে ২ জন অপহরণ হয়ে মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরে এখন ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
র্যাব সূত্র জানায়, পাহাড়ি সড়কে সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক (টমটম) চালকের ছদ্মবেশে অপহরণ করছে সংগবদ্ধ দলের সদস্যরা।
র্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘অপহরণ ও ডাকাতির কাজে অপরাধীরা বিদেশি অস্ত্র ব্যবহার করে। দেশি ও বিদেশি বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ অপহরণ চক্রের সদস্যরা পাহাড়ে অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছে। সেখানে তারা বৃহৎ সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে যৌথভাবে অপরাধ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল শুক্রবার রাতে তেমনই একটি চক্রের মূল হোতাসহ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১৫। টেকনাফের বাহারছড়া দুর্গম পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে অপহরণ ও ডাকাতির মূল হোতা হাফিজুর রহমান ওরফে ছলে উদ্দীনসহ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে দেশি-বিদেশি বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ছলে বাহিনী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা ও অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা এখন পর্যন্ত অর্ধশত মানুষকে অপহরণ করেছে। অনেককে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।’
র্যাব কমান্ডার বলেন, ‘টেকনাফের ৮ থেকে ১০টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকা আমাদের কাছে এসেছে। এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল হালিম জানান, ‘ছলে বাহিনীর প্রধান হাফিজুর রহমান ওরফে ছলে উদ্দিনের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণসহ ছয়টির বেশি মামলা রয়েছে।’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘অপহরণের ঘটনায় মাদক কারবার, পাওনা টাকা আদায়সহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ জড়িত থাকার ব্যাপারটি জানতে পারি। স্থানীয়দের নিয়ে বিট পুলিশিং এবং কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে অপহরণ রোধে কাজ করছি। সবাই যদি বিস্তারিত তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন তবে সন্ত্রাসীদের সহজেই আইনের আওতায় আনা যাবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অপহরণের ঘটনায় টেকনাফ থানায় ৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৪৬ জনকে আসামি করা হয়। গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৩ জন।