রাজশাহী নগরীর বিনোদপুর এলাকায় দাঁড়িয়ে ছিলেন পরীক্ষার্থী আজাদ রহমান। দুপুরের কড়া রোদে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর তিনি একটি রিকশা পান। তড়িঘড়ি করে রিকশায় উঠে যেতে চান শহরের ভদ্রায়। কিন্তু ভাড়া শুনেই আজাদের চক্ষু চড়কগাছ! রিকশাচালক ভাড়া চান ২৫০ টাকা! আজাদের প্রশ্ন, আড়াই কিলোমিটার রাস্তার ভাড়া এত কীভাবে?
আজাদের প্রশ্ন শুনেই রিকশাচালকের সোজা উত্তর- ‘জ্যামে কয়েক ঘণ্টা আটকে থাকতে হচ্ছে। জ্যামের ভাড়া কি আপনি দেবেন?’
সোমবার (২৯ মে) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে বিপত্তিতে পড়েছেন আজাদ রহমানের মতো হাজারো পরীক্ষার্থী। অল্প পথের জন্য তাদের দিতে হয়েছে অস্বাভাবিক ভাড়া। রিকশা-অটো রিকশার চালকরা অবশ্য যানজটকে দুষছেন। তাদের দাবি, যানজটের কারণেই বাড়তি ভাড়া নিতে হচ্ছে।
এদিন সকাল থেকে রাবিতে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এদিন চার শিফটে ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই ইউনিটটিতে ১ হাজার ৫৯৪ আসনের বিপরীতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৫ হাজার ৮৫০ জন। এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়েছেন, আবার ফিরেছেন। তাই শহরজুড়েই দেখা দেয় যানজট। এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেই লেগেছে এক ঘণ্টারও বেশি!
যানজটের কারণে বিপত্তিতে পড়েন নোয়াখালী থেকে আসা পরীক্ষার্থী মনিরা আক্তার। বাবাকে নিয়ে তিনি এসেছেন ভর্তি পরীক্ষা দিতে। এক ঘণ্টারও বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি একটি অটো রিকশায় ওঠার সুযোগ পান। নগরীর কাজলায় বিশ্ববিদ্যালয় গেট এলাকা থেকে অটো রিকশায় উঠেই ভাড়া শুনে তিনিও হকচকিয়ে যান। কাজলা থেকে রেলগেট যেতে তাদের ৩০০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়। এই রাস্তাটির দূরত্ব আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার।
যানজটের ভেতরেই অটোরিকশায় বসে থাকা পরীক্ষার্থী মনিরা বললেন, ‘আমি রংপুরে পরীক্ষা দিয়ে এসেছি। কিন্তু সেখানে এত ভাড়া দিতে হয়নি। রাজশাহীতে একঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে দুপুর দেড়টার দিকে অটো রিকশায় উঠেছি। এখন বাজে ৪টা। আমি রেলগেটে যেতে চাই। এখনও যানজটে আটকে আছি। কখন পৌঁছাতে পারবো জানি না। খুবই খারাপ অবস্থা।’
আজাদ-মনিরার মতো চরম ভোগান্তিতে পড়েন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার্থীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও তারা রিকশা বা অটো রিকশা পাননি। আবার পেলেও ভাড়া শুনে চমকে যেতে হয়েছে তাদের। ভর্তি পরীক্ষার সুযোগে নগরীর অটোরিকশা ও রিকশাচালকরা ভাড়া বাড়িয়েছেন নিজেদের ইচ্ছেমত। বাড়তি এই ভাড়া নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছে স্থানীয় লোকজনও।
আজ শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, নগরীতে প্রচুর লোকের সমাগম। শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় যানজট। বিনোদপুর, কাজলা, সাহেববজার, রেল স্টেশন, রেলগেটে প্রতিটি রাস্তায় যানজট। এসব সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন আটকে থাকছে সড়কে। ফলে সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছিল না কারো পক্ষে।
নগরীর বিনোদপুর থেকে কাজলার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা। অন্য সময় অটো রিকশায় ভাড়া মাত্র ৫ টাকা। আর রিকশার ভাড়া ২০ টাকা। তবে ভর্তি পরীক্ষার জন্য এই ভাড়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। অটো রিকশায় আসতে হলে গুনতে হচ্ছে জনপ্রতি ৫০ টাকা। আর রিকশা ভাড়া ১৫০ টাকা।
বিনোদপুর-কাজলার মত বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে শহরের অন্য এলাকাতেও যাতায়াত করতে। বিনোদপুর থেকে সাহেব বাজার আসতে অটোরিকশায় দিতে হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা। অন্য দিনে ভাড়া মাত্র ১৫ টাকা। আর রিকশায় আসতে গুনতে হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এত ভাড়ার পরেও অটোরিকশা বা রিকশা পেতে রীতিমতো হুড়োহুড়ি লেগে যাচ্ছে।
অটোরিকশা ভর্তি যাত্রী নিয়ে বিনোদপুর থেকে সাহেববাজারে যাচ্ছিলেন চালক হাবিবুর হোসেন। বাড়তি ভাড়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে জ্যাম লেগে আছে। বিনোদপুর থেকে কাজলা পার হতে সময় লেগেছে দুই ঘণ্টা। তাই ভাড়া এত বেশি। ভাড়ার পরিমাণ কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ নির্ধারণ করে দেয়নি। যার যত ইচ্ছে হচ্ছে সে সেভাবেই নিচ্ছে। মাত্র তিন দিনই তো সুযোগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশন নগরীতে চলাচলরত রিকশা-অটো রিকশার ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। তবে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে সিটি করপোরেশন কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এ নিয়ে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানালেন সিটি করপোরেশনের রিকশা-অটো রিকশা নিয়ন্ত্রণ কমিটির সভাপতি সরিফুল ইসলাম বাবু।
সরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবছরই পরীক্ষার সময় বেশি ভাড়া নেওয়ার বিষয়টা ঘটে। সব রিকশা-অটো রিকশা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক চলাচল শুরু করার কারণে তীব্র যানজটও হয়। এই অজুহাত দেখিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হয়। আমরা চেষ্টা করি কিন্তু ঠেকাতে পারি না। এবারও কয়েকদিন আগে আমরা বসেছিলাম। বলেছিলাম, পরীক্ষার্থীরা আমাদের মেহমান। তাদের কাছে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া যাবে না। এতে রাজশাহীর সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা ঠিকই নেওয়া হচ্ছে। আমরাও কিছু করতে পারছি না। এটাই বাস্তবতা।’
রাজশাহী ইজিবাইক চালক সমিতির সভাপতি মো. রাশেদ বলেন, ‘আমরা একতাবদ্ধ না। চালকদের কোনও সংগঠনও গড়ে ওঠেনি। কেউ কারও কথা শোনে না। ফলে যে যার মতো ভাড়া আদায় করে। আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা পরীক্ষা দিতে আসছেন তারা আমাদের অতিথি। যানজটের জন্য একটু ক্ষতি হলেও দু’একদিনের জন্য অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া ঠিক না। যারা বেশি নেয়, তাদের গাড়ি জব্দ করা উচিত। ট্রাফিক পুলিশই এ ব্যবস্থা নিতে পারে।’
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার অনির্বান চাকমাকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তাই বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আগামী ৩১ মে পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা চলবে। ৩ হাজার ৯৩০টি আসনের বিপরীতে এবার পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা দেবেন ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫৭৪ জন পরীক্ষার্থী। তাদের অনেকের সঙ্গে অভিভাবকও রাজশাহী এসেছেন। বাড়তি মানুষের যাতায়াতের চাপে রাজশাহীতে দেখা দিয়েছে যানজট। প্রতিবছরই এমন যানজট দেখা দেয় পরীক্ষার সময়। নৈরাজ্য দেখা দেয় ভাড়া নিয়েও।