সারা বাংলা

তালপাতার পাখায় চলে ২০০ পরিবারের জীবিকা 

‘তোমার হাতপাখার বাতাসে, প্রাণ জুড়িয়ে আসে’ প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী আকবরের এ গানটি একসময় অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। গানটির জন্মেরও অনেক আগে থেকেই এ দেশে জনপ্রিয় ও প্রয়োজনীয় একটি উপকরণ হাতপাখা। যখন বিদ্যুৎ ছিল না, ছিল না এসি বা এয়ারকুলারের মতো যন্ত্র; তখন হাতপাখার বাতাসই দিতো গরমে ঠান্ডার পরশ। বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে হাতপাখা তৈরি করা যায়। তবে, তালপাতা দিয়ে তৈরি হাতপাখাই সর্বাধিক সুলভ ও জনপ্রিয়।     

তালপাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার দামপাড়া গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবার। সাধারণত চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে হাতপাখার চাহিদা বাড়ে। কিন্তু, এ বছর তাপদাহ খুব বেশি থাকায় ভাদ্র মাসেও চলছে তালপাখা তৈরির কাজ। নিকলীর দামপাড়া গ্রামের নোয়ারহাটি, টেকপাড়া ও বর্মনপাড়ায় ঘরে ঘরে চলছে তালপাখা তৈরির ধুম। এখানকার হাতপাখা যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কারিগররা বাড়ির উঠোনজুড়ে দলবেঁধে হাতপাখা তৈরি করেন। গরমের তিন-চার মাসে তালপাখার চাহিদা বেশি থাকলেও এ গ্রামের কারিগররা বছরের অন্য সময়েও পাখা তৈরি করে থাকেন। অন‌্য বছরের তুলনায় এবছর গরম বেশি। তার ওপর এ বছর বিদ্যুতের সরবরাহ কম থাকায় দফায় দফায় হচ্ছে লোডশেডিং। তাই, হাতপাখার চাহিদাও বেশি। 

হাতপাখা তৈরির জন্য প্রথমে তালপাতা শুকিয়ে নির্দিষ্ট মাপে কেটে নিতে হয়। তারপর বেতির মতো করে এগুলো দিয়ে বুনন করে ছাঁচ তৈরি করা হয়। চক্রাকার ছাঁচের চারদিকে জালি বেত ঘুরিয়ে এর ওপর প্লাস্টিকের রিবন পেঁচানো হয়। মোড়ল বাঁশ কেটে ফালি করে পাখার হাতল বানিয়ে নাইলন সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়। এরপর প্লাস্টিকের সরু পাইপ কেটে হাতলে চুঙ্গি দেওয়া হয়। এভাবেই তৈরি হয় তালপাতার হাতপাখা।

মালতী রানী দাস দীর্ঘদিন ধরে তালপাখা তৈরি করেন। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, গ্রামের নারীরা অন‌্যান‌‌্য কাজের পাশাপাশি পাখা তৈরি করি। পুরুষরা পাখা তৈরির যাবতীয় সরঞ্জাম আমাদের জোগাড় করে দেন। শিশু সন্তানরাও আমাদের হাতপাখা তৈরিতে সহযোগিতা করে।

পাকিস্তান আমল থেকে হাতপাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন এখানকার কারিগররা। তিন পুরুষ ধরে এ পেশায় আছেন তারা। বংশপরম্পরায় এ গ্রামে এখনো কিশোর-তরুণ বয়সীরা পাখা তৈরির পেশা বেছে নিচ্ছেন। বর্তমানে গ্রামের ২০০ পরিবারের প্রায় ১ হাজার মানুষ তালপাখা তৈরি করছেন।

জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী, আশুলতা রায়ের বয়স ৮০ বছর। এখনও মনোযোগ দিয়ে তৈরি করছেন সুন্দর ও আকর্ষণীয় হাতপাখা। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই দামপাড়া গ্রামে তালপাখা বানানো হয়। আমার শাশুড়ি হেমলতা রায় প্রথম শখের বসে তালপাতা দিয়ে পাখা বানানো শুরু করেছিলেন। তখন বাড়িতে অতিথিসেবায় এই তালপাখা ব্যবহার করা হতো। এখন তিনি বেঁচে নেই। কিন্তু, তার কর্ম বেঁচে আছে আমাদের মধ্যে দিয়ে। তার কাছ থেকেই গ্রামের অন‌্যরা তালপাখা বানানো শিখেছেন। 

গ্রামের প্রবীণ কারিগরদের দেওয়া তথ‌্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার আগে একটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়ত আট আনা। বিক্রি হতো এক থেকে দেড় টাকায়। এখন একটি পাখা তৈরিতে গড়ে খরচ পড়ে ৫০ টাকা। বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৭৫ টাকা টাকায়। একসময় গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। তখন গরমে হাতপাখাই ছিল গ্রামের মানুষের ভরসা। এখন বিদ্যুৎ, জেনারেটর ও আইপিএসসহ নানা যন্ত্র এসেছে। তবে, কমেনি হাতপাখার কদর। গ্রাম কিংবা শহর— প্রায় সব বাড়িতেই এক-দু’টি হাতপাখা থাকেই। প্রতিযোগিতার যুগে বাজার ধরে রাখতে এখন হাতপাখায় নানা রঙের নকশা ও জরি ব্যবহার করা হয়। তাই, হাতপাখা তৈরিতে খরচও বেড়েছে। এ গ্রামের কারিগররা একসময় আশপাশের বিভিন্ন বাজার ও মেলায় হাতপাখা বিক্রি করতেন। এখন আর সেটা করতে হয় না। বিভিন্ন জায়গার পাইকাররা বাড়িতে থেকে এসে হাতপাখা কিনে নিয়ে যান। 

তবে, সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় ধীরে ধীরে ঐতিহ্যবাহী হাতপাখা হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেও নিকলী উপজেলার দামপাড়া গ্রামের তালপাখা টিকে আছে। তবে বাঁশ, বেত, তালপাতার দাম বেড়ে যাওয়ায় হাতপাখা তৈরি করে এখন আর পোষাচ্ছে না কারিগরদের। এ অবস্থায় তাদের সংসারে যেমন টান পড়েছে, ঐতিহ্যের এ পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি না, এ নিয়েও তারা কিছুটা শঙ্কিত।

এ ব‌্যাপারে উইমেন কাউন্সিলের সভাপতি সেলিনা ইয়াছমিন কাকলী রাইজিংবিডিকে বলেন, আমাদের দেশের অনেক ঐতিহ‌্যবাহী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। নিকলী উপজেলার দামপাড়া গ্রামের ২০০ পরিবারের নারীরা দীর্ঘদিন ধরে এ শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখন পর্যন্ত এ পেশাটিই তাদের জীবন-জীবিকার মূল উৎস। এই হস্তশিল্প টিকিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরি। ঐতিহ‌্যবাহী এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা সব সময় তাদের তাদের পাশে আছি।