সারা বাংলা

সাদা আলোয় ভয়ঙ্কর রাতের সড়ক

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সড়কগুলোতে বেড়েছে এলইডি লাইটের ব্যবহার। রিকশা, অটোরিকশা, মাহিন্দ্র ও মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে সাদা আলোর লাইট ব্যবহার করছেন মালিকরা। ফলে, একদিকে যেমন ঘটছে দুর্ঘটনা, অন্যদিকে বাড়ছে চক্ষুরোগের আশঙ্কা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সচেতন আর সদিচ্ছার অভাবেই কমদামি এসব লাইটের ব্যবহার বাড়ছে।

জেলা বিআরটিএ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত ৯ মাসে ৭২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬২ জন, আহত হয়েছেন ৯৭ জন। রাতে যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার বেশিরভাগই গাড়িতে এলইডি লাইটের ব্যবহারের জন্য হচ্ছে। বেশি আলোর আশায় স্বাভাবিক লাইটের পরিবর্তে গাড়িতে লাগানো এলইডির সাদা আলো ব্যবহার করেন চালক ও মালিকরা। এই আলো অন্ধকারে অন্য গাড়ির চালক এবং পথচারীদের চোখে লাগে। ফলে, বিপরীত দিক থেকে আসা বাহনের চালকেরা ঠিকমতো দেখতে না পারায় গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছেন।

গাড়ি চালক ও পথচারীদের অভিযোগ- এলইডি লাইটযুক্ত অটোরিকশা, ভ্যান ও মোটরসাইকেলের সাদা আলোয় বিপরীত দিক থেকে আসা যানবাহন চালক ও পথচারীদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। দ্রুত ধেয়ে আসা এসব যানবাহনের দিকে চোখ পড়লেই আলোর তীব্রতায় সামনের দিকের আর কোনো কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। আন্দাজের ওপর সামনে এগোতে গেলেই বিপদের সম্ভাবনা দেখা দেয়।

অভিযোগ রয়েছে, জেলায় কোনো নিয়মনীতি না মেনেই চলছে হাজারো অটোরিকশা-ইজিবাইক। এসব অটোরিকশা-ইজিবাইক চালকদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ। এছাড়া, তাদের বিরুদ্ধে আছে যত্রতত্র পার্কিংয়ের অভিযোগ। যখন যেখানে ইচ্ছা দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী পরিবহন করেন তারা। 

রাতে শহরের বিশ্বরোড ও শান্তিমোড়সহ আশাপাশের বিভিন্ন এলাকায় সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সড়ক-মহাসড়কে চলাচলরত ইজিবাইক-অটোরিকশা, মাহেন্দ্রতে এলইডি লাইট ব্যবহার করছেন চালকরা। এলইডি লাইটের আলোতে চার্জ কম লাগে বিধায় লোকজন এসবের দিকে ঝুঁকছেন বলে জানা গেছে।

জেলার অটোরিকশার খুচরা পার্টস বিক্রেতারে সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাগুলোর সঙ্গে যেসব হেডলাইট দেওয়া হয়, সেগুলোতে আলোর মাত্রা খুবই কম। যার ফলে এসব যানের মালিকরা ওই হেডলাইটের পরিবর্তে বেশি আলোর আশায় এলইডি লাইট ব্যবহার করছেন। সাধারণত এসব লাইট ১৫০ থেকে ৩০০ টাকায় পাওয়া যায়। কম দামের এসব লাইটের চাহিদাও আছে বেশ। অনান্য অটোরিকশার মালিকদের দেখাদেখি নতুন যারা গাড়ি কিনছেন তারাও এই লাইট কিনে ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। 

স্কুল শিক্ষক মাহবুবুর রহমান জানান, সন্ধ্যার পর মোটরসাইকেল নিয়ে বের হতে ভয় হয় তার। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি যেতে হয়। সেখান থেকে ফেরার সময় সাদা আলোর ভয়ে সন্ধ্যার আগেই রওনা হন তিনি। এলইডি লাইট লাগানোর কারণে কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত বোঝা যায় না যে বিপরীত দিক থেকে কি গাড়ি আসছে। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে চালাতে হয় গাড়ি। এভাবে গাড়ি চালাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন অনেকেই।

এলইডি লাইটের আলোর কারণে দুর্ঘটনার কবলে পড়া মঈন উদ্দীন নামের এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, কিছুদিন আগে সন্ধ্যার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে শিবগঞ্জে যাচ্ছিলাম। মহারাজপুরের মেলার মোড় এলাকায় বিপরীত দিক থেকে এলইডি লাইটযুক্ত একটি অটোরিকশা আসছিল। সাদা আলো এসে চোখে লাগায় গতিরোধক বুঝতে পারিনি। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িসহ পড়ে গিয়ে আহত হই।

তিনি দাবি করেন, জেলায় ছোটবড় যানবাহনগুলোতে এলইডি লাইটের ব্যবহার বেশি হচ্ছে। এখনই এসব লাইটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আগামীতে আরও বাড়বে। তখন লাগাম টানা খুবই কষ্টকর হয়ে যাবে।

রাতের সড়কে সাদা আলো মানুষের চোখে ব্যপক্ষ ক্ষতির কারণ বলছেনচাঁপাইনবাবগঞ্জের চক্ষু চিকিৎসক ডা. ইউসুফ আলী।তিনি বলেন, এলইডি লাইটের সাদা আলো সরাসরি চোখে লাগলে সেটা ক্ষতিকর। এলইডি লাইটের সাদা আলো মানুষের চোখে পড়লে চোখের কর্নিয়ার সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া চোখে কম দেখা, ঝাপসা দেখাসহ বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।

গাড়ির স্বাভাবিক লাইট পরিবর্তন করে সাদা আলোর এলইডি লাইট ব্যবহার করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে জানান চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক মো. শাহজামাল হক। তিনি বলেন, ব্যাটারির কম চার্জ ফুরিয়ে বেশি আলোর আাশায় বিভিন্ন যানবাহনের মালিকরা এলইডি লাইট ব্যবহার করেন। ইদানিং জেলায় এলইডি লাইটের ব্যবহার বেড়েছে অনেক। আমাদের অধীনে থাকা যেসব যানবাহনে এলইডি লাইট ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো থেকে এসব লাইট খুলে নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তাদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে। এলইডি লাইট ব্যবহার বন্ধে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, প্রতিমাসেই আমাদের অফিসে সচেতনতামূলক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সভায় আমার হর্ণ আর এলইডি লাইটের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সচেতন আর সদিচ্ছার অভাবেই কমদামি এসব লাইটের ব্যবহার বেড়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সরহকারী কমিশনার (এনডিসি) তৌফিক আজিজ জানান, এলইডি লাইটের আলোতে সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়। এসব লাইটের ব্যবহার বন্ধ করতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। সাদা আলোর লাইট বন্ধ করতে আরও বড় পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হবে।